সিনেমার টিকিট শেষ করে দিল একটি পরিবার

১৯৯৭ সালের ১৩ জুন ভারতের দিল্লির উপহার সিনেমা হলে অগ্নিকাণ্ডে ২৩ শিশুসহ মৃত্যু হয় ৫৯ জনের। ছবি: রয়টার্স
১৯৯৭ সালের ১৩ জুন ভারতের দিল্লির উপহার সিনেমা হলে অগ্নিকাণ্ডে ২৩ শিশুসহ মৃত্যু হয় ৫৯ জনের। ছবি: রয়টার্স

ভারতের দিল্লির বাসিন্দা নিলম কৃষ্ণমূর্তি। স্বামী–সন্তান নিয়ে সুখের সংসার ছিল তাঁর। ২২ বছর আগে এক দুপুরে শেষ হয়ে যায় সব, এক অগ্নিকাণ্ডে মারা যায় তাঁর সন্তানেরা। এত বছর ধরে অন্তরে সেই আগুনের পোড়া ক্ষত নিয়ে বেঁচে রয়েছেন নিলম। লড়ে যাচ্ছেন বিচারের দাবিতে। এ চলার গল্প যেন সিনেমাকেও হার মানায়।

নিলম কৃষ্ণমূর্তির সন্তানেরা সিনেমাপাগল ছিল। নতুন কোনো সিনেমা আসছে শুনলেই হলে গিয়ে তা দেখার বায়না ধরত ১৭ বছরের উন্নতি আর ১৩ বছরের উজ্জ্বল। নিলমও তাদের এই শখ নিয়ে বেশ মজা করতেন। প্রায়ই নতুন রিলিজ হওয়া সিনেমার টিকিট এনে চমকে দিতেন তাদের। ১৯৯৭ সালের ১৩ জুনও এমন একটি দিন ছিল। দিল্লির উপহার সিনেমা হলে ফোন দিয়ে ছেলেমেয়েদের জন্য দুটি টিকিট বুক করেন নিলম। ‘বর্ডার’ সিনেমার প্রথম শো ছিল সেটি। উন্নতি আর উজ্জ্বল যে কী খুশি হয়েছিল সেদিন। বারবার মাকে জড়িয়ে আদর করছিল তারা। নিলমের ঘরজুড়ে যেন ছিল সুখের আলো।

গ্রীষ্মের ওই দিনটির প্রতিটি মুহূর্তের কথা মনে করতে পারেন নিলম। সন্তানদের প্রতিটি স্পর্শ যেন এখনো তাঁর শরীরে লেগে আছে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে অনুভব করেন তা। ‘মেয়েটা খুব সিনেমা ভালোবাসত। কোনো সিনেমা বাজারে এলে প্রথম দিনই তা দেখা চাই তার। আমিও মেয়ের শখ জানতাম। কথা দিয়েছিলাম ওই সিনেমা প্রথম দিনের টিকিট এনে দেব’—এমন করেই যেন প্রতিদিন স্মৃতিচারণা করেন তিনি।

সেদিন দুপুরে নিলমের স্বামী শেখর মুরগি রান্না করেছিলেন। সবাই মিলে খুব মজা করে খেয়েছিলেন। খাওয়া শেষ করেই সোয়া তিনটার শো দেখতে বের হয়েছিল সন্তানেরা। মায়ের গালে চুমু দিয়ে শেষ বিদায় দিয়েছিল মেয়ে উন্নতি। তারা আর ফিরে আসেনি।

বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে প্রথমে সিনেমা হলের পার্কিংয়ে আগুন লাগে। ধোঁয়া দ্রুত সিঁড়ি ছাড়িয়ে সিনেমা হলে ঢুকে পড়ে। তীব্র ধোঁয়ায় নিশ্বাস নেওয়া দায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আতঙ্কিত মানুষ ছোটাছুটি শুরু করে। কেউ কেউ মেঝেতে শুয়ে পড়ে। আবার কেউ কেউ জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নিলমও ওই আগুনের খবর পেয়ে যান। বুক কেঁপে ওঠে তাঁর। এর পরের সবকিছু যেন ঘোরের মতো। নিলম নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করেন। হাসপাতালে একটি স্ট্রেচারে শুয়ে আছে উন্নতি, পাশে কয়েক হাত দূরে আরেকটি স্ট্রেচারে উজ্জ্বল। মনে হচ্ছিল যেন ঘুমিয়ে আছে তারা। কেবল প্রাণহীন। ওদের শরীরে এতটুকু পোড়া দাগ ছিল না। ধোয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা যায় ওরা। যেন নিলমের অসাধারণ পৃথিবীটা একপলকে শেষ হয়ে যায়।

