ঝাড়খন্ডে মোদি-শাহ জুটির বড় পরীক্ষা সোমবার

দিল্লির রামলীলা ময়দানে রোববার ভাষণ দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: এএফপি
দিল্লির রামলীলা ময়দানে রোববার ভাষণ দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: এএফপি

পাল্টা প্রচারে নেমে পড়ল বিজেপি। দিল্লির রামলীলা ময়দানে কুয়াশা ও মেঘাচ্ছন্ন রবিবাসরীয় দ্বিপ্রহরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জনসভার মধ্য দিয়ে নাগরিকত্ব সম্পর্কিত বিতর্কের যে ‘সঠিক তথ্য’ প্রচারিত হলো, আগামী কয়েক দিন ধরে সেই ভাষ্যই প্রচারিত হবে দেশের সর্বত্র। আড়াই শর বেশি সংবাদ সম্মেলন করবে বিজেপি। রাজ্যে রাজ্যে আয়োজন করা হবে ছোট-মাঝারি জনসভার। ৩ কোটি পরিবারের কাছে দল পৌঁছাবে নাগরিকত্ব আইনের ‘প্রয়োজনীয়তা’ বোঝাতে। সেই সঙ্গে তারা বোঝাতে চাইবে, গোটা পৃথিবীর ‘অত্যাচারিত’ হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্তানের সদর দরজা কেন হাট করে খোলা রাখা দরকার।

পরিকল্পনায় ঘাটতি নেই। রবিবাসরীয় সমাবেশের মূল লক্ষ্য দিল্লি বিধানসভার আসন্ন ভোটের আনুষ্ঠানিক প্রচারাভিযানের সূচনা ঘটানো। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তা হয়ে দাঁড়াল নাগরিকত্ববিষয়ক মহা-বিতর্কের জবাব। শুধু একটা কাঁটা বিজেপির গলায় খচখচ করছে। ঝাড়খন্ড।

পাঁচ দফার ভোট শেষ হয়ে ঝাড়খন্ড এখন ফলের অপেক্ষায়। কাল সোমবার বেলা বাড়ার আগেই জানাজানি হয়ে যাবে ঝাড়খন্ডের ভাগ্যলক্ষ্মী বিজেপির হাত গলে বিরোধীদের কাঁধে উঠবে কি না।

বিজেপির মনে সংশয়টা জাগিয়েছে শেষ দফার ভোটের পর রাজ্যের বুথ ফেরত সমীক্ষার ফল। তিনটি সংস্থার সমীক্ষার ফলেই এগিয়ে রয়েছে কংগ্রেস-ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চা-রাষ্ট্রীয় জনতা দলের জোট। পাঁচ বছর আগের মতো বিজেপি এবারও একক বৃহত্তম দল থাকছে। কিন্তু এবার যেহেতু তারা জোট করেনি, যেহেতু তারা মোদি-মাহাত্ম্যে ভর দিয়ে একাকী ভাগ্য পরীক্ষায় অবতীর্ণ, সেহেতু তারা জোট শক্তির কাছে পিছিয়ে যাচ্ছে। সংশয় যদি সত্য হয়, বিজেপির দুশ্চিন্তার বলিরেখা তাতে যেমন আরও গাঢ় হবে, তেমনই উৎফুল্ল হয়ে উঠবে বিরোধীকুল।

বিজেপির চিন্তার কারণ একাধিক। সেই ২০১৪ সাল থেকে সব ধরনের ভোটে বিজেপির প্রচার নিতান্তই ‘একমুখী’। নির্ভেজাল মোদিময়। ঝাড়খন্ডের প্রচারেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। লোকসভার ভোটের পর মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার ভোট হলো। মোদি-মাহাত্ম্যে ভর দিয়ে বিজেপি জনজোয়ারে ভেসে যেতে পারল না। মহারাষ্ট্রে তাদের হারাতে হলো সরকার এবং তিন দশক ধরে সবচেয়ে কাছের বন্ধু দলকে।

