টি এস এলিয়টের গোপন প্রেমের ১১৩১ চিঠি প্রকাশ

এমিলি হেইল ও টি এস এলিয়ট। হেইলকে লেখা চিঠি প্রকাশ পেল কয়েক দিন আগে। ছবি: প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট থেকে
এমিলি হেইল ও টি এস এলিয়ট। হেইলকে লেখা চিঠি প্রকাশ পেল কয়েক দিন আগে। ছবি: প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট থেকে

এই প্রেমের ব্যাপ্তি ৩০ বছরেরও বেশি। এতটা সময় কালজয়ী কবি টি এস এলিয়টের সব সৃষ্টির উৎস স্বরূপিণী, অপার্থিব আনন্দের আধার হয়ে ছিলেন বিদুষী এমিলি হেইল। দুজন দুজনকে ভালোবেসেছেন, বিনিময় করেছেন প্রেমাতুর চিঠি। হেইলকে লেখা সেই চিঠিগুলো প্রথমবারের মতো প্রকাশ করল নিউজার্সির প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি।

‘দ্য লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফর্ক’, ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’, ‘ফোর কোয়ার্টেটের’ মতো কালজয়ী সৃষ্টির কবি টি এস এলিয়টের সঙ্গে এমিলি হেইলের দেখা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯১২ সালে। ওই বছরই প্রেমে পড়েছিলেন এলিয়ট। কতটা কাতর ছিলেন প্রেমিকার জন্য তার আখ্যান এই চিঠিগুলো। কিন্তু হৃদয়নিংড়ানো ভালোবাসা, আকুলতা, আর সীমাহীন এই অনুরাগ শেষ পর্যন্ত পরিণতিতে পৌঁছায়নি। পৌঁছায় মনভাঙা এক উপসংহারে।

হেইল নিজেই তাঁকে লেখা এলিয়টের ১ হাজার ১৩১টি চিঠি দিয়ে গিয়েছিলেন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিকে। শর্ত ছিল, এলিয়ট বা তাঁর জীবদ্দশায় এগুলো প্রকাশ করা যাবে না । তাঁর মৃত্যুর পর অপেক্ষা করতে হবে আরও ৫০ বছর। এলিয়ট মারা যান ১৯৬৫ সালে, হেইল তারও চার বছর পর ১৯৬৯ সালে। অবশেষে গত বৃহস্পতিবার চিঠিগুলোর প্রকাশ পেল। নিঃসন্দেহে এলিয়ট গবেষকদের জন্য এ এক অভাবনীয় প্রাপ্তি, যা কিছু এলিয়ট গবেষকদের কাছে এত দিন ছিল অধরা, কল্পনানির্ভর তা-ই এবার উন্মোচিত হলো। প্রিয় কবির জীবনের এই অংশটি সম্পর্কে জানতে না পারার যে বেদনা, তার অবসান ঘটল এবার।

ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনার এলিয়ট গবেষক টনি কুডা গার্ডিয়ানকে বলেন, চিঠিগুলো এলিয়টের গোপন ভালোবাসার গল্প, একই সঙ্গে এই চিঠি সাহিত্যে আধুনিক যুগের নিদর্শন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলছিলেন, ‘এলিয়টের সাহিত্যিক জীবনের অজানা অংশ এটি এবং অবশ্যই বিশ শতকের প্রধান কবি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের প্রকাশ।’

প্রকাশিত চিঠিগুলো থেকে জানা যায়, লন্ডনে ১৯৩০ সালের শেষ দিকে একটা চা-আড্ডায় দেখা হয়েছিল এলিয়ট আর হেইলের। কবি তখন অসুখী একটা বিবাহিত সম্পর্কে আবদ্ধ। ওই বছরই হেইলকে প্রথম চিঠিটি লেখেন তিনি। এলিয়ট বললেন, ‘তুমি যদি জানতে তোমার জন্য আমার পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কত কথা অনুক্ত থেকে গেল, তাহলে হয়তো বিশ্বাস করতে। আমার ঘনিষ্ঠ কোনো বন্ধু নেই, যদিও প্রচুর আত্মীয়স্বজন আছেন।’ এলিয়ট নিজ হাতে লিখলেন, আশা হেইল বুঝবেন তিনি কতটা ব্যাকুল।

