মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী: জন্মতিথি স্মরণ

১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর পোরবন্দরে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁকে ডাকা হয় ‘মহাত্মা’ বা ‘বাপু’ বা ‘গান্ধীজি’ নামে। তাঁর জন্মতিথি স্মরণ করে এই লেখা।
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (২ অক্টোবর, ১৮৬৯—৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮)
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (২ অক্টোবর, ১৮৬৯—৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮)

ব্রিটিশদের ঐতিহ্যে রাজাকে শুধু মৃত ঘোষণা করা বারণ। বলতে হয়, ‘রাজা মারা গেছেন। রাজা দীর্ঘজীবী হোন’। সারা জীবন ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাওয়া মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ১৯৪৮ সালে নিহত হয়ে ইংরেজ রাজার মতো পরিণতি পেয়েছেন। গান্ধী নিহত হয়েছেন, গান্ধী দীর্ঘজীবী হয়েছেন।

প্রতিবাদের প্রতিরোধের সংস্কৃতি আছে। দেশ কাল আর সভ্যতাভেদে সেই সংস্কৃতি ভিন্ন হয়। এক সংস্কৃতির ধরন অন্য প্রেক্ষাপটে অবিকল কাজ করে না। প্রতিটি বড় আর ইতিহাস বদলে দেওয়া প্রতিরোধ একটি নিজস্ব প্রতিরোধের সংস্কৃতি তৈরি করে। বিংশ শতাব্দীর মানুষ এমন কয়েকটি সংস্কৃতি গড়ে উঠতে দেখেছে। তাদের মধ্যে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী একটি অনতিক্রম্য নাম। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম, এর বিভাজন, জাত-পাতের প্রতিরোধী রাজনীতি—সেই সব যে অবস্থায় আজ বিরাজ করছে, যা হয়নি আর যা হতে পারত, এসব আলোচনায় তাঁর প্রসঙ্গ না তুললে প্রাসঙ্গিকতা হারায়। কেউ তাঁকে বলছেন মহাত্মা, কেউ এমন সমীহের সম্পূর্ণ বিপরীত কিছু বলেন। কিন্তু তিনি সামনে আসবেনই। যে বিষয়গুলো নিয়ে তাঁর আন্দোলন ছিল, কোনোটাই ভারতবর্ষে এখনো সমাহিত হয়নি। ফলে তিনি প্রাসঙ্গিক।

তরুণ আইনজীবী মোহনদাস ১৮৯৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় গেলেন। তখনো তিনি লন্ডনে পাঠ করা ইংরেজ নিয়মকানুনে দৃঢ় বিশ্বাস রাখেন। একদিন ট্রেনে তিনি সাদা মানুষকে দেখেও আসন না ছাড়ায় বিপদে পড়লেন। তাঁকে ট্রেন থেকে ছুড়ে ফেলা হলো। এরপর থেকে আর কোনো দিন কারও হাতে নিগৃহীত হতে অস্বীকার জানালেন। তবে এও বুঝলেন যে এই রুখে দাঁড়ানোর কাজটি একা করা সম্ভব নয়। আর এই রুখে দাঁড়ানোর পদ্ধতিটাও ছিল অন্য রকম। দুনিয়াজুড়ে যা অহিংস আন্দোলন বলে সমাদৃত।

