সোলাইমানিকে হত্যার জন্য এই সময় বেছে নেওয়া কেন?

ডোনাল্ড ট্রাম্প, কাসেম সোলাইমানি
ডোনাল্ড ট্রাম্প, কাসেম সোলাইমানি

ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের কুদস ফোর্সের কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলাইমানি মার্কিন হামলায় বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিহত হয়েছেন। এ তথ্য এরই মধ্যে সারা বিশ্ব জানে। বিষয়টিকে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা বলে মনে করা হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা উত্তেজনা গত বছরের শেষ কয়েক দিনে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। সরাসরি কোনো যুদ্ধ না থাকলেও দুই দেশের মধ্যে রয়েছে একাধিক ফ্রন্টে ছায়াযুদ্ধ। এ পরিস্থিতিতে কাসেম সোলাইমানির হত্যা বৈশ্বিক রাজনীতিতেই বড় একটি ঘটনা। কথা হচ্ছে, কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার উদ্দেশ্যে এমন হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র কেন এ সময়টিকে বেছে নিল, যেখানে আগে অন্তত দুবার তাঁকে নাগালে পেয়েও ছাড় দিয়েছিল মার্কিন বাহিনী।

কাসেম সোলাইমানির ওপর যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও সৌদি আরবের রাগের কারণ এখন আর অপ্রকাশ্য নয়। ইসরায়েল খোলাখুলিই বহুবার তাদের হিটলিস্টের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে কাসেম সোলাইমানির নাম বলেছে। এই ক্ষোভের কারণ সুস্পষ্ট। সোলাইমানির নেতৃত্বাধীন কুদস ফোর্স পুরো মধ্যপ্রাচ্যে এক অভিনব ছায়াযুদ্ধ শুরু করেছিল। ইরানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে ভূরাজনৈতিক খেলায় কুদস ফোর্সের উপস্থিতি ইরানকে বিশেষ সুবিধা এনে দিচ্ছিল।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, ভৌগোলিক পরিচয় তুলে দিয়ে ইরানের রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বিভিন্ন দেশে সশরীরে উপস্থিত করার কাজটি করছে এই কুদস ফোর্স। কয়েক বছর ধরে লেবানন, সিরিয়া, ইরাকসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ইরানের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ব্লকের যে যুদ্ধ চলছে, তার পেছনের কারিগর এই বিশেষ বাহিনী। সোলাইমানির রণকৌশল অনুসরণ করেই ইয়েমেনে হুতিরা যুদ্ধে লিপ্ত। এর সঙ্গে যখন গত বছরের শেষে ইরাকে মার্কিন বাহিনী ও ব্যবসায়ীর ওপর হামলা হয় এবং শেষ পর্যন্ত বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসের সুরক্ষাও প্রশ্নের মুখে দাঁড়ায়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সোলাইমানিকে আর এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না।

বিবিসি বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে তাদের হাতে সোলাইমানিকে হত্যার ১০১টি কারণ রয়েছে। তার মধ্যে মুখ্য কারণ হচ্ছে, ইরানের এই কমান্ডারের হাতে বহু মার্কিনের রক্ত লেগে আছে। এটি যদি প্রকাশ্য প্রধান কারণ হয়, তো অপ্রকাশ্য প্রধান কারণটি হচ্ছে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও ডোনাল্ড ট্রাম্প অনুসৃত ‘সর্বোচ্চ চাপ’ নীতির বিপরীতে ইরানের যে ‘প্রতিরোধযুদ্ধ’ তার মূল নেতৃত্বে ছিলেন সোলাইমানি। তাই মার্কিন বাহিনীর এমন এক হামলায় সোলাইমানি নিহত হবেন, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। বরং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হচ্ছে হামলার সময় বাছাইটি নিয়ে।

এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনার দিকে তাকাতে হয়। আগেই বলা হয়েছে, বিভিন্ন দেশে মার্কিন ব্লকের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার কাজটিই করে থাকে কুদস ফোর্স, যার নির্মাতা ও নেতৃত্বে ছিলেন কাসেম সোলাইমানি। গত বছরের শেষ কয়েক মাসে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা ইরান বিভিন্ন ফ্রন্টে চলা ছায়াযুদ্ধে নিজেদের শক্তির জানান দেয়। এর মধ্যে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ ও স্থাপনায় বোমা হামলা উল্লেখযোগ্য। সরাসরি মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করার ঘটনাও এ সময়ে ঘটে। সম্প্রতি ইরাকে বেশ কয়েকটি মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালানো হয়েছিল। ছোট ও মাঝারি মানের এসব হামলার সংখ্যা ক্রমে বাড়ছিল। এমনই এক হামলায় নিহত হন এক মার্কিন বেসামরিক ঠিকাদার। এতে ওয়াশিংটন ব্যাপক ক্ষুব্ধ হয় এবং হামলার জন্য ইরান–সমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনীকে দোষারোপ করে। মার্কিন ব্যবসায়ী নিহত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় ইরান–সমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনীর ওপর হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। এর জের ধরে দুদিন ধরে বাগদাদে মার্কিন দূতাবাস ঘিরে বিক্ষোভ হয় এবং দূতাবাসের ওপর আক্রমণ হয়। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই বাগদাদে সোলাইমানির গাড়িবহরে হামলা চালায় মার্কিন বাহিনী।

