ব্রেক্সিট বিতর্ক: নজিরবিহীন নাটকীয়তায় সংসদ অধিবেশন স্থগিত

বরিস জনসন
বরিস জনসন

কট্টর ব্রেক্সিটপন্থী প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পাঁচ সপ্তাহের জন্য স্থগিত হয়ে গেছে যুক্তরাজ্যের সংসদ অধিবেশন। গতকাল সোমবার অধিবেশন স্থগিত হওয়ার আগে স্থানীয় সময় মধ্যরাত পর্যন্ত চলে সরকার ও বিরোধীদের উত্তপ্ত বিতর্ক। বিরোধী দলীয় আইনপ্রণেতাদের তুমুল প্রতিবাদ ও অভিনব বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয় পার্লামেন্ট স্থগিতের ঐতিহাসিক চর্চা। উত্তেজনা আর তুমুল নাটকীয় এমন রাত আগে কখনো দেখেনি যুক্তরাজ্যের সংসদ।

গতকাল চলতি অধিবেশনের শেষ কার্যদিবসেও সংসদের কাছে শোচনীয়ভাবে ধরাশায়ী হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস। সরকারের ব্রেক্সিটনীতির বিরোধীরা দিনটিকে সর্বোচ্চ কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। সরকার কিসের ভিত্তিতে পার্লামেন্ট স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সব যোগাযোগের নথি প্রকাশ করতে প্রস্তাব আনা হয়। আরেক প্রস্তাবে চুক্তিবিহীন বিচ্ছেদের পরিণতি নিয়ে সরকারি গবেষণার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করতে বলা হয়। বিরোধীদের আনা দুটি প্রস্তাবই পাশ হয়েছে সংসদে।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আগামী ১৫ অক্টোবর সাধারণ নির্বাচন আয়োজনে এ দিন শেষ চেষ্টা চালান। কিন্তু পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বিরোধী দলগুলো তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। আগাম নির্বাচন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন ২৯৮ জন। আর বিপক্ষে ছিলেন ৪৬ জন। বিরোধী দল লেবার ও লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলের আইনপ্রণেতাসহ ৩০৩ জন সদস্য ভোটদান থেকে বিরত থাকেন। এ নিয়ে আগাম নির্বাচনের চেষ্টায় দ্বিতীয় দফা পরাস্ত হলেন বরিস।

ভোটাভুটির আগে বিরোধীদের চ্যালেঞ্জ করে বরিস জনসন বলেন, ‘আপনারা বারবার বলছেন চুক্তিবিহীন বিচ্ছেদ কার্যকরে জনগণের সমর্থন নেই। তাহলে সাধারণ নির্বাচনে সমর্থন দিন। জনগণ আপনাদের ভোট দিলে আপনারা বিচ্ছেদ পিছিয়ে দিতে পারবেন।’ বরিস এ সময় বারবার স্মরণ করিয়ে দেন যে, তিনি কোনো অবস্থাতেই বিচ্ছেদের দিনক্ষণ পেছানোর আবেদন করবেন না।

প্রসঙ্গত, ১৯ অক্টোবরের মধ্যে কোনো প্রকার চুক্তি সম্পাদনে ব্যর্থ হলে বিচ্ছেদের দিনক্ষণ পিছিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারকে বাধ্য করতে ইতিমধ্যে বিল পাশ করেছে সংসদ। গতকাল রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অনুমোদন লাভের মধ্য দিয়ে সেটি আইনে পরিণত হয়। এমন আইন সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর বিচ্ছেদ না পেছানোর ঘোষণা ছিল অবাক করার মতো।

বিরোধী দল লেবারের নেতা জেরেমি করবিন বলেন, অবশ্যই তিনি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। তবে সেটি প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছামাফিক তারিখে নয়। বিচ্ছেদ না পেছানোর ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আইনভঙ্গের মতো ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি করতে চাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন করবিন।

এসএনপি নেতা ইয়ান ব্ল্যাকফোর্ড প্রধানমন্ত্রীকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘আপনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানের প্রধান। আপনি যদি আইন ভঙ্গ করেন তার মানে দাঁড়াবে দেশে আইন কোনো ব্যাপার না।’

গভীর রাতে বিতর্ক শেষে যখন সংসদ স্থগিতের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়, তখন ঘটে নজিরবিহীন কাণ্ড। রীতি অনুযায়ী রানির প্রতিনিধি (ব্ল্যাক রড) নিম্ন কক্ষ বা হাউস অব কমন্সের সদস্যদের উচ্চকক্ষ বা হাউস অব লর্ডসে যাওয়ার অনুরোধ করেন। তারপর কমন্সের স্পিকারের নেতৃত্বে আইনপ্রণেতারা সেখানে যান।

কিন্তু এদিন বিরোধী দলের আইনপ্রণেতাদের কেউ কেউ স্পিকারকে তাঁর চেয়ারের চারপাশে ঘিরে ধরেন। কেউ কেউ ‘সাইলেন্স’ লেখা প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন। আর সরকারি দলের আইনপ্রণেতারা যখন বের হয়ে যাচ্ছিলেন তখন বিরোধী আইনপ্রণেতারা সমস্বরে ‘সেম অন ইউ’ স্লোগান দিতে থাকে।

এর আগে বিকেলে অধিবেশনের এক ফাঁকে অনেকটা আকস্মিকভাবে পদত্যাগের ঘোষণা দেন স্পিকার জন বারকো। আবেগঘন বক্তব্যে তিনি জানান, আগামী ৩১ অক্টোবর হবে তাঁর শেষ কর্মদিবস। দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর ধরে স্পিকারের দায়িত্ব পালন করা ক্ষমতাসীন দলীয় রাজনীতিক বারকো নানা কারণে আলোচিত ও সমালোচিত। সম্প্রতি পার্লামেন্টের অধিকার অক্ষুণ্ন রাখতে গিয়ে তিনি সরকারের বিরাগভাজন হন। যে কারণে পদত্যাগের ঘোষণার পর বিরোধী দলীয় আইনপ্রণেতারা দাঁড়িয়ে করতালির মাধ্যমে তাঁকে অভিবাদন জানালেও আশ্চর্যরকম নীরব থাকেন ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভের সদস্যরা।

আগামী ৩১ অক্টোবর ইইউ–র সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ ঘটবে বলে দিনক্ষণ নির্ধারিত রয়েছে। চুক্তি হোক বা না হোক-ওই দিনই বিচ্ছেদ কার্যকর করতে চান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। কিন্তু চুক্তিবিহীন বিচ্ছেদের বিরোধী আইনপ্রণেতারা প্রধানমন্ত্রীর এমন বেপরোয়া পদক্ষেপ ঠেকাতে মরিয়া। মুখোমুখি অবস্থানে উপনীত হয় সরকার ও সংসদ। প্রধানমন্ত্রী বরিস ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত সংসদের অধিবেশন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পার্লামেন্ট স্থগিত হওয়ার আগেই নজিরবিহীন দ্রুততায় চুক্তিবিহীন বিচ্ছেদের বিরুদ্ধে আইন পাশ করে ফেলে সংসদ। এখন প্রধানমন্ত্রী কি করেন সেদিকেই সবার দৃষ্টি।