গান্ধীর সংগ্রাম ছিল জনসাধারণকে নিয়ে ক্ষমতার হাতে তৈরি আইন অমান্য করা। আইন হচ্ছে ক্ষমতার নিজের স্বার্থে মানুষকে চালনা করার পবিত্র নিয়ম। একে না মানার অর্থ হচ্ছে সরাসরি ক্ষমতার প্রাণভোমরাকে গলা টিপে ধরা। এই পথে এগিয়ে গান্ধী অহিংস আন্দোলনের সবচেয়ে মান্য তাত্ত্বিক হয়েছেন। হয়েছেন বেঁচে থাকতেই মিথ। দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালে তিনি তাঁর সত্যাগ্রহের আগের দৃষ্টান্ত টেনে এই পদ্ধতির ইতিহাস দেখিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন তাঁর এই অহিংসার পথচলা শুরু হয়েছে সেই সক্রেটিসের হেমলক পান থেকে। সাধারণ মানুষকে নিয়ে আইন অমান্য করার দৃষ্টান্ত আগেই দেখিয়ে গেছেন মার্কিন লেখক সমাজচিন্তক হেনরি ডেভিড থেরো। সেই ধারা অহিংসবাদী গান্ধীর ১৯৪৮ সালে গুলিতে নিহত হওয়ার পরও শেষ হয়নি। মার্কিন দেশের সিভিল রাইট মুভমেন্টের অন্যতম নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, জেমস লসন, জেমস বেভেল—তাঁরা সবাই গান্ধীর লেখা পড়ে প্রভাবিত হয়ে নিজেদের অহিংস ধারণা বিকশিত করেন। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেছেন, ‘খ্রিষ্ট আমাদের দিয়েছেন লক্ষ্য আর মহাত্মা গান্ধী দিয়েছেন লক্ষ্য অর্জনের কৌশল।’ তিনি গান্ধীকে বলতেন ‘ছোট বাদামি সাধু’।

গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয় শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে লড়তে শুরু করলেন। সঙ্গে গড়ে তুললেন তাঁর লড়াইয়ের দর্শন। এখানে ব্যক্তিমানুষের নিষ্ঠা আর অভিপ্রায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একে তিনি বলতেন সত্য। এই সত্য ব্যক্তির জীবনে আসবে কোথা থেকে? আসবে সত্য জীবনযাপনের মধ্য থেকে। পরিপার্শ্ব আর চারপাশের মানুষের জীবনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ জীবন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আর রাজনীতি হচ্ছে এমন এক জীবন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। সত্যের এই দর্শনের নাম তিনি দিলেন সত্যাগ্রহ।

এই আন্দোলন ভারতে প্রবল আলোড়ন তুলেছিল। আর সব প্রসঙ্গ বাদ দিলেও একটি বৈশিষ্ট্য গান্ধীর আন্দোলনের দিকে বারবার ফিরে তাকাতে বাধ্য করবে। আর তা হলো কী করে তিনি ভারতের সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে এমন প্রভাব ফেলতে পারলেন! বলা হয়, ভারতীয় নবীন পুঁজিপতিরা অবাধে ভারতে ব্যবসা করতে চেয়ে তাঁর পক্ষে ভিড়েছিলেন। কিন্তু হতদরিদ্র বঞ্চিত ভারতবাসী কেন তাঁকে নিজেদের পরিত্রাতা ভাবল? কেন তারা তাঁকে দেবতার আসন দিল? তপন রায়চৌধুরী তাঁর ‘বাঙালনামা’ বইয়ে একজন ওডিশা থেকে আসা বরিশালের পাচকের কথা বলেছেন। সেই ওডিশাবাসীর নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল, কোনো একদিন মহাত্মা গান্ধী তাঁর এই লাঠি ধুতির ছদ্মবেশ ছেড়ে ঘোড়ায় চড়ে অস্ত্র হাতে স্বরূপে আবির্ভূত হয়ে ভারতকে ইংরেজমুক্ত করবেন।

এখানে এসে গান্ধী রহস্যময় হয়ে ওঠেন। তিনি ভারতবর্ষের মানুষকে যেভাবে পাঠ করতে পেরেছিলেন, তেমন আর কেউ পারেননি। যে মত যে পথেই ভারতবর্ষের মানুষের মুক্তি আসুক, মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া তা সম্ভব নয়। আর এই মানুষকে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর মতো আর কেউ বুঝতে পারেননি। আর তাঁর মতো আর কাউকে সাধারণ মানুষ গ্রহণও করেনি। গান্ধী জীবনের শেষ দিকে বলেছিলেন, ‘এত দিন আমি বলেছি যে ঈশ্বরই সত্য। আজ আমাকে বলতে দাও—সত্যই ঈশ্বর।’ সত্য সে যেমনই হোক, তাকেই ঈশ্বর বলে মানতে পারার সাহস গান্ধীর ছিল। ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর বহু আন্দোলনে গান্ধী কী করে এত প্রভাব রাখতে পারলেন, সেই সত্যও বুঝতে চাওয়ার সাহস আমাদের থাকা দরকার।