স্বৈরতন্ত্রের ডিজিটালাইজেশন নাকি ডিজিটাল স্বৈরতন্ত্র

নতুন নতুন বিভিন্ন প্রযুক্তিকে নজরদারির কাজে ব্যবহার করছে কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা। ছবি: রয়টার্স
নতুন নতুন বিভিন্ন প্রযুক্তিকে নজরদারির কাজে ব্যবহার করছে কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা। ছবি: রয়টার্স

রাজার মুখের কথাই আইন। ন্যায় তা-ই, যা রাজা করেন ও করতে বলেন। তা এই একবিংশ শতাব্দীকে এসে রাজরাজড়ার গল্প ফাঁদা কেন? উত্তরটি খুঁজতে হলে বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকাতে হবে। এশিয়া, আফ্রিকা থেকে শুরু করে ইউরোপ-আমেরিকা পর্যন্ত বিভিন্ন অঞ্চলে এখন কর্তৃত্ববাদী শাসকদেরই দেখা মিলছে। এই শাসকদের নিয়ে আবার আলোচনা-সমালোচনার প্রকরণটিতেও মিল রয়েছে।

বর্তমান বিশ্বে বহু দেশই কর্তৃত্ববাদী শাসনের মধ্যে রয়েছে। এই শাসনকাঠামোর মধ্যে অনেকটা যেচে ঢুকে পড়লেও, যাচনা দিয়ে আর তা থেকে বের হতে পারছে না দেশগুলোর সাধারণ মানুষ। তাদের বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সেই পুরোনো পন্থাই অনুসরণ করছে শাসকগোষ্ঠী; আর তা হলো নজরদারি। একজন একনায়কের ক্ষমতায় টিকে থাকার সবচেয়ে অব্যর্থ অস্ত্র হলো নজরদারি। আর এ কাজে এখনকার কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা ব্যবহার করছেন প্রযুক্তিকে, যাকে মনে করা হয়েছিল সাধারণ মানুষের মুক্তির হাতিয়ার হিসেবে।

বলা হয়, তৎকালীন পূর্ব জার্মানির ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষের ওপর নজরদারির জন্য দেশটির প্রশাসন নিয়মিত-অনিয়মিত মিলিয়ে নিয়োগ দিয়েছিল ২০ লাখ কর্মীকে। সে সময়কার সব কর্তৃত্ববাদী শাসকই পূর্ব জার্মানির এ মডেল অনুসরণ করেছিল। স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির পর উদারবাদী গণতন্ত্রের উত্থানের মধ্য দিয়ে তথাকথিত ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ ঘোষিত হলেও সাধারণ মানুষের ওপর রাষ্ট্রের নজরদারির ইতিহাস বন্ধ হয়নি; বরং আরও শক্তিশালী হয়েছে। উদারবাদী গণতন্ত্রের সঙ্গে আরও কঠোর নজরদারিকে সাংঘর্ষিক মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মানুষ শুধু রাজনৈতিক অধিকার, শিক্ষা ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতনই হয়নি, জাতীয়তাবাদী ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকেও শক্তিশালী করে তুলেছিল। তাই উদার গণতন্ত্র ও নজরদারি একসঙ্গেই চলতে পারে। এই চলা নিয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো কথা হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্র নাগরিকদের ওপর নিষ্পেষণের পাথর না চাপিয়ে দেয়। বর্তমানে প্রসঙ্গটি আবার আলোচনায় আসছে। কারণ, বিশ্বের বহু রাষ্ট্রই এখন নানা অজুহাতে এই পাথর চাপিয়ে দিচ্ছে নাগরিকদের ওপর।

এই শতকের শুরুতে যখন ইন্টারনেট, সেলফোনের মতো প্রযুক্তি এল, মানুষ ভাবল সাধারণ নাগরিকের ক্ষমতায়ন হতে যাচ্ছে এসব নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে। এসব প্রযুক্তির আগমন এই প্রতিশ্রুতি নিয়েই এসেছিল। তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার থেকে শুরু করে নতুন জগৎ সৃজনের এক বিরাট প্রতিশ্রুতি নিয়ে হাজির হয়েছিল সহস্রাব্দের সেই ক্ষণটি। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা হয়নি—এমন কথা বলা যাবে না। তবে সোনায় থাকা খাদের মতো করেই এই প্রযুক্তিও নিয়ে এসেছিল নতুন সব শঙ্কা, যা শুরুতে সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি।