হরিয়ানায় দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতাসীন তারা হলো ঠিকই, তবে তা নিষ্কলুষ নয়। যাদের তুমুল বিরোধিতা করে তারা ভোট লড়েছিল, ক্ষমতা ধরে রাখার তাগিদ ও তাড়নায় তাদেরই বুকে টানতে হয়েছে। এই অবস্থায় ঝাড়খন্ড হারাতে হলে তা নিশ্চিতভাবেই মোদি-শাহ জুটির পক্ষে ভালো বিজ্ঞাপন হবে না। আরও একবার প্রমাণিত হবে এই জুটি অজেয় নয়।

প্রমাণ হবে আরও অনেক কিছুই। লোকসভার ভোটের সময় থেকে বিজেপির প্রচারের মূলে ছিল জাতীয়তাবাদ, দেশাত্মবোধ, পাকিস্তান ও হিন্দুত্ব। এই ‘ন্যারেটিভ’–এর বৃত্ত থেকে তারা মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় বের হয়নি, ঝাড়খন্ডেও নয়। রোটি-কাপড়া-মাকান (খাদ্য–বস্ত্র–বাসস্থান)কে দূরে ঠেলে লোকসভায় বালাকোট, পাকিস্তান, দেশপ্রেম, দেশদ্রোহিতা, হিন্দুত্ব প্রাধান্য পেয়েছিল। পরবর্তী তিন বিধানসভার ভোটে এ সবের সঙ্গেই উঠে এসেছে জম্মু-কাশ্মীরের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ, অযোধ্যায় রাম মন্দির, নাগরিকত্ব আইন এবং সর্বশেষ এনআরসির অঙ্গীকার।

শাসকের প্রচারে স্থান পায়নি দেশজোড়া আর্থিক মন্দা। আমল পায়নি বেকারত্বের হাহাকার। সার্বিক মূল্যবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি কল্কে পায়নি। সাধারণ মানুষের ছোট ছোট দুঃখ, যন্ত্রণা ও অভাববোধ বিন্দুমাত্র বিবেচনা করেনি। বিজেপি ভেবেছে, মোদির ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচিত সেই ‘ন্যাশনাল ন্যারেটিভ’–এর মিশ্রণ ঝাড়খন্ডের বৈতরণিও পার করে দেবে। দিলে ভালো। কিন্তু না দিলে বোঝা যাবে, সব পূজার মন্ত্র যেমন এক নয়, সব দেবদেবীর পূজাও এক ফুলে হয় না। ঝাড়খন্ড মুখ ফেরালে বিজেপির তাই গভীর চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন।

ঝাড়খন্ডের এই ভোট আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে নতুন বছরের গোড়ায় দিল্লির ভোটের কারণে। ঝাড়খন্ড ধরে রাখতে পারলে দিল্লি জয়ে বিজেপি নতুন তাগিদ পাবে। কিন্তু তা না হলে দিল্লির নেতাদের মনে হতাশা বাসা বাঁধা আশ্চর্যের নয়। এমনিতেই দিল্লিতে বিজেপির গ্রহণযোগ্য মুখের অভাব যথেষ্টই। অন্যদিকে প্রতিপক্ষ আম আদমি পার্টিও খুব তাগড়া। পাঁচ বছর শাসন করার পর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল আরও একবার ক্ষমতা লাভের প্রত্যাশা করছেন স্রেফ স্থানীয় উন্নয়নের নিরিখে।

