দিল্লি অনেকটাই স্বাভাবিক

আগুনে পোড়া বসতবাড়ির সামনে নির্বাক চেয়ে আছেন এক বাসিন্দা। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে সম্প্রতি তোলা ছবি: এএফপি
আগুনে পোড়া বসতবাড়ির সামনে নির্বাক চেয়ে আছেন এক বাসিন্দা। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে সম্প্রতি তোলা ছবি: এএফপি

গত ৪৮ ঘণ্টা নিরুপদ্রবে কাটায় দাঙ্গাদুর্গত ভারতের রাজধানী দিল্লির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে। স্বাভাবিকতা যত ফিরছে, উপদ্রুত এলাকাগুলোর বিপর্যয়ের দৃশ্য ততই প্রকট হচ্ছে। ধ্বংস কী বিপুল, সম্পত্তি নষ্টের পরিমাণ কী ব্যাপক, হিংসার ছোবল কত মারাত্মক, তা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।

গতকাল শুক্রবার থেকেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। আজ শনিবার অবস্থার আরও উন্নতি হয়। উপদ্রুত এলাকায় অক্ষত দোকান খুলতে শুরু করেছে। বাজারে আনাগোনা বাড়ছে। চালু হয়েছে সরকারি-বেসরকারি অফিসও। দাঙ্গায় বিধ্বস্ত স্কুলগুলো ছাড়াও অন্যান্য স্কুলে ক্লাস শুরুর তোড়জোড় চলছে। সব তল্লাটে পুলিশি উপস্থিতি প্রবল। বড় সড়কগুলোয় সরকারি-বেসরকারি যান চলাচল কম হলেও চালু হয়েছে, রাস্তায় রাস্তায় যদিও মানুষের উপস্থিতি যথেষ্টই কম।

গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আর কারও মৃত্যুসংবাদ পাওয়া যায়নি। কারও লাশও উদ্ধার হয়নি। নিহত মানুষের সংখ্যা ৪২-এ আটকে আছে। পুলিশ জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ১২৩টি এফআইআর করা হয়েছে। গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে ৬৩০ জনকে। যদিও দাঙ্গায় জড়িত থাকার অভিযোগে বহিষ্কৃত আম আদমি পার্টির নেতা তাহির হুসেন এখনো অধরা।
সময় যত গড়াচ্ছে, চার দিনের দাঙ্গায় দিল্লি পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও ঔদাসীন্যের নমুনা তত জানাজানি হচ্ছে। যদিও এই নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এখনো মৌন। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে শাসক বিজেপির শীর্ষস্থানীয় কেউ কোনো প্রশ্নও তোলেননি। দিল্লি হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টও নিজের গরজে কোনো নির্দেশ দেননি।

দিল্লি পুলিশের ‘কল রেকর্ড’ উল্লেখ করে সংবাদ সংস্থা এনডিটিভি দেখিয়েছে, ২৩ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি, দাঙ্গার চার দিনে উত্তর-পূর্ব দিল্লি থেকে পুলিশের কাছে ১৩ হাজার ২০০টি ফোন গিয়েছিল। প্রতিটি ফোনেরই একই আরজি, ‘দাঙ্গা শুরু হয়েছে। আমাদের জীবন বিপন্ন। এখনই পুলিশ পাঠান