ইন্টারনেট, সেলফোনসহ বিভিন্ন প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আরও গণতান্ত্রিক, আরও উদার যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন ক্রমে মিলিয়ে যেতে শুরু করল। নতুন বিভিন্ন প্রযুক্তি ক্রমে শাসকদের হাতে তুলে দিতে থাকল নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং তা অক্ষুণ্ন রাখার নতুন সব অস্ত্র। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা, যা শাসকদের জন্য নজরদারিকে আরও সহজ করে তুলেছে। এর মাধ্যমে আজকের দিনে রাজার মতো শাসন করার ইচ্ছা পোষণকারীদের হাতে এসেছে নজরদারির স্বয়ংক্রিয় পন্থা। এর হাত ধরেই ভিন্নমতের ওপর চোখ রাখা এবং তা দমন করার পরিচিত পন্থা বদলে যাচ্ছে। নাগরিকদের ওপর নজর রাখার জন্য নির্ভরযোগ্য মানুষ খোঁজা, তাকে নিযুক্ত করা ও তার বেতন–ভাতা বাবদ অর্থ ব্যয়—এর কোনোটি নিয়েই এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে ভাবতে হয় না। উপরন্তু এই পদ্ধতি মানুষ-নির্ভরতা থেকে মুক্তি দেয় রাষ্ট্রকে, যে মানুষের পক্ষে হঠাৎ বিদ্রোহী হয়ে ওঠা অসম্ভব নয়।

এমন উদাহরণ হিসেবে এডওয়ার্ড স্নোডেন তো সামনেই রয়েছেন। সর্বোপরি ঝুঁকিও অনেক কম। তাই কোনো ব্যক্তির সেলফোনের টেক্সট ম্যাসেজ বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া পোস্টের ওপর নজর রাখার জন্য বিদ্রোহে অক্ষম এবং অবৈতনিক একটি সফটওয়্যারের ওপর আস্থা রাখাই উত্তম। এই উত্তম কাজটিই করছে রাষ্ট্র। এতে একই সঙ্গে দুটি কাজ হচ্ছে। প্রথমটি তো বলাই হলো। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, যখনই কোনো ব্যক্তি অনুধাবন করে যে তার ওপর নজর রাখা হচ্ছে, তখনই সে নিজের ওপর একটি ‘সেন্সর’ বসিয়ে নেয়। এ জন্য রাষ্ট্রকে এমনকি প্রত্যক্ষ কোনো চাপও সৃষ্টি করতে হয় না।

অথচ শুরুতে ইন্টারনেট, সেলফোন, স্মার্টফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইত্যাদি মানুষকে আশাবাদী করে তুলেছিল। এই আশার বড় একটি বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল এক দশক আগে মধ্যপ্রাচ্যে, যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সাধারণ মানুষ জোটবদ্ধ হয়েছিল এবং অবসান ঘটিয়েছিল দীর্ঘদিনের একনায়কত্বের। এই বহিঃপ্রকাশই পরে রাষ্ট্রগুলোকে সতর্ক করে দেয়। তারা পদক্ষেপ নিতেও দেরি করেনি। নতুন সময়ের জন্য কর্তৃত্ববাদী শাসনের নতুন ছক কষতে বসে যান দেশে দেশে থাকা একনায়কেরা। যে প্রযুক্তির সাধারণ মানুষের কণ্ঠের বাহন হওয়ার কথা, তা ক্রমেই শাসকদের হাতিয়ারে পরিণত হতে থাকে। এটা এতটাই যে প্রায় দেড় দশক পর এসে গুগলকে আবারও তথ্যের জন্য ফি নেওয়ার ঘোষণা দিতে হয়েছে সম্প্রতি।

মার্কিন পত্রিকা ফরেন পলিসিতে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বর্তমানে বিভিন্ন দেশে বিদ্যমান কর্তৃত্ববাদী শাসনকে ‘ডিজিটাল স্বৈরতন্ত্র’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের বহু দেশের সরকার বর্তমানে এ প্রযুক্তিগুলোকে ব্যবহার করছে মানুষের প্রতিবাদের কণ্ঠ রোধ করতে। মানুষ যাতে সংঘবদ্ধ হতে না পারে, সে ব্যবস্থা প্রযুক্তির কল্যাণেই তারা আগে থেকে করে ফেলতে পারছে। তাই এই সময়ে বিভিন্ন দেশের রাস্তায় প্রতিবাদী মানুষের বিক্ষোভ দেখা গেলেও তা আর শেষ পর্যন্ত ঠিক শাসনক্ষমতায় বদল আনতে পারছে না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ছোট ছোট দাবিও আদায় করা আর সম্ভব হচ্ছে না।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডেভিড ক্লার্ক ও প্যাট্রিক রিগান পরিচালিত গণবিক্ষোভের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিদ্যমান স্বৈরশাসকদের ৬০ শতাংশই কোনো না কোনো বড় বিক্ষোভের মুখে পড়েছে। কিন্তু এসব বিক্ষোভের শুরুর দিকে বেশ ফলপ্রসূ হলেও ক্রমে এর প্রভাব কমতে থাকে। আর এই প্রভাব কমানোর কাজটি রাষ্ট্রগুলো করেছে আধুনিক বিভিন্ন প্রযুক্তির সফল প্রয়োগের মাধ্যমে।

আগে অধিকাংশ স্বৈরশাসক সশস্ত্র বাহিনীর দিক থেকে অভ্যুত্থানের ভয় করত। এর নিদান হিসেবে তারা বাহিনীগুলোর সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে বশে রাখার কৌশল নিত। এই কৌশলে কোনো বদল না এলেও যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন বিভিন্ন প্রযুক্তিকে আয়ত্তে রাখার কৌশল। নিরাপত্তাসহ নানা অভিধায় এসব প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হতে একরকম বাধ্য করা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। স্থিতিশীলতা অক্ষুণ্ন রাখার নামে করা হচ্ছে তথ্য নিয়ন্ত্রণের নানা আইন।

ফ্রিডম হাউস পরিচালিত এক গবেষণার তথ্য বলছে, ২০০০ সালের পর থেকে বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার সংকুচিত করে আইন প্রণয়নের সংখ্যা বেড়েছে। আর এ ঘটনা ঘটেছে সারা বিশ্বেই। বিশ্বের বহু দেশেই মানুষ এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও মন খুলে কথা বলছে না। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ‘মন্তব্য’ অংশে গেলে রীতিমতো ভড়কে যেতে হয়। কারণ, সেখানে অনামা বা ছদ্মনামের লোকের সংখ্যাই বেশি।

অর্থাৎ, মানুষ আর নিজের মতটি স্পষ্ট করে প্রকাশে স্বস্তিবোধ করছে না। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে অধিকার সীমিত করা নানা কানুন, আর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে এক অদৃশ্য ছায়া। এ ছায়ার নাম হতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তি। সাধারণ মানুষ স্পষ্টভাবে এর নাম বা প্রকরণ না জানলেও জানে এর প্রবণতা। এমনকি এমনও হতে পারে যে পেছনে কোনো ছায়া আদৌ নেই, থাকলেও তা দুর্বল। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী কাঠামোটি তাকে প্রতিনিয়ত নিজের শক্তির প্রকাশ ঘটিয়ে একধরনের ভীতির সঞ্চার করে, যার মূল কথা হলো ছায়াটিকে বিশ্বাস করো, সে আছে। আর এই ধারণা ও ক্রিয়া দুইয়ের সমন্বয়েই টিকে থাকে এই সময়ের কর্তৃত্ববাদী কাঠামো, যাকে ‘ডিজিটাল স্বৈরতন্ত্র’ বলছে ফরেন পলিসি।