পার্লামেন্ট স্থগিতের সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিক্রিয়া

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন প্রায় পাঁচ সপ্তাহের জন্য পার্লামেন্ট স্থগিত রাখার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে মাঠে নেমেছেন বিরোধীরা। বিতর্কিত এই সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ, গণস্বাক্ষর অভিযান ও আইনি লড়াই।

আগামী ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত পার্লামেন্টের অধিবেশন স্থগিত করার জন্য রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রতি অনুরোধ জানান প্রধানমন্ত্রী বরিস। গত বুধবার সেই অনুরোধ পাওয়ার পরপরই রানি তা অনুমোদন করেন।

বিরোধীদের অভিযোগ, সরকার ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে চুক্তিবিহীন বিচ্ছেদ কার্যকরের যে কৌশল নিয়েছে, তাতে পার্লামেন্ট যাতে বাধা দিতে না পারে, সে জন্য এ পদক্ষেপ। এ সিদ্ধান্ত ব্রেক্সিট বিষয়ে আইনপ্রণেতাদের পার্লামেন্টে বিতর্ক এবং মতামত দেওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকারকে খর্ব করবে। তবে সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিয়ে সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন, ব্রেক্সিট নিয়ে আলোচনার যথেষ্ট সময় পাবে পার্লামেন্ট।

আগামী ৩১ অক্টোবর ইইউর সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ ঘটবে বলে দিনক্ষণ নির্ধারিত রয়েছে। বিরোধীরা চুক্তিছাড়া বিচ্ছেদে নারাজ। তাঁরা আবারও সময় পেছাতে চান। তবে কট্টর ব্রেক্সিটপন্থী বরিসের সরকার সময় আর পেছাতে রাজি নয়। প্রয়োজনে চুক্তি ছাড়াই বিচ্ছেদ কার্যকরে অবিচল।

গত বুধবার পার্লামেন্ট স্থগিতের সিদ্ধান্ত জানাজানি হওয়ার পর থেকেই ওয়েস্টমিনস্টারের পার্লামেন্ট চত্বর এবং প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে জড়ো হতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। ব্রেক্সিটবিরোধী শত শত বিক্ষোভকারী মধ্যরাত পর্যন্ত রাস্তায় অবস্থান করেন। দেশের বিভিন্ন শহরে একই রকম বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে। আগামী শনি ও রোববার আরও বড় ধরনের বিক্ষোভের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এ দিকে পার্লামেন্ট স্থগিতের সিদ্ধান্ত বাতিলের আহ্বান জানিয়ে সরকারি ওয়েবসাইটে চালু করা এক পিটিশনে স্বাক্ষরকারীর সংখ্যা ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ১৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। রীতি অনুযায়ী কোনো পিটিশনে এক লাখ স্বাক্ষর পড়লে সেটি নিয়ে পার্লামেন্টে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

এ ছাড়া সরকারের সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার (জুডিশিয়াল রিভিউ) আবেদন করেছেন ব্রেক্সিটবিরোধী প্রচারক জিনা মিলার। ২০১৭ সালে বিচ্ছেদের আনুষ্ঠানিক আবেদন জানানোর বিষয়ে পার্লামেন্টের মতামত গ্রহণে সরকারকে আদালতে তুলে তিনি সফল হয়েছিলেন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, পার্লামেন্ট স্থগিতে রানির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। তবে সরকার পার্লামেন্ট স্থগিতের যে অনুরোধ জানিয়েছে, সেটির উদ্দেশ্যকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ আছে।

বৃহস্পতিবার হাউস অব কমন্সের নেতা জেকব রিচ মগ বিরোধীদের ‘ভুয়া’ আখ্যায়িত করে বলেন, ইইউর সঙ্গে থেকে যাওয়াই তাঁদের উদ্দেশ্য। তিনি বলেন, সেপ্টেম্বরে এমনিতেই দলীয় সম্মেলনের জন্য পার্লামেন্টের অধিবেশন বন্ধ থাকে। ৩১ অক্টোবর বিচ্ছেদ দিনক্ষণের আগে আলোচনার যথেষ্ট সময় পাবে পার্লামেন্ট। চুক্তিবিহীন বিচ্ছেদ পরিস্থিতি মোকাবিলার দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী মাইকেল গোভ বলেন, যেকোনো নতুন সরকার নিজস্ব পরিকল্পনা নিয়ে পার্লামেন্টের নতুন অধিবেশন শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী বরিসও তা-ই করতে যাচ্ছেন। সরকারের অংশীদার ডিইউপির নেতা অ্যারলেন ফোস্টারও প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।

তবে সংসদীয় বিশেষজ্ঞ হ্যানসার্ড সোসাইটির পরিচালক রুথ ফক্স বিবিসিকে বলেন, ব্রেক্সিট নিয়ে চলমান উত্তপ্ত সময়ে দলীয় সম্মেলনের জন্য আইনপ্রণেতারা কত দিন ছুটি নিতেন কিংবা আদৌ অধিবেশন বন্ধ করতেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত তাঁরা নিজেরা নিতেন। এ ছাড়া নতুন অধিবেশন শুরুর প্রস্তুতির জন্য পার্লামেন্ট কয়েক দিন স্থগিত রাখার রীতি আছে। কিন্তু সময় এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় এবারের ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ।

বুধবার ইউগোভ পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যের ৪৭ শতাংশ লোক সরকারের সিদ্ধান্তকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করে। মাত্র ২৭ শতাংশ এই সিদ্ধান্তের পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দেওয়া ৫১ শতাংশ এবং ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির ৫২ শতাংশ লোক সরকারের সিদ্ধান্তের সমর্থক বলে জরিপে উঠে এসেছে।

প্রায় এক মাস গ্রীষ্মের ছুটির পর আগামী ৩ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্টে ফিরবেন আইনপ্রণেতারা। স্থগিত হওয়ার আগে ৫ কর্মদিবস চলবে অধিবেশন। এ ছাড়া ১৪ অক্টোবর পুনরায় পার্লামেন্ট চালু হলে ৩১ অক্টোবরের আগ পর্যন্ত আরও প্রায় তিন সপ্তাহ সময় মিলবে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, চুক্তিবিহীন বিচ্ছেদ ঠেকাতে পার্লামেন্টের সুযোগ পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। গত এপ্রিলে ব্রেক্সিটের দিনক্ষণ পেছাতে মাত্র তিন কর্মদিবসে আইন প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন বিরোধীরা। এ ছাড়া আস্থা ভোটে সরকারের পতন ঘটানোর সুযোগও রয়েছে।

বিবিসির রাজনীতিবিষয়ক সম্পাদক লরা কুয়েন্সবার্গ বলছেন, সরকার জেনে-বুঝেই এমন ঝুঁকি নিয়েছে। কেননা, টিকে থাকার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা এ সরকারের নেই। তাই আরেকটি সাধারণ নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। পার্লামেন্ট স্থগিতের সিদ্ধান্ত সেই নির্বাচনের জন্য সহায়ক হবে বলে মনে করছে সরকার।