এ হামলার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পেন্টাগন বলেছে, এ হামলা ছিল মূলত প্রতিরোধের অংশ। এই জেনারেল (সোলাইমানি) ইরাকসহ পুরো অঞ্চলে থাকা মার্কিন কূটনীতিক ও পেশাজীবীদের ওপর হামলার ছক কষছিলেন।

তবে পেন্টাগন না বললেও আরেকটি কারণ কিন্তু বিভিন্ন মাধ্যম থেকে বেশ ভালোভাবে আলোচনায় উঠে এসেছে। আর তা হলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনের বছরে যখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশ করছে, তখন তার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যাচ্ছেন অভিশংসনের মতো এক অস্বস্তিকর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। উপরন্তু আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁর হাতে তেমন কোনো অর্জন নেই। ঘোষণা দিয়ে যে দুটি ফ্রন্টে তিনি লড়াই শুরু করেছিলেন, তার কোনোটিতেই কোনো ফল পাননি এখনো। কিন্তু নির্বাচনের আগে অন্তত একটি বিজয় তাঁর চাই। এর মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ইরান তুলনামূলক সহজ লক্ষ্য। এ কারণটি ফেলে দেওয়ার মতো নয় একেবারেই। বিশেষত যখন পেন্টাগনের প্রথম বিবৃতিতে জানা যায় যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশেই সোলাইমানিকে ‘হত্যা’ করা হয়েছে।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি কাসেম সোলাইমানির মার্কিন হামলায় নিহত হওয়া নিঃসন্দেহে এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বিষয়টি সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণার শামিল বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। দুই পক্ষ সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এ বিষয়ে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্য ও পারস্য উপসাগর–সম্পর্কিত হোয়াইট হাউস সমন্বয়ক ফিলিপ গর্ডন বিবিসিকে বলেন, এই হত্যা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য।

তবে ইরানের কৌশল ও অর্থনৈতিক অবস্থা বলছে, এখনই এ ধরনের সরাসরি যুদ্ধে দেশটির না জড়ানোর সম্ভাবনাই বেশি। তবে নিঃসন্দেহে দেশটি ইরাকসহ বিভিন্ন ফ্রন্টে মার্কিন ব্লকের সঙ্গে যুদ্ধে আরও মনোযোগী হয়ে উঠবে। বিশেষত মার্কিন বাহিনীর জন্য ইরাক অনেক কঠিন ক্ষেত্র হয়ে যাবে। এ ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যনীতিতে উল্লেখযোগ্য বদল আনতে হতে পারে। এ ক্ষেত্রে কাতারকে কেন্দ্র করে আরব উপসাগরীয় অঞ্চলে যে সংকট চলছে, তার মীমাংসা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কারণ, এটি আঞ্চলিক মিত্র সৌদি আরব ও ইসরায়েলকে তুষ্ট করলেও কাতারকে ভেতরে-ভেতরে অসন্তুষ্ট করছে। এই পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড় মার্কিন বিমানঘাঁটিকে সুরক্ষিত করতে হলে আরব উপসাগরে চলমান অস্থিতিশীলতার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভীষণ জরুরি।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ইরান ছোট ছোট যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মার্কিন পদক্ষেপের জবাব দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ইরাকের দিকে বিশেষ নজর থাকবে। কারণ, দেশটিতে থাকা ৫ হাজার মার্কিন সেনাকেই ইরান ও এর সমর্থক গোষ্ঠীগুলো প্রথম লক্ষ্য বানাবে। একইভাবে তালিকার ওপরের দিকেই থাকবে আফগানিস্তান, লেবানন ও সিরিয়া। তবে ইরান আবার অভিনব প্রতিক্রিয়াও দেখাতে পারে। সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর বদলে নিজেদের মিত্র বাড়ানোর পথেও এগোতে পারে দেশটি।

দুই দেশের এই লড়াইয়ের বড় শিকার হতে যাচ্ছে বৈশ্বিক অর্থনীতি। বৈশ্বিক জ্বালানি তেল সরবরাহের একটি বড় অংশ হয় হরমুজ প্রণালি দিয়ে, যার নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশেই ইরানের হাতে। ইরান এই রুট বন্ধ করে দিলে বড় ধরনের বিপাকে পড়বে গোটা বিশ্ব। কারণ বৈশ্বিক মোট গ্যাসের এক-তৃতীয়াংশ ও জ্বালানি তেল সরবরাহের এক-চতুর্থাংশই হয় এ পথ দিয়ে। ফলে জ্বালানি তেলের দামে সরাসরি প্রভাব পড়বে, যা এরই মধ্যে দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনা উপস্থিতি অবধারিতভাবেই বাড়বে। বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে হামলার পরই মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে সাত শতাধিক সেনা মোতায়েন করে ওয়াশিংটন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এ সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। আর এই সেনা উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের সামনে নিয়ে আসবে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে জড়ানোর মতো একটি বাস্তবতাকে, যার তীব্র সমালোচনা করে এ নীতি পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় বসেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অথচ পরিহাস এই যে নির্বাচনের বছরে এসে সেই পথেই এগোচ্ছেন তিনি।