অস্ট্রেলিয়ায় আরবি তৃতীয় প্রধান ভাষা

অস্ট্রেলিয়ার মধ্যাঞ্চলের টড নদীর তীরে বিশ্রামরত আদিবাসী মানুষেরা, যাদের ভাষা হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে উঠে এসেছে বিভিন্ন প্রতিবেদনে। ছবি: রয়টার্স
অস্ট্রেলিয়ার মধ্যাঞ্চলের টড নদীর তীরে বিশ্রামরত আদিবাসী মানুষেরা, যাদের ভাষা হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে উঠে এসেছে বিভিন্ন প্রতিবেদনে। ছবি: রয়টার্স

কোন অঞ্চলের মানুষ কী ভাষায় কথা বলে—এমন প্রশ্নের উত্তর সাধারণত খুব চটজলদি দিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেমন এ প্রশ্নের উত্তর হবে ‘বাংলা’। সঙ্গে একটা ভ্রুকূটিও জুটবে, যার অর্থ হচ্ছে ‘এও জানো না!’ কিন্তু শুনতে যেমনই হোক, এ ধরনের চটজলদি উত্তর খুব সুবিধার জিনিস নয়। কারণ, এর মাধ্যমে একটি অঞ্চলের অন্য ভাষাভাষী মানুষদের অগ্রাহ্য করা হয়। এটি একটি অঞ্চলের একমুখী প্রবণতার নির্দেশক, যার সঙ্গে রাষ্ট্র জড়িয়ে থাকে।

যাক, সে কথা। একটি অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, জনগোষ্ঠীর পরিচয় ইত্যাদি বিবেচনায় কোনো একটি ভাষা বেশি ব্যবহৃত হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, ওই অঞ্চলে অন্য ভাষার মানুষ নেই। আছে। কিন্তু তার হিসাব খুব একটা সামনে আসে না। এলে রীতিমতো চমকে উঠতে হয়। এই যেমন, অস্ট্রেলিয়ায় ব্যবহারের দিক থেকে আরবি ভাষা রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে। ভাষা বৈচিত্র্যের দিক থেকে এটা যেমন সুখের কথা, তেমনি দুঃখের কথাও শোনা যাচ্ছে এই অস্ট্রেলিয়াতেই। কারণ, আদিবাসীদের ভাষা বিলুপ্তির ঝুঁকিতেও এগিয়ে রয়েছে এই দেশটিই। আরও ভালোভাবে বললে বলতে হয়, দেশটির উত্তরাঞ্চলের কথা। একই রকম ঝুঁকিতে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোও রয়েছে।

ভাষার মানচিত্র তৈরির ক্ষেত্রে খুব সরলীকরণ করা হয় সাধারণত। মোটাদাগে বলে দেওয়া হয়, অমুক ভাষা অমুক অঞ্চল। কিন্তু মানুষ সব সময় এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যাচ্ছে। সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে তার মাতৃভাষাকে। এই যেমন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক নগরীতে গেলে ব্রুকলিন, কুইন্সের মতো অঞ্চলের দেখা মিলবে, যেখানে বোঝাই যাবে না যে, এ বাংলা মুলুক নয়। ফলে ভাষা নিয়ে এমন সরলীকরণের আদতে তেমন সুযোগ নেই। এ জায়গা থেকেই ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান নিওম্যাম স্টুডিওস একটি গবেষণা করে, যার প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বিভিন্ন অঞ্চলের মূল ভাষিক জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী চিহ্নিত করে একটি মানচিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

এই গবেষণার প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে দারুণ সব তথ্য, যা অনেককে এমনকি বিস্মিতও করতে পারে। এই যেমন, অস্ট্রেলিয়ার তৃতীয় প্রধান ভাষা আরবি। তাহলে দ্বিতীয় কোনটি? কেন, মান্দারিন, যা অনেক অঞ্চলেই প্রথম তিনটি ভাষার একটি হয়ে উঠেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যুক্তরাষ্ট্রের কথা। মূল ভাষা ইংরেজির পর দেশটিতে কোন ভাষার অবস্থান-জানতে চাইলে উত্তর আসবে ফরাসি অথবা স্প্যানিশ। হ্যাঁ, স্প্যানিশ যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও প্রথম তিনে নেই ফরাসি। দেশটির ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর সংখ্যার বিচারে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে চীনা ভাষা (মান্দারিন ও ক্যান্টোনিজ)। কানাডায় আবার দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে ফরাসি ও পাঞ্জাবি। ফরাসি না হয় বোঝা গেল। কিন্তু তৃতীয় স্থানে পাঞ্জাবি শুনে কি চোখ কপালে উঠে গেল?

অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে নিওম্যাম স্টুডিওসের গবেষণা তথ্যকে সমর্থন জানাচ্ছে দেশটির আদমশুমারির তথ্যও। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, অস্ট্রেলিয়ার মোট জনসংখ্যা ২ কোটি ৪৬ লাখ। এর মধ্যে আড়াই শতাংশই কথা বলে মান্দারিন ভাষায়। আর আরবিতে কথা বলে ১ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ, সংখ্যায় যা ৩ লাখ ২১ হাজারের বেশি। কথা হলো মান্দারিন জনগোষ্ঠীর উৎস না হয় চীন। কিন্তু আরবি তো কোনো একক দেশের ভাষা নয়। অস্ট্রেলিয়ার এই আরবিভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি তাহলে কারা?

এসবিএস এরাবিকের তথ্যমতে, অস্ট্রেলিয়ার আরবিভাষী জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই লেবানিজ। এ সম্পর্কিত আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, অস্ট্রেলিয়ার আরবিভাষী ৭৮ হাজার মানুষ দেশটিতে পাড়ি জমিয়েছেন লেবানন থেকে। এর পরেই রয়েছে ইরাক। দেশটি থেকে আসা অভিবাসীর সংখ্যা ৬৭ হাজার। এ তালিকায় ৩৯ হাজার প্রতিনিধি নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে মিসর।

অস্ট্রেলিয়ায় আরবদের অভিবাসন শুরু হয় মোটামুটি ১৮৮০ সালের দিকে। এর এক শ বছর পর, অর্থাৎ ১৯৮০ সালের পর দেশটিতে এ অভিবাসনের হার বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। মূলত অস্ট্রেলিয়া সরকারের উদারীকরণের পথ ধরেই এ হার বেড়েছে। দেশটির বর্তমান সরকারি নীতিতেও নিজস্ব ভাষার চর্চাকে উৎসাহিত করা হয়। আর এটিই দেশটিতে পাড়ি জমাতে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষকে উৎসাহিত করছে। এটিই আবার হয়তো স্থানীয় আদিবাসী ভাষাকে চাপে ফেলছে।

নিওম্যাম স্টুডিওসের গবেষণা আরও দারুণ কিছু তথ্য সামনে নিয়ে এসেছে। যেমন, ভারতের মহারাষ্ট্রের ভাষা মারাঠায় কথা বলে ৮ কোটিরও বেশি মানুষ, যা বিশ্বব্যাপী জার্মান ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যার কাছাকাছি। মাতৃভাষা হিসেবে জার্মান ভাষা ব্যবহার করে ৯ থেকে সাড়ে ৯ কোটি মানুষ। আবার চীনে ‘উ’ নামের একটি ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যাও প্রায় ৮ কোটি।

গবেষণাটির তথ্যের উৎস হিসেবে মূলত সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুককে ব্যবহার করা হয়েছে। উৎসটি সিআইএ হওয়াতেই স্বাভাবিক কিছু সংশয় থেকে যায়। কারণ, ভাষিক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা উল্লেখের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অক্রিয় থাকার কথা নয়। ফলে বিষয়টি অন্য উৎসগুলোর সঙ্গে তুলনা করে দেখাটাই উত্তম। সিআইএর তথ্য মানলে জার্মানিতে ব্যবহৃত প্রথম তিনটি ভাষার মধ্যে তুর্কির স্থান হয় না। বাস্তবে ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর বিচারে দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা তুর্কি। যুক্তি, তুর্কি সেখানে অভিবাসীদের ভাষা! এখানেই গলদ। কোন অঞ্চলে কত মানুষ কোন ভাষায় কথা বলছে, তা বিচারের ক্ষেত্রে মানুষের মুখ থেকে বের হওয়া শব্দকেই বিবেচনায় নেওয়া উচিত, অন্য কিছু নয়।