ভিঞ্চির আরেক 'মোনালিসার' মালিক কে?

‘আইজলওয়ার্থ মোনালিসা’র মালিকানা নিয়ে শুরু হয়েছে আইনি লড়াই। ছবি: এএফপি
‘আইজলওয়ার্থ মোনালিসা’র মালিকানা নিয়ে শুরু হয়েছে আইনি লড়াই। ছবি: এএফপি

চিত্রকর্মটি দেখলে মনে হয় একটু যেন কমবয়সী ‘মোনালিসা’। অসামান্য ‘মোনালিসা’র বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি আর ঠোঁটের কোণের ব্যক্তিত্বের ছাপ ফেলা মুচকি হাসির জায়গায় ‘কমবয়সী’ ‘মোনালিসা’র চেহারায় যেন কোমল ভাবের প্রকাশ বেশি ঘটেছে। ‘আইজলওয়ার্থ মোনালিসা’ নামের চিত্রকর্মটি ২০১২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর উপস্থাপন করে মোনালিসা ফাউন্ডেশন।

কারও মতে, ‘আইজলওয়ার্থ মোনালিসা’ লেওনার্দো দা ভিঞ্চির অসমাপ্ত চিত্রকর্ম। ‘মোনালিসা’ আঁকার আগে এই ছবি এঁকেছিলেন তিনি। কারও মতে, ‘মোনালিসা’ চিত্রকর্মের জন্য যিনি মডেল হয়েছিলেন, এটি তাঁর কম বয়সের পোর্ট্রেট।

তবে এসব দাবি নিয়ে দ্বিমত রয়েছে শুরু থেকেই। আর এখন এটি নিয়ে শুরু হয়েছে মালিকানার দ্বন্দ্ব, আইনি লড়াই। প্রায় পাঁচ দশক ব্যাংকের ভল্টে আটকে থাকা ‘আইজলওয়ার্থ মোনালিসা’ ২০০৮ সালে প্রকাশ্যে আসার পর এ বছরের জুন মাসে এর মালিকানা নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব।

আজ শনিবার সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, জুরিখভিত্তিক মোনালিসা ফাউন্ডেশন দাবি করেছে, ৩৫ বছর ধরে গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে, এই ‘মোনালিসা’ও ভিঞ্চির আঁকা। ফ্রান্সের লুভর জাদুঘরে স্থান পাওয়া ভিঞ্চির সাড়া–জাগানো চিত্রকর্ম ‘মোনালিসা’র ১০ বছর আগে ‘আইজলওয়ার্থ মোনালিসা’কে আঁকা হয়েছিল।

সোজা কালো চুল আর মুচকি হাসির ‘আইজলওয়ার্থ মোনালিসা’র সঙ্গে লুভর জাদুঘরের একই নামধারী ‘মোনালিসা’র দারুণ সাদৃশ্য রয়েছে। অনেকে সেটিকে ‘আরলিয়ার মোনালিসা’ বা ‘পূর্বের মোনালিসা’ও বলে থাকেন।

কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, এই সাদৃশ্য থেকে মনে হয়, ছবিটি শুধু কপি করা হয়েছে। যদিও কিছু ঐতিহাসিক শিল্পবোদ্ধা মনে করেন, ‘মোনালিসা’ আঁকার আগে এটি লেওনার্দো দা ভিঞ্চির অসমাপ্ত সংস্করণ।

লুভর জাদুঘরে থাকা ‘মোনালিসা’ ও ‘আইজলওয়ার্থ মোনালিসা’। ছবি: এএফপি
লুভর জাদুঘরে থাকা ‘মোনালিসা’ ও ‘আইজলওয়ার্থ মোনালিসা’। ছবি: এএফপি

দশক ধরেই চলছে এ বিতর্ক। তবে এখন তা নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে। এর মালিকানা নিয়ে আইনি লড়াই শুরু হয়েছে।

‘আইজলওয়ার্থ মোনালিসা’ বা ‘পূর্বের মোনালিসা’ চিত্রকর্মটিকে প্রায় ৪৫ বছর সুইস ব্যাংকের ভল্টে গচ্ছিত রাখা হয়। একটি সংস্থা ২০০৮ সালে সেটি অধিগ্রহণের পর বেশ কয়েকটি গ্যালারিতে তা প্রদর্শন করা হয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০১৪ সালে সিঙ্গাপুর এবং ২০১৬ সালে সাংহাইয়ে প্রদর্শন।

