রাগবি বিশ্বকাপ ঘিরে বিধ্বস্ত শহরে নবচাঞ্চল্য

কামাইশির নতুন স্টেডিয়াম।
কামাইশির নতুন স্টেডিয়াম।

ফুটবলের তুলনায় তেমন জনপ্রিয় খেলা নয় রাগবি। তবে দুই খেলারই জন্ম অনেকটা একই উৎস থেকে। ফলে, যেসব দেশে খেলাটি প্রচলিত, সেসব দেশের বাইরে রাগবির বিশ্বকাপ নিয়ে ক্রীড়ামোদীদের তেমন মাথাব্যথা নেই বললেই চলে।

জাপানও এর ব্যতিক্রম নয়। জাপানে লিগ পর্যায়ে রাগবি শুরু হয়েছিল ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিক থেকে। তা সত্ত্বেও রাগবি দেশটিতে খুব বেশি জনপ্রিয় খেলা হয়ে উঠতে পারেনি। তবে রাগবির বিশ্বকাপ এ বছর জাপানে বসছে বলে হঠাৎ করেই সংবাদমাধ্যমে আলোচিত এক খেলা হয়ে উঠছে এটি। জাপানের তরুণদের মধ্যেও রাগবি নিয়ে উৎসাহ লক্ষ করা যাচ্ছে।

ফুটবলের মতোই রাগবির বিশ্বকাপ প্রতি চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয়। রাগবির বিশ্ব সংগঠন খেলাটিকে জনপ্রিয় করে তোলার উদ্দেশ্যে এ বছরের বিশ্বকাপের ভেন্যু হিসেবে কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই জাপানকে বেছে নেয়। তবে টিকিট বিক্রি ও টেলিভিশন সম্প্রচার থেকে হওয়া আয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত সেই ঝুঁকি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে বলে এখন মনে করছে রাগবির বিশ্ব সংগঠন।

আগামী ২০ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া রাগবি বিশ্বকাপের সব প্রস্তুতি এখন শেষ হওয়ার পথে। জাপানজুড়ে ১২টি স্টেডিয়ামে এই বিশ্বকাপের খেলা অনুষ্ঠিত হবে। এই তালিকায় প্রধান কয়েকটি শহরের বাইরে প্রায় অপরিচিত কিছু শহরকেও রাখা হয়েছে, যার একটি হোনশু দ্বীপের উত্তর পূর্বাঞ্চলের জেলা ইওয়াতের কামাইশি শহর।

কামাইশি সবদিক থেকেই জাপানের ঘুমন্ত এক মফস্বল শহর। জনসংখ্যার দিক থেকে জাপানের বড় ১০০টি শহরের তালিকায় কামাইশি নেই। সবশেষ হিসাবে শহরটির জনসংখ্যা কমবেশি ৩৪ হাজার। অষ্টাদশ শতকের শুরুতে লৌহখনির সন্ধান পাওয়ার আগ পর্যন্ত কামাইশি ছিল জেলেদের বসবাসের ছোট একটি গ্রাম। লৌহখনি সেই গ্রামকে একসময় শহরে পরিণত করে। কিছু কিছু শিল্পকারখানাও সেখানে গড়ে ওঠে।

পরবর্তী সময়ে মেইজি পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে জাপানে নবজাগরণের সূচনায় কামাইশির প্রধান শিল্প হয়ে দাঁড়ায় ইস্পাত কারখানা। ১৯৬০-এর দশকে ইস্পাতশিল্প প্রসার লাভ করতে থাকা অবস্থায় কামাইশির জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৯০ হাজারে দাঁড়ায়। তবে বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে ইস্পাত আকর্ষণ হারালে কামাইশিও দ্রুত ফিরে যেতে শুরু করে তার মফস্বলীয় আবরণে।

২০০৫ সালে কামাইশির জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৪৩ হাজার। পাঁচ বছর পর ২০১০ সালে তা নেমে যায় ৪০ হাজারের নিচে। পরিসংখ্যানবিদেরা হিসাব করে বলেছেন, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৪০ সালের মধ্যে কামাইশির জনসংখ্যা আরও ৪০ শতাংশ হ্রাস পাবে।

২০১১ সালের দুর্যোগের স্মরণে নির্মিত স্মৃতি কমপ্লেক্স।
২০১১ সালের দুর্যোগের স্মরণে নির্মিত স্মৃতি কমপ্লেক্স।

শহরটি হয়তো ‘ঘুমন্ত’ অবস্থায় দৃষ্টির আড়ালে থেকে কাটিয়ে দিতে পারত বাকি সময়, যদি না প্রকৃতির প্রচণ্ড শক্তি তাকে লন্ডভন্ড করে না দিত। ২০১১ সালের মার্চে জাপানের উত্তর–পূর্বাঞ্চলে আঘাত হানে শক্তিশালী এক ভূমিকম্প। সেই ভূমিকম্পে উত্তাল হয়ে ওঠা সাগরের সুনামির ঢেউ কামাইশির নগরকেন্দ্র ও আরও কয়েকটি এলাকাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দিয়েছিল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০ মিটারেরও বেশি উচ্চতার ঢেউ শহরকে কেবল প্লাবিতই করেনি, সেই সঙ্গে তীব্র স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যায় আশপাশের লোকজনকে। ঢেউ সরে গেলে উঁচুতে আশ্রয় নেওয়া ভাগ্যবান মানুষ নিচে নেমে এসে খুঁজে পায় ৮৮৮টি মৃতদেহ। এ ছাড়া ১৫২ জনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, ঢেউ তাঁদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কামাইশির ১৬ হাজার বাসভবনের মধ্যে চার হাজারের বেশি দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত সেসব ভবনের একটি ছিল শহরের দুর্যোগ প্রতিরোধকেন্দ্র। সুনামির আঘাত থেকে রক্ষা পেতে দ্বিতল ভবনটিতে সেদিন প্রায় শ দুয়েক মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। তবে দুর্যোগ প্রতিরোধকেন্দ্র সুনামির ভয়াল ছোবল থেকে সবাইকে রক্ষা করতে পারেনি। ভবনে আশ্রয় নেওয়া মানুষের মধ্যে ১৬২ জন সেখানেই প্রাণ হারান।

