বিশ্বজুড়ে মার খাচ্ছে গণতন্ত্র

আধুনিক গণতন্ত্রের ধারক মনে করা হয় যুক্তরাষ্ট্রকে। কিন্তু সেই দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই আজ নড়বড়ে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, গণতন্ত্র মার খাচ্ছে বিশ্বজুড়েই। যদিও আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে বিশ্বে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও নির্বাচিত নেতার সংখ্যা বেশি। এরপরও সামগ্রিকভাবে গণতন্ত্রের চর্চা অনেক কমেছে।

সুইডেনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসিস ইনস্টিটিউটের (ভি-ডেম) একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। সম্প্রতি প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৭৯টি দেশের গণতান্ত্রিক অবস্থা নিয়ে ওই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত শতাব্দীতে উদারবাদী গণতন্ত্রের চর্চা বাড়লেও একুশ শতকে এসে তা ব্যাপক হারে কমেছে।

প্রতিষ্ঠানটির একটি সূচকে দেখা গেছে, ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে ১৭৯টি দেশের মধ্যে ১৫৮টি দেশে সামগ্রিক গণতান্ত্রিক অবস্থার উন্নতি হয়নি অথবা অবনতি ঘটেছে। ওই দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ব্রাজিলসহ ২৪টি দেশ রয়েছে, যাদের গণতন্ত্রচর্চায় ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। প্রকৃত অর্থে এই দেশগুলো কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে ঝুঁকছে। বিশ্বে কর্তৃত্ববাদের জোয়ার চলছে বলেও ভি–ডেমের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।

সুইডিশ প্রতিষ্ঠান ভি–ডেমের মতে, বিশ্বে বর্তমানে মোট জনসংখ্যার এক–তৃতীয়াংশ কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করছে। এই সংখ্যা দ্রুত হারে বাড়ছে। ২০১৬ সালে সারা বিশ্বে প্রায় ৪১ কোটি ৫০ লাখ মানুষ কর্তৃত্ববাদী শাসনে পিষ্ট হয়েছে। ২০১৮ সালে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩০ কোটিতে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংস হচ্ছে বিশ্বজুড়েই। অনেক নেতা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও পরে তাঁরাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংস করছেন। লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল ও ভেনেজুয়েলা, ইউরোপের দেশ পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও তুরস্ক, এশিয়ায় ভারত ও ফিলিপাইন এবং আফ্রিকায় মালি ও বুরুন্ডি এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

>

২০১৬ সালে বিশ্বে ৪১ কোটি ৫০ লাখ মানুষ কর্তৃত্ববাদী শাসনে ছিল। ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২৩০ কোটি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে বিজেপি। এর মাধ্যমে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই প্রত্যাবর্তন দেশটিতে কর্তৃত্ববাদী শাসনের পথ প্রশস্ত করেছে।

শুধু ভি-ডেমের প্রতিবেদনেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত ওয়াশিংটনভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউসের চলতি বছরের প্রতিবেদনেও বিশ্বজুড়েই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবনতির চিত্র উঠে আসে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, টানা ১৩ বছর ধরে গণতন্ত্রের চর্চা কমছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হোভার ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো লরি ডায়মন্ড বলেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে গণতন্ত্রের অবক্ষয় শুরু হয়। বিশ্বায়ন, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে জড়ানো, প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি এই অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করেছেন। তবে চলতি দশক গণতন্ত্রের জন্য খুবই খারাপ সময়। আগের শতাব্দীর চেয়ে বর্তমান শতাব্দীতে গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি বেড়েছে।

ভি–ডেমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যায়নি। দীর্ঘদিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় থাকা দেশগুলোতে ওই ব্যবস্থা নিয়ে আস্থা কিছুটা কমলেও ছোট দেশগুলোয় আস্থা বেড়েছে। গত এক দশকে ২১টি দেশে গণতান্ত্রিক চর্চার উন্নতি হয়েছে। তিউনিসিয়া, গাম্বিয়া, শ্রীলঙ্কা, ফিজিসহ সাত দেশ সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে হেঁটেছে। হংকংও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছে। গণতান্ত্রিক চর্চার দাবিতে ইরান, লেবানন, ইরাকেও বিক্ষোভ হচ্ছে।

যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল কার্টলজ বলেন, ‘এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য জনগণকে এখনই জেগে উঠতে হবে।’