এ বছরের জুন মাসে এটি এই শতাব্দীতে প্রথমবার ইউরোপে প্রদর্শিত হয়। ইতালির ফ্লোরেন্স শহরের পালাজ্জো বাস্তোগি শিল্প জাদুঘরে প্রদর্শিত হয়। প্রদর্শনের শেষ পর্যায়ে নাটকীয়ভাবে এক দাবিদার চিত্রকর্মটির এক–চতুর্থাংশের মালিকানা দাবি করে বসেন।

ওই দাবিদারের আইনজীবী জোভান্নি বাতিস্তা প্রত্তি তাঁর মক্কেলের নাম প্রকাশ না করে জানান, তিনি (দাবিদার) সম্ভ্রান্ত ইউরোপীয় পরিবারের সদস্য।

প্রত্তি বলেছেন, তাঁর হাতে সাক্ষ্য–প্রমাণ রয়েছে যে চিত্রকর্মটির সাবেক মালিক তাঁর মক্কেলের কাছে ২৫ শতাংশ অংশীদারি বিক্রিতে সম্মত হয়েছিলেন। ফলে, এই অংশের ওপর পরবর্তী উত্তরাধিকার হিসেবে তাঁর মক্কেলের মালিকানা রয়েছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, চিত্রকর্মটি আবার সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকের ভল্টে ঢুকে পড়বে। এটি আর প্রদর্শিত হবে না। প্রত্তি ফ্লোরেন্স আদালতের কাছে আবেদন করেছেন, মালিকানার বিষয়টি তদন্তাধীন, ফলে চিত্রকর্মটি যেন আলাদা করে জরুরি ভিত্তিতে ইতালিতেই রেখে দেওয়া হয়।

মোনালিসা ফাউন্ডেশনের স্ট্যানলে ফেল্ডম্যান ‘মোনালিসা লেওনার্দো’স আরলিয়ার ভার্সন’ শিরোনামের গবেষণালব্ধ বইটি প্রকাশের দিন বক্তব্য দিচ্ছেন। ছবি: এএফপি
মোনালিসা ফাউন্ডেশনের স্ট্যানলে ফেল্ডম্যান ‘মোনালিসা লেওনার্দো’স আরলিয়ার ভার্সন’ শিরোনামের গবেষণালব্ধ বইটি প্রকাশের দিন বক্তব্য দিচ্ছেন। ছবি: এএফপি

প্রত্তির ওই আবেদনের ওপর আগামী সোমবার আদালতে শুনানি হবে।

এদিকে জুরিখভিত্তিক মোনালিসা ফাউন্ডেশন সিএনএনকে ই–মেইলে নিশ্চিত করেছে যে তারা শুনানিতে অংশ নেবে। তবে মামলাটিকে তারা ‘ভিত্তিহীন’ বলেছে।

চিত্রকর্মটির দাবিদার পরিবারটির দাবির মূল গাঁথা রয়েছে চিত্রকর্মটির সাম্প্রতিক বর্ণিল ইতিহাসের সঙ্গে। তবে আগের উৎসের সঙ্গে এই দাবির বিরাট ফারাক রয়েছে। শিল্প–ইতিহাসবিদেরা চিত্রকর্মটির সন্ধান পেয়েছেন বিশ শতকের গোড়ার দিকে। ওই সময় এটি আবিষ্কার করেছিলেন ব্রিটিশ চিত্রকর ও সংগ্রাহক হিউ ব্লেকার। তিনি চিত্রকর্মটি নিয়ে পশ্চিম লন্ডনের কাছাকাছি আইজলওয়ার্থ শহরে তাঁর স্টুডিওতে নিয়ে যান। এ কারণে ছবিটির নামের সঙ্গে আইজলওয়ার্থ যুক্ত করে এটাকে ‘আইজলওয়ার্থ মোনালিসা’ বলা হয়। তিনি অন্যদের বিশ্বাস করাতে সক্ষম হন যে এটি লুভরের ‘মোনালিসা’ লিসা দেল জোকোনদোর কম বয়সের ছবি। লিসা দেল ইতালির এক সম্ভ্রান্ত নারী, যিনি ‘মোনালিসা’ চিত্রকর্মের জন্য মডেল হয়েছিলেন। ব্লেকারের সৎবাবা জন এইর এটি লেওনার্দোর চিত্রকর্ম হিসেবে গবেষণা প্রকাশ করেন। এই চিত্রকর্মের একাধিক কপি তৈরির জন্য তিনি পরিচিত ছিলেন।