১৯৯৭ সালের ১৩ জুন ভারতের দিল্লির উপহার সিনেমা হলে অগ্নিকাণ্ডে ২৩ শিশুসহ ৫৯ জন মারা যায়। এদের মধ্যে ছিল নিলমের দুই সন্তান উন্নতি ও উজ্জ্বল।

সন্তানেরা নেই—এই সত্যটা বুঝেও যেন মানতে পারছিলেন না নিলম। সেদিন যাওয়ার আগে সন্তানদের ঘর যেভাবে ছিল, ঠিক সেভাবেই তা সাজিয়ে রাখেন বছরের পর বছর ধরে। এমনকি বাসা বদলের পরও একটি ঘর ওভাবে সাজান তিনি। উজ্জ্বলের ব্যাগটা যেন বছরের পর বছর ধরে খাটের ওপরই থাকে। উন্নতির পাল্টানো পোশাকটা যেন কেউ ভাঁজ করে না। মনে হয় যেন কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা ঘরে ঢুকে কলরবে মুখর করে তুলবে। প্রতিদিন সেই ঘরে যান নিলম। মুছে পরিষ্কার করেন। তাঁর কষ্ট, কান্না, ক্ষোভ সবকিছুর সাক্ষী যেন ওই ঘর।

শোকে মুহ্যমান নিলম একসময় আবিষ্কার করেন যে তাঁর সন্তানদের মৃত্যু অনিবার্য ছিল না। আর এই বোধ থেকেই আইনি লড়াইয়ে নামেন তিনি। নিলম বলেন, ‘প্রথমেই আমাকে ভাবায় সিনেমা হলের বেলকনিতে থাকা মানুষগুলো কীভাবে মারা গেলেন। বেলকনিতেই বসেছিল উজ্জ্বল ও উন্নতি। পত্রিকা পড়ে আমি বুঝতে পারি, আগুন অনেক আগেই শুরু হয়েছিল, সিনেমাটি চলতে থাকে, কাউকে জানানো হয়নি, দরজা বন্ধ ছিল, দারোয়ান পালিয়ে যায়। আমি বুঝতে পারি তাদের মৃত্যু অনিবার্য ছিল না। পরে তদন্তেও এটিই বের হয়ে আসে।’

তদন্তে দেখা যায়, হলমালিক ব্যালকনিতে বছরের পর বছর ধরে অতিরিক্ত ৫২টি চেয়ার বসিয়ে রেখেছিলেন। এতে জরুরি নির্গমন রাস্তাসহ বের হওয়ার কয়েকটি পথ বন্ধ হয়ে যায়। কোনো জরুরি আলোর ব্যবস্থাও ছিল না হলে। বেঁচে যাওয়া কয়েকজন জানিয়েছিলেন, নিকষ অন্ধকারে দিগ্‌বিদিক হারিয়ে ছুটেছিলেন তাঁরা। তদন্তে আরও বের হয়ে আসে, যে ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের কারণে আগুন ধরে, সেটিও সঠিক উপায়ে লাগানো হয়নি। ত্রুটিযুক্ত ছিল। ঘটনার আগের দিনও সেটি থেকে ছোট আগুন লেগেছিল। তদন্ত যত এগোতে থাকে ততই যেন ক্ষোভ বাড়তে থাকে নিলমের। বুঝতে পারেন, এত তাড়াতাড়ি তো সন্তানদের যাওয়ার কথা ছিল না। তিনি অপরাধীদের শাস্তি দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন। নিলম তাঁর স্বামীকে বলেন, ‘তারা যখন বেঁচে ছিল তখন তাদের জন্য আমরা সব করতে প্রস্তুত ছিলাম। কেন তাদের মৃত্যুর পরও সেটা করব না।’