বিজেপির জাতীয় ‘ন্যারেটিভ’–এর ফাঁদে পা না দিয়ে গত সাত-আট মাস ধরে কেজরিওয়াল শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সরকারি পরিষেবার উন্নতিকে তুলে ধরেছেন। সরকারি স্কুলগুলোর অভাবিত উন্নতি এই পাঁচ বছরে তিনি ঘটিয়েছেন। নজর দিয়েছেন শিক্ষক নিয়োগের পাশাপাশি মিড ডে মিলের ওপর। ক্রমাগত প্রচার মারফত স্কুলে যেতে উৎসাহিত করেছেন প্রান্তিক মানুষের সন্তানদের। ভোল বদলে দিয়েছেন সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোয় চিকিৎসক নিয়োগের পাশাপাশি স্বাস্থ্য পরিষেবাকে নিঃশুল্ক, সহজলভ্য ও সর্বজনীন করতে পেরেছেন। নিম্নবিত্ত পরিবারদের জন্য বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের শুল্কে তাঁর সরকার পাঁচ বছর ধরে ছাড় দিয়ে আসছে। এবার এর পরিমাণ শুধু বাড়ানোই হয়নি, ভাড়াটেরা যাতে সরকারি সিদ্ধান্তে উপকৃত হয় তা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। এই পাঁচ বছরে কেজরিওয়াল সরকারের সবচেয়ে বড় অবদান দালালির অবসান। গাড়ির লাইসেন্স থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের সরকারি সার্টিফিকেট ও পরিষেবা খরচ বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কর্মসূচি নিয়েছে তাঁর সরকার। এতে সব ধরনের দালালিই যে শুধু নির্মূল হয়েছে তা নয়, বেঁচেছে সময় ও অর্থ। ঘুষ ছাড়াও যে সরকারি কাজকর্ম হয়, দিল্লির কেজরিওয়াল সরকার তা অনেকটাই প্রমাণ করতে পেরেছে। গরিব মানুষজনের দখলে থাকা ঝুগ্গি-ঝুপড়িকে আইনি মান্যতা দেওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি এগিয়ে। এই বিপুল কর্মকাণ্ডের প্রচারের মুখে প্রদেশ বিজেপি প্রায় অসহায়। রামলীলা ময়দানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রচারের মধ্য দিয়ে বিজেপি তাই হাতে সময় নিয়ে নামার আগ্রহ দেখাচ্ছে।

নাগরিকত্ব আইন সারা দেশে বহুবিধ ক্ষোভের আগুনে বাতাস দিয়েছে। নাগরিকপঞ্জীর অঙ্গীকার সংশয় ও আশঙ্কার বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে। বিরোধী ভাষ্য, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও বহুমুখী ব্যর্থতা ঢাকতে সরকার এই জোড়া সিদ্ধান্তকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। ধর্মীয় কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠের মেরুকরণ ঘটিয়ে ভোটে জিতে ভারতকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ ঘোষণার দিকে এগিয়ে চলেছে। এই বিভাজন শেষ পর্যন্ত কোন দিকে মোড় নেবে এখনই বলা সম্ভব না।

তবে ঝাড়খন্ড ও দিল্লির ভোট শাসক দলের পক্ষে না গেলে নাগরিকত্ব আইন ভারতে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ গড়ে দিতে পারে। বিহারে সংযুক্ত জনতা দল বেসুরো গাইতে শুরু করেছে। সংসদে নাগরিকত্ব বিলের পক্ষে ভোট দিলেও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর রাজ্যে এনআরসি হতে দেবেন না। ওই রাজ্যে বিজেপির আর এক শরিক লোক জনশক্তি পার্টির কণ্ঠেও ভিন্ন সুর শোনা যাচ্ছে। বিজেপির দীর্ঘ দিনের শরিক পাঞ্জাবের অকালি দল নাগরিকত্ব আইনে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছে। মহারাষ্ট্র সরকারের তিন শরিকও এই দুই বিতর্কিত বিষয়ে ক্রমশ সহমত হচ্ছে। বিহার ও মহারাষ্ট্র সুর মেলালে দেশের মোট জনসংখ্যার বেশির ভাগই এই দুই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবে। বিরোধিতা বাড়ছে আন্তর্জাতিক স্তরেও। ধর্মীয় বৈষম্যের অভিযোগ স্থায়ী হলে মুসলিম অন্য দেশগুলোর বিরুদ্ধাচরণও মোদির সরকারকে সইতে হতে পারে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাতির বিন মহম্মদ এর টাটকা উদাহরণ।

তবে আপাতত নজরে ঝাড়খন্ড। সোমবারই বোঝা যাবে সপ্তাহের শুরুটা শাসক বিজেপিকে আশার ঝলকানি দেখাবে নাকি হতাশার আঁচলে ঢেকে দেবে।