এলিয়ট একই চিঠিতে লিখলেন, ‘প্রথম এবং শেষবারের মতো প্রার্থনা করি, এ চিঠি যেন তোমাকে কোনো কষ্ট না দেয়। কারণ এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে এমন কিছু নেই যা নিয়ে আমি লজ্জিত—আমার ভালোবাসা সত্যি—যেকোনো ভালোবাসাই যেমনটি হয়ে থাকে।’ তিনি শেষ করলেন, ‘যদি এই চিঠি প্রেমপত্র হয়ে থাকে, তাহলে আমার জীবনে এই শেষ। আমি এতে সাক্ষর করে যাব।’

চিঠির জবাবে হেইল কী লিখেছিলেন তা জানা যায়নি। শুধু জানা যায় তিনি এলিয়টের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। এরপরই দুজন প্রেমাতুর সব চিঠি বিনিময় করতে শুরু করলেন। হেইল তখন বোস্টনে, এলিয়ট ইংল্যান্ডে।
ওই বছরের নভেম্বরের দিকে এলিয়ট টাইপ করে চিঠি পাঠালেন। জানালেন গোটা মাস যন্ত্রণায় জর্জর তিনি। এলিয়ট বলছেন, ‘তুমি আমাকে সুখী করেছ, আমি পূর্ণ। আমার জীবনে যে সুখটা প্রাপ্য ছিল পরেও, সেই সুখের নাগাল পেয়ে গেছি এখন। এই সুখ আর আমার গভীরতম শোক ও দুঃখ অভিন্ন। এ এক অপার্থিব আনন্দের অনুভূতি। আমি মিথ্যা করে নিজেকে বোঝাই তোমার জন্য আমার ভালোবাসা মরে গেছে, যদিও আমি কেবল তখনই এই মিথ্যে ভাবনায় ডুবি, যখন আমি বোধ করি আমার হৃদয়টাই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে।’

এলিয়ট বলেছেন, তিনি আবেগাপ্লুত। সারাক্ষণ আছেন জ্বরের ঘোরে। ডিসেম্বরে এসে হেইলকে লিখলেন, ‘এই বেদনা তীব্র, কিন্তু এই বেদনাতেই আমি ডুবে থাকতে চাই।’


হেইলের জন্য পরিস্থিতি ছিল আরও জটিল। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ১৯৬৯ সালে তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিককে এলিয়টের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে নিয়ে তিন পৃষ্ঠার একটি বিবরণী দেন। তিনি বলেন, এলিয়ট সে সময়ে তাঁকে যা দিয়েছিলেন, সে হিসেবে তিনি দিয়েছিলেন সামান্যই।


হেইল স্বীকার করেন, তিনি জানতের এলিয়ট একটা ভীষণ অসুখী বিবাহিত সম্পর্কের মধ্যে আছেন। কিন্তু তিনি সেই প্রতিভাধর, আবেগপ্রবণ মানুষটার ডাকে প্রথমে সাড়া দেননি। বরং যখন এলিয়ট বললেন, হেইলের প্রতি তাঁর ভালোবাসা এখন আগের চেয়েও তীব্রতর, তিনি (হেইল) আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন।

এই বন্ধুত্ব ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত ছিল। হেইল বলছেন, ‘আমাদের দেখা হতো, আমরা পরস্পরের জীবন সম্পর্কে জানতাম। যদিও তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা তখনো জটিল এবং তিনি শুধুই আমার বিশ্বস্ত বন্ধু।’


মানসিকভাবে অসুস্থ স্ত্রীর প্রতি এলিয়টের যে প্রতিশ্রুতি, তার কারণেই সম্পর্কটা একটা জায়গায় স্থির থাকল। একটা পর্যায়ে তাঁর স্ত্রীর প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসার প্রয়োজন হলো।