সিনেমা হলের পার্কিংয়ে প্রথম আগুনের সূচনা হয়। ছবি: রয়টার্স
সিনেমা হলের পার্কিংয়ে প্রথম আগুনের সূচনা হয়। ছবি: রয়টার্স

নিলম বুঝতে পারেন এটা কেবল দুর্ঘটনা ছিল না। মানুষের অবহেলা, উদাসীনতা, গাফিলতি আর লালসার বলি হয় ওই মানুষগুলো।

এ ঘটনার জন্য ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়। তাঁদের মধ্যে ওই হলের কর্মকর্তারা এবং নিরাপত্তা তদারকির কর্মকর্তারাও ছিলেন। এ ছাড়া ছিলেন উপহার সিনেমা হলের মালিক দুই ভাই সুশীল আনসাল ও গোপাল আনসাল।

নিলম ও তাঁর স্বামী শেখর এই মামলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তোলেন। ওই ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা ছিলেন ওই অ্যাসোসিয়েশনে। কীভাবে একটি সিনেমা হলে নিরাপত্তা জোরদার করতে হয়, অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে কী কী পদক্ষেপ নিতে হয়, সব নিয়ে পড়াশোনা করেন নিলম। ২০০৭ সালে আদালত ১৬ জনকে অভিযুক্ত বলে রায় দেন। তত দিনে অবশ্য চারজন মারা যান। অন্যদের অপরাধ বিবেচনায় সাত মাস থেকে সাত বছরের কারাদণ্ড হয়। আনসাল ভাইদের দুই বছর করে কারাদণ্ড হয়।

এতে খুবই কষ্ট পান নিলম। তিনি এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। তবে আপিলে তাঁদের শাস্তি আরও অর্ধেক কমে যায়। আদালতে কারণ দেখানো হয়, ‘তাঁরা শিক্ষিত। একটি সামাজিক মর্যাদা রয়েছে তাঁদের।’

নিলম বলেন, ‘আদালতের ওই রায় আমার হৃদয়টা চুরমার করে দেয়। তাঁরা যদি শিক্ষিতই হবেন, তাহলে তো তাঁদের আরও বেশি নিয়ম মানা উচিত ছিল।’

নিলম সুপ্রিম কোর্টে যান। তবে এবার রায়ে হাজতবাস নয়। সুশীল আনসাল ও তাঁর ভাই গোপাল আনসালকে ৪০ লাখ ডলার জরিমানা করেন সুপ্রিম কোর্ট। এই রায়ের দিন যেন আর নিজেকে সামলাতে পারেননি নিলম। আদালতে সব আইনি কাগজ ছুড়ে ফেলেন। আদালত থেকে বের হয়ে সবার সামনে কেঁদে ফেলেন। এর আগে কখনোই কারও সামনে কাঁদেননি নিলম। ওই দিনের পর সন্তানদের ঘরে আর যাননি নিলম। নিজেকে অপরাধী মনে হতো। মনে হতো সন্তানেরা যেন ওপারেও কষ্ট পাচ্ছে।

আবার আপিল করেন নিলম। এবার আদালত গোপাল আনসালকে এক বছরের কারাদণ্ড দেন। সুশীল আনসালের বয়স বিবেচনা করে ছেড়ে দেওয়া হয়। এটা ২০১৭ সালের কথা। আবারও সুপ্রিম কোটে পিটিশন করেন নিলম। গোপাল আনসালের পুরো দুই বছর মেয়াদের কারাদণ্ডের আবেদন করেন। এখনো লড়ে যাচ্ছেন তিনি।

উপহার সিনেমা হল এখনো আছে। জরাজীর্ণ, ২২ বছর আগের ওই ট্র্যাজেডির চিহ্ন বহন করে। বিচারপতিরা নিলমের চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জের বিষয়ে রায় না দেওয়া পর্যন্ত এটিকে ভাঙা যাবে না। এটির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকাতে পারেন না নিলম। মনে হয় একটা সিনেমার টিকিট শেষ করে দিল তাঁর পৃথিবী।