'টুকরে টুকরে গ্যাংকে' শিক্ষা দিতেই কি জেএনইউয়ে হামলা?

দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ) সশস্ত্র মুখোশধারীদের হামলার পর দিল্লির পুলিশ সদর দপ্তরে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ। ছবি: এএফপি
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ) সশস্ত্র মুখোশধারীদের হামলার পর দিল্লির পুলিশ সদর দপ্তরে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ। ছবি: এএফপি

এটা কি তা হলে ‘টুকরে টুকরে গ্যাংকে’ উচিত শিক্ষা দেওয়ার আরও একটা পন্থা? গতকাল রোববার রাতে রাজধানী দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ) সশস্ত্র মুখোশধারীদের তাণ্ডব এই প্রশ্নটা তুলে দিল।

‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ শব্দের জনক প্রয়াত মন্ত্রী অরুণ জেটলি। কিন্তু তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং। নাগরিকত্ব সংক্রান্ত বিতর্কের জবাবে মাত্র কদিন আগেও এক জনসভায় তিনি নতুন করে ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ প্রসঙ্গ টেনে এনেছিলেন। এই শব্দবন্ধের সঙ্গে তিনি জন্ম দিয়েছেন আরও দুই বিশেষণ। ‘আরবান নকশাল’ ও ‘খান মার্কেট গ্যাং’।

লোকসভার গত নির্বাচনের আগে এসব শব্দের আকছার প্রয়োগ ঘটিয়ে নির্বাচনী ‘ন্যারেটিভ’ বদলে দিতে সফল হয়েছিলেন। বালাকোটকে সামনে রেখে সেই লড়াইটা তিনি জিতেছিলেন জাতীয়তাবাদকে তুলে ধরে। দেশকে ভাগ করেছিলেন দুই শিবিরে। একদিকে দেশপ্রেমী, অন্যদিকে দেশদ্রোহী। একধারে দেশ, অন্যধারে পাকিস্তান। একদিকে ‘ভারতমাতার সন্তান’, অন্যদিকে ‘পাকিস্তানি দালাল’। জেএনইউ-কাণ্ডের অন্তরালে সেটাই প্রধান কারণ কি না, বড়ভাবে সেই প্রশ্ন ফের উঠে এল।

কারণটা কাকতালীয় কি না, সেই বিতর্ক অবশ্য ভিন্ন। তবে ঘটনা হলো, রোববারই বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ দলের বুথ সম্মেলনে ভাষণ দেওয়ার সময় এনআরসি ও সিএএ বিরোধিতা প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছিলেন, টুকরে টুকরে গ্যাংকে জেলে পাঠিয়ে তিনি ঠিক কাজ করেছেন কি না। ওই সম্মেলনেই জানানো হয়, যাঁরা সিএএ ও এনআরসির বিরোধিতা করছেন, তাঁদের কীভাবে মোকাবিলা করতে হয় সরকার তা জানে। জেএনইউয়ে মুখোশধারীরা তাণ্ডব চালায় এর কয়েক ঘণ্টা পর। প্রশ্ন তাই ওই সম্ভাব্য ব্লু প্রিন্টকে ঘিরে।

হামলার পর জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ। ছবি: এএফপি
হামলার পর জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ। ছবি: এএফপি

রোববার রাতের তাণ্ডব চলে অন্তত দুই ঘণ্টা। আশ্চর্যের বিষয়, জেএনইউয়ের বাইরে সেই সময়ের মধ্যেই হাজির কয়েক শ পুলিশ এবং শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের অখিল ভারত বিদ্যার্থী পরিষদের (এবিভিপি) সদস্যরা। ছবিটা এই রকম, পুলিশ সদর আটকে পাহারা দিচ্ছে যাতে বাইরে থেকে কেউ ভেতরে না ঢুকতে পারে। তাদের সামনেই এবিভিপি সদস্যরা ‘দেশদ্রোহী’ ও ‘পাকিস্তানের দালালদের’ বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছে। পুলিশের নাকের ডগায় তারা অ্যাম্বুলেন্সকে ভেতরে যেতে দেয়নি। খবর পেয়ে চলে আসা উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত নেতাদের ঘিরে ধরেও তারা হেনস্তা করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ভেতরে যেতে যে পুলিশ বাহিনী রোববার রাতে অস্বীকার করে, তারাই কিছুদিন আগে বিনা অনুমতিতে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে ‘দেশদ্রোহীদের’ মোকাবিলা করেছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিল্লির পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত তদন্ত শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই তদন্তের স্বরূপ দেখতে আগ্রহ দানা বাঁধছে। কারণ, দিল্লি পুলিশ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন। সেই সরকারের শাসক দল বিজেপির নেতারা জেএনইউকে ‘দেশদ্রোহীমুক্ত’ করার পণ নিয়েছেন বহু দিন আগেই। নানাভাবে অশান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে এই অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। উপাচার্য স্বয়ং সেই কাজে সহায়ক বলে অভিযোগ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠন।

জেএনইউ ছাত্র সংগঠন আজ সোমবার উপাচার্য মামিদালা জগদেশ কুমারের পদত্যাগ দাবি করেছে। উপাচার্যকে ‘কাপুরুষ’ বলে অভিহিত করে সংগঠন এক বিবৃতিতে বলেছে, তিনি ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে ভয় পান। পেছনের দরজা দিয়ে অনৈতিক ও বেআইনি নীতি আমদানি করছেন। এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছেন যাতে প্রতিষ্ঠানের বদনাম হয়। ফি বৃদ্ধি ঘটিয়ে তিনি চাইছেন উচ্চশিক্ষাকে সাধারণের নাগালের বাইরে নিয়ে যেতে, যাতে বেসরকারীকরণের পথ প্রশস্ত হয়। ছাত্রসমাজ এরই বিরুদ্ধে আন্দোলন চালাচ্ছে আড়াই মাস ধরে। একই দাবি জানিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভিজিটর’ রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকে চিঠি লিখেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন। তাতে বলা হয়েছে, দিনের পর দিন এমন অপদার্থ একজনের হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম নষ্ট হতে দিলে দেশের সম্মানই ধুলোয় লুটোবে।

সিএএ ও এনআরসি দেশের বিরোধী দলগুলোকে ক্রমশই কাছাকাছি টেনে আনছিল। জেএনইউয়ের তাণ্ডব সেই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করছে। এই ঘটনা ও নাগরিকত্বকে কেন্দ্র করে সরকারি সিদ্ধান্ত বিরোধী ঐক্যকে কতটা জোরালো করবে, সেটা ভবিষ্যতে বোঝা যাবে। তবে এটা স্পষ্ট, বেহাল অর্থনৈতিক আবর্তে দেশপ্রেমের ‘ন্যারেটিভ’ ছাড়া শাসক দলের হাতে এই মুহূর্তে আর কোনো অস্ত্র নেই। সিএএ ও এনআরসির মাধ্যমে সেই অস্ত্রে শাণ দিয়েই বিজেপি এগোচ্ছে।

জেএনইউয়ের তাণ্ডব ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’, ‘দেশদ্রোহী’, ‘পাকিস্তানি’ ও ‘আরবান নকশালদের’ ‘উচিত শিক্ষা’ দিয়ে দেশপ্রেমের বাতাস বইয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ঘটানো বলেই বিরোধীরা একমত। সরকারি তদন্তে তা প্রমাণ হবে কি না, সে প্রশ্ন ভিন্ন।