১৯৩৫-১৯৩৯ সাল পর্যন্ত এলিয়ট ও হেইল গ্রীষ্মটা গ্লোউসেস্টারশায়ারের ক্যাম্পডেনে কাটাতে শুরু করলেন। হেইল লিখছেন, ‘আমরা পরস্পরের কাছাকাছি এলাম, তারপরও আমাদের সম্পর্কটা একটা অস্বাভাবিক শর্তের বলয়ে এগোল। বুঝলাম, আমি তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছি।’

হেইল বলছেন, তাঁরা এই সম্পর্ককে রেখেছিলেন একটা শ্রদ্ধার জায়গায়। এলিয়ট নিজেই তাঁর জীবদ্দশায় বলেছেন, হেইলের সঙ্গে তিনি কোনো শারীরিক সম্পর্কে জড়াননি। এই সম্পর্ক নিয়ে হেইলের যে উচ্ছ্বাস, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়কে লেখা চিঠিতে তার বিবরণ পাওয়া যায়। হেইল বলছেন, ‘আমাদের আগ্রহের জায়গাগুলো ছিল এক, আমাদের ভালো লাগা–মন্দ লাগা, পারস্পরিক প্রয়োজনে আন্তরিকভাবে সাড়া দেওয়া—সুখ, আমাদের দুজন কার বন্ধন ছিল শান্ত কিন্তু অবিচ্ছেদ্য, আমাদের জীবন ছিল সমৃদ্ধ।’

গোপন প্রেমের ১১৩১টি চিঠি প্রকাশ করে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি। ছবি: প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট থেকে
গোপন প্রেমের ১১৩১টি চিঠি প্রকাশ করে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি। ছবি: প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট থেকে

এলিয়ট ও হেইলের এই সম্পর্কের কথা জানতেন খুব কম মানুষ। এলিয়টের দিকে তাঁর পরিবার ও বন্ধুমহলের কেউ কেউ, আর হেইলের গুটিকয়েক বন্ধু।


কিন্তু সম্পর্কটা নিভে গেল। এলিয়টের প্রথম স্ত্রী ভিভিয়েন হাই উড-এলিয়ট ১৯৪৭ সালে মারা যান। এলিয়ট ছেড়ে গেলেন হেইলকেও। তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করলেন। কনের নাম ভ্যালেরি। কেন এ সিদ্ধান্ত, তা চিঠিগুলোতেও পরিষ্কার নয়। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়কে ১৯৬০ সালে এলিয়ট হেইলকে বিয়ে না করার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি লিখছেন, ‘এমিলি হেইলের কারণে আমার ভেতরের কবি সত্তার মৃত্যু হতো। ভিভিয়েন আমাকে মৃতপ্রায় করেছে, কিন্তু সে আমার ভেতরকার কবিসত্ত্বাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।’

কিন্তু হেইলের প্রতি ভালোবাসার কথা প্রকাশে অকুণ্ঠ থেকেছেন তিনি ওই চিঠিতেও, ‘আমি চাই হেইলের বিবৃতি যখন প্রকাশিত হবে, তখনই প্রকাশিত হোক আমার কথাও। আমি এমিলি হেইলের প্রেমে পড়েছিলাম ১৯১২ সালে। তখন আমি হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুলে। জার্মানি এবং ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে ১৯১৪ সালে আমি আমার ভালোবাসার কথা তাকে জানাই।’
এলিয়টের এই সিদ্ধান্ত হেইলের জন্য ছিল গভীর বেদনার। হেইল বলেছেন, ‘হয়তো এলিয়ট বিবাহিত জীবন সম্পর্কে যা আশা করেছিলেন, তা আমার কাছ থেকে না পাওয়ার ভয় ছিল। হয় তো চূড়ান্ত অসুখী জীবনের একটা আগাম সম্ভাবনা টের পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর এই সিদ্ধান্ত হয়তো দুজনকেই মুক্তি দিল—আমি আসলে কখনো সত্যিটা জানতে পারিনি।’

গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ করেছেন শেখ সাবিহা আলম