ব্লেকারের মৃত্যুর পর, চিত্রকর্মটি চিত্রসংগ্রাহক হেনরি এফ পুলিৎজার কিনে নেন। ব্লেকার এবং এইরের মতো তিনিও নিশ্চিত ছিলেন, এটা লেওনার্দোর আঁকা। তিনি ১৯৬৬ সালে এ নিয়ে ‘হোয়্যার ইজ দ্য মোনালিসা’ (মোনালিসা কোথায়?) শিরোনামে বইও প্রকাশ করেন। তিনি সেখানে যুক্তি দিয়ে বোঝান, চিত্রকর্মটি লেওনার্দোর আঁকা লিসা দেল জোকোনদোর একমাত্র পোর্ট্রেট।

২০১২ সালে মোনালিসা ফাউন্ডেশন ‘আইজলওয়ার্থ মোনালিসা’র বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফলাফল তুলে ধরে। ছবি: এএফপি
২০১২ সালে মোনালিসা ফাউন্ডেশন ‘আইজলওয়ার্থ মোনালিসা’র বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফলাফল তুলে ধরে। ছবি: এএফপি

১৯৭৫ সালে পুলিৎজার চিত্রকর্মটি সুইজারল্যান্ডে গচ্ছিত রাখেন। তাঁর মৃত্যুর চার বছর পর এর মালিকানা পান পুলিৎজারের সঙ্গী এলিজাবেথ মেয়ার। ২০০৮ সালে মেয়ারের মৃত্যুর পর আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘আইজলওয়ার্থ মোনালিসা’ অধিগ্রহণ করে। চিত্রকর্মটির উৎস গবেষণায় ওই বছরই মোনালিসা ফাউন্ডেশন গঠিত হয়।

তবে আইনজীবী প্রত্তি দাবি করেছেন, মেয়ার চিত্রকর্মটির তিন-চতুর্থাংশের মালিক ছিলেন। ১৯৬৪ সালে পুলিৎজার গ্যালারি চিত্রকর্মটির ২৫ শতাংশ পর্তুগালভিত্তিক পোরসেলিন প্রস্তুতকারক লেল্যান্ড গিলবার্ট নামের এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে। ১৯৬৪ সালে বিক্রির ওই কপি সিএনএনকে দেখিয়েছেন প্রত্তি। বিক্রির কপিতে দেখা গেছে, পুলিৎজার চার হাজার পাউন্ডে (এখনকার হিসাবে ৮০ হাজার পাউন্ড) ওই অংশটুকু বিক্রিতে সম্মতি দিয়েছেন। প্রত্তি জানান, তাঁর মক্কেল গিলবার্টের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। সেই হিসাবে চিত্রকর্মটির এক–চতুর্থাংশেরও অংশীদার।

মোনালিসা ফাউন্ডেশনের আইনজীবী মার্কো পারদুচ্চি সিএনএনের ই–মেইলের জবাবে বলেন, প্রত্তির দাবির কোনো ভিত্তি নেই। তবে তিনি চিত্রকর্মটির ক্রয়াদেশের ওপর সুনির্দিষ্টভাবে কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি জানান, আদালতে সাক্ষ্য–প্রমাণ জমা দেওয়া হয়েছে। পুলিৎজারের উত্তরাধিকারী চিত্রকর্মটির পূর্ণ এবং সঠিক মালিক। এর সঙ্গে কোনো তৃতীয় পক্ষ নেই।

প্রত্তির ভাষায়, চিত্রকর্মটিকে তাঁর মক্কেল গুপ্তধন হিসেবে দেখছেন না। চিত্রকর্মটি জনসাধারণের জন্য প্রদর্শনে ফিরিয়ে আনাই তাঁদের লক্ষ্য। তাঁরা চান, জনগণ যেন চিত্রকর্মটি দেখতে পান। তাঁরা চান না, চিত্রকর্মটি আরও ৪০ থেকে ৫০ বছরের জন্য সুইস ব্যাংকের ভল্টে পড়ে থাকুক। তিনি বলেন, ‘আপনি এ ধরনের একটি চিত্রকর্মের মালিক হলে অবশ্যই এর হেফাজতকারী হতে চাইবেন।’