সেই জায়গায় এখন তৈরি করা হয়েছে ভূমিকম্প ও সুনামিতে নিহত মানুষের স্মরণে এক স্মৃতি কমপ্লেক্স। কমপ্লেক্সের কালো দেয়ালে লেখা আছে নিহত সবার নাম। চলতি বছরের মার্চে এটির উদ্বোধন হয়। স্মৃতি কমপ্লেক্স পরিদর্শনকারীদের কাছে সেদিনের ঘটনা ও শহর পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টার বর্ণনা দিচ্ছেন ২৩ বছর বয়সী তরুণী নোদোকা কিকুচি। তিনি দুর্যোগে প্রাণে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের একজন। সেই সময় তিনি ছিলেন পূর্ব কামাইশি জুনিয়ার হাইস্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। স্কুলে অবস্থানরত বালক-বালিকাদের সবাই সেদিন দ্রুত উঁচু জায়গায় সরে যাওয়ায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। ভূমিকম্প ও সুনামির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত সেই স্কুল ভবন দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে কিছুদিন বাস্তুচ্যুত লোকজনের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। পরে সেটি ভেস্তে ফেলা হয়। ভাঙার আগে স্কুলটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। ভেঙে ফেলা সেই স্কুল ভবন, তার খেলার মাঠ ও আশপাশের কিছু জায়গা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে নতুন একটি রাগবি স্টেডিয়াম। বিশ্বকাপ রাগবির গ্রুপ পর্যায়ের দুটি খেলা এই স্টেডিয়ামেই অনুষ্ঠিত হবে।

স্মৃতিচারণা করছেন নোদোকা কিকুচি।
স্মৃতিচারণা করছেন নোদোকা কিকুচি।

কামাইশিকে রাগবি বিশ্বকাপের ১২টি ভেন্যুর একটি হিসেবে বেছে নেওয়ার কারণ অঞ্চলটির পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করা। পাশাপাশি শহরে রাগবির অতীত ঐতিহ্য ধরে রাখা।

১৯৭০-এর দশকের শেষ দিক থেকে শুরু করে কামাইশির নিপ্পন স্টিল রাগবি দলটি টানা সাত বছর ধরে জাপানের রাগবি লিগের চ্যাম্পিয়ন দল ছিল। ফলে, শহরটির রাগবি বিশ্বকাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ার পেছনের একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে অতীত সেই ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনা। এর মধ্যে দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে ধরে রাখা।

শহরের ডেপুটি মেয়র হিদেকি ইয়ামাজাকি মনে করেন, নবনির্মিত রাগবি স্টেডিয়াম হচ্ছে শহর পুনরুদ্ধারের প্রতীক। এবং রাগবি বিশ্বকাপ এই প্রতীকী অর্থের বাইরে অর্থনৈতিক কিছু সুবিধা এলাকার জন্য নিয়ে আসবে।

রাগবি বিশ্বকাপের আয়োজনকে কেন্দ্র করে বন্ধ থাকা সানরিকু রেলপথের কামাইশি-মিইয়াকো অংশ পুনরায় চালু হয়েছে। ফলে, মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ অঞ্চলটি অনেক বেশি পর্যটক সহজে ভ্রমণ করতে পারবেন।

২০১১ সালের দুর্যোগকে কামাইশি মনে রাখলেও তার দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো স্মৃতি শহরে সংরক্ষণ করা হয়নি। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত সব কটি এলাকাকে একেবারে নতুন আদলে সাজানো হয়েছে। ফলে, নোদোকা কিকুচি যে ভয়াবহ স্মৃতির বর্ণনা ভ্রমণকারীদের সামনে তুলে ধরছেন, তা চোখে দেখার উপায় এখন আর নেই।

কামাইশির ডেপুটি মেয়র হিদেকি ইয়ামাজাকি।
কামাইশির ডেপুটি মেয়র হিদেকি ইয়ামাজাকি।

দুর্যোগের ঠিক পরপর কামাইশির যে ছবি বিশ্বজুড়ে প্রচার পেয়েছিল, তা হলো দ্বিতল একটি ভবনের ওপর এসে পড়া এক জাহাজ। সুনামির ঢেউয়ে জাহাজটি ভেসে এসেছিল। ঢেউ সরে যাওয়ার সময় ভবনের ছাদে জাহাজটি আটকা পড়েছিল। অনেকের কাছে মনে হচ্ছে, সেই দৃশ্য হতে পারত সুনামির প্রচণ্ড শক্তির প্রতীক। পাশাপাশি স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পাওয়া শহরের দৃঢ়তার এক চাক্ষুষ প্রমাণ।

তবে কামাইশির নগর কর্তৃপক্ষ একসময় জাহাজটি সরিয়ে নেয়। কেন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল—ডেপুটি মেয়রের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শহরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভয়াল সেই স্মৃতিকে আর সামনে থেকে দেখতে চাননি। তাই সেটা রেখে দেওয়ার বিরোধিতা করছিলেন তাঁরা। এ কারণেই দ্বিতল ভবনের ওপরে জায়গা করে নেওয়া জাহাজটি সরিয়ে নেওয়া হয়।