দিল্লি থমথমে, এখনো ঘর ছাড়ছে মানুষ

দাঙ্গার ঝড় বয়ে গেছে শহরে। জমেছে ধ্বংসস্তূপ। গতকাল ভারতের নয়াদিল্লির  একটি এলাকায়।  ছবি: রয়টার্স
দাঙ্গার ঝড় বয়ে গেছে শহরে। জমেছে ধ্বংসস্তূপ। গতকাল ভারতের নয়াদিল্লির একটি এলাকায়। ছবি: রয়টার্স

চার দিনের দাঙ্গার পর ভারতের দিল্লিতে এখন থমথমে অবস্থা। বৃহস্পতিবার রাতে বা কাল শুক্রবার দিনভর গুরুতর হিংসার কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবু বাড়িঘর ছাড়ছে ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ। পুলিশ প্রশাসন, সরকার বা রাজনীতিকদের আশ্বাসে ভরসা পাচ্ছে না মানুষ। কারণ, দাঙ্গায় যখন পুড়ছিল মানুষ, তখন তারা ছিল নীরব দর্শক।

দাঙ্গায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪২ জনে পৌঁছেছে। সংখ্যা বাড়ছে মূলত আগে আহত ৩৫০ জনের কেউ কেউ এখন হাসপাতালে মারা যাওয়ায়। আবার কারও কারও মৃতদেহ আবার মুস্তাফাবাদ ও শিবপুরীর মধ্যবর্তী নালা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। চওড়া ওই নিকাশি নালা আবর্জনায় ঢাকা। ওই নালা ও ঘিঞ্জি এলাকাগুলো থেকে একটি–দুটি করে মরদেহ উদ্ধার করা হচ্ছে।

কাল ছিল শুক্রবার, জুমার দিন। তাই আশঙ্কা ছিল, জুমার নামাজের পর অশান্তি আবার মাথাচাড়া দেবে না তো? প্রশ্নটা সচকিত করে রেখেছিল দিল্লি পুলিশকে। উত্তর–পূর্ব দিল্লি তো বটেই, রাজধানীর অন্যত্রও নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছিল। বাড়তি সতর্কতা ছিল দিল্লির লাগোয়া হরিয়ানার গুরুগ্রামেও (পুরোনো নাম গুরগাঁও)। কিন্তু দিনটি শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় কাটে।

উপদ্রুত এলাকাগুলোয় থমথমে ভাব থাকলেও দিনের বেলায় কিছু কিছু দোকান খুলেছিল। শিথিল করা হয় নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু তা সত্ত্বেও জাফরাবাদ, মুস্তাফাবাদ, রানীবাগ, গোকুলপুরী, মৌজপুরীর ঘর ছেড়ে কালও বেশ কিছু পরিবার নিরাপদ জায়গায় পাড়ি দিয়েছে। পুলিশ ও রাজনৈতিক দলের আশ্বাসের প্রতি তারা ভরসা রাখতে পারছে না।

অনাস্থার দুই কারণ, দাঙ্গার সময় পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা আর ক্ষমতাসীনদের নীরবতা। জ্বলন্ত বাড়িঘর ফেলে তাড়া খাওয়া মানুষ সহায়তার আর্তি জানিয়ে মিনিটে চারটি করে ফোন করেছে দিল্লির পুলিশকে। কিন্তু তখনো পুলিশ কিছু করেছে বলে মনে করে না আক্রান্ত মানুষ।

রাজনীতিকদের নীরবতা ছিল আরও ভয়ানক। রাজধানীর একাংশ যখন জ্বলছে–পুড়ছে, লম্বা হচ্ছে লাশের সারি, তখনো দিনের পর দিন মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ততক্ষণে গুজরাট দাঙ্গার প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে দিল্লিতে।

২০০২ সালের ওই দাঙ্গার সময় ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মোদি, আজ তিনি দিল্লির ক্ষমতায়। আর সেখানেই দাঙ্গা। কথায় কথায় টুইট করেন যে মোদি, তিন দিন ধরে সেখানেও লিখলেন না একটা লাইন। তিন দিনের উন্মত্ত দাঙ্গায় রাজধানীর এক পাশ যখন মৃত্যুপুরী, তখন মুখ খুললেন তিনি। শুধু বললেন ‘দিল্লির ভাইবোনদের’ শান্ত থাকতে। কিন্তু যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) বা জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনকে (এনআরসি) ঘিরে বিক্ষোভ–সংঘর্ষ থেকে আজকের এ দাঙ্গা, তা নিয়ে একটা শব্দও বের হলো না তাঁর মুখ থেকে।

দাঙ্গার সময় সকাল–বিকেল একের পর বৈঠক করেছেন মোদির ডান হাত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কিন্তু তিনিও তখন মুখ খোলেননি। গতকাল উল্টো দাঙ্গার জন্য দোষ চাপিয়েছেন বিরোধী দলগুলোর ওপর। ওডিশার ভুবনেশ্বরে সিএএ–পন্থীদের এক সমাবেশে অমিত শাহ বলেছেন, ‘বিরোধী দলগুলো ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। তারা বলছে, সিএএএর ফলে মুসলিমরা নাগরিকত্ব হারাবে। তারা মানুষকে খ্যাপাচ্ছে, দাঙ্গা বাধাতে উসকানি দিচ্ছে।’

প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলও গতকাল উপদ্রুত এলাকায় ঘুরে মানুষকে অভয় দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপারসন রেখা শর্মা গতকাল উপদ্রুত এলাকায় যান। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, পরিস্থিতি এখন শান্ত, তবে থমথমে। মানুষের ভরসা টলে গেছে। তারা নিরাপত্তার অভাব বোধ করছে।

তিন দিনের দাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি সমালোচিত দিল্লি পুলিশ। এই কদিনে পুলিশ কমিশনার অমূল্য পট্টনায়ককে এক দিনের জন্যও উপদ্রুত এলাকায় দেখা যায়নি। চূড়ান্ত সমালোচনার মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার তাই গতকাল নতুন পুলিশ কমিশনার হিসেবে এস এন শ্রীবাস্তবের নাম ঘোষণা করেছে। চার দিন আগে তাঁকে বিশেষ কমিশনার (আইনশৃঙ্খলা) হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল।

দিল্লি পুলিশের মুখপাত্র মনদীপ সিং গতকাল জানিয়েছেন, দাঙ্গার ঘটনায় এ পর্যন্ত ১২৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেপ্তার বা আটক করা হয়েছে ৬৩০ জনকে। সহিংস ঘটনার তদন্তে দুটি বিশেষ দল গঠন করা হয়েছে।

আর যাঁদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বা ভয়ে–আতঙ্কে বাড়িতে থাকার সাহস পাচ্ছেন না, তাঁদের জন্য ৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে দিল্লির কেজরিওয়াল সরকার।

আছে সম্প্রীতির উদাহরণও
অভাবিত এ হিংসা, সংঘবদ্ধ হামলা, এত প্রাণহানির মধ্যেও হিন্দু–মুসলমানের একে অন্যের পাশে দাঁড়ানো, একে অপরের রক্ষাকর্তা হয়ে ওঠার উদাহরণগুলো ক্রমে প্রকাশ্যে আসছে। যেমন ব্রিজপুরীতে মসজিদে আগুন লাগানো হলেও স্থানীয় মুসলমানরা হিন্দুদের শিবমন্দির রক্ষা করছেন। স্থানীয় হিন্দু–মুসলমান যুবকেরা পালা দিয়ে রাত জাগছেন, যাতে নতুন করে তাঁদের এলাকায় অশান্তি না ছড়ায়। ইন্দ্র বিহারের বেশ কয়েকটি হিন্দু পরিবার ভয়ে পালালেও বাকিদের অভয় দিয়ে রক্ষা করছেন মুসলমানরা। জাফরাবাদ ও মুস্তাফাবাদের হিন্দুরা নিজেদের ঘরে লুকিয়ে রেখে প্রাণ বাঁচিয়েছেন পড়শি মুসলমানদের। এই এলাকার বাসিন্দা সরিতা কুমারীর কথায়, কপালে তিলক কাটা দাঙ্গাকারীরা এলাকায় ঢুকে মুসলিম পরিবারদের ওপর আক্রমণ করার সময় পড়শি দুই পরিবারকে তাঁরা আশ্রয় দিয়েছেন। বাড়ি তছনছ হলেও তাঁরা প্রাণে বেঁচেছেন। কোনো কোনো এলাকায় সব হারাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও করছেন হিন্দু–মুসলমান প্রতিবেশীরা। দুর্দশায় একে অন্যের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। কারাবাল নগরে ২৬ বছরের অন্তঃসত্ত্বা শাবানাকে নিজের বাইকে বসিয়ে প্রাণ হাতে করে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গেছেন প্রতিবেশী যুবক সঞ্জীব। শাবানা জন্ম দিয়েছেন পুত্রসন্তানের। চাঁদবাগ এলাকায় মুসলমান মহল্লার মধ্যে বাস করা ২৩ বছরের সাবিত্রীর বিয়ে মঙ্গলবার হতেই পারত না, মুসলমান প্রতিবেশীরা যদি পাশে না দাঁড়াতেন। সাবিত্রীর বাবা যখন বিয়ে বাতিল করার মুখে, সাবিত্রী যখন লগ্নভ্রষ্টা হওয়ার আশঙ্কায় স্থাণুবত, মুসলমান প্রতিবেশীরা তখন যাবতীয় দায়িত্ব ঘাড়ে নেন। সম্প্রীতির এমন খবর প্রতিদিন প্রকাশ পাচ্ছে। ব্রিজপুরী, মুস্তাফাবাদ, জাফরাবাদ, কারাবাল, চাঁদবাগের হিন্দু–মুসলমান এখনো তাই এই প্রশ্ন হাতড়ে বেড়াচ্ছেন, এত বছর হাত ধরাধরি করে থেকেও কারা তাঁদের মধ্যে এ রকম হিংসার দেয়াল তুলে দিতে চাইছে? উত্তর প্রত্যেকেরই এক—দাঙ্গাকারীরা অধিকাংশই বহিরাগত।

উত্তর–পূর্ব দিল্লির কিনারায় উত্তর প্রদেশের লোনি সীমান্ত। পরিকল্পিতভাবে সীমান্তের কাছে কদিন ধরে জড়ো হওয়া কয়েক শ দুষ্কৃতকারীকে কারা এভাবে কাজে লাগাল, নষ্ট করল এত প্রাণ ও সম্পত্তির, দিল্লি পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল কি সেই রহস্যের কিনারা করতে পারবে? প্রশ্নটা ক্রমে বড় হয়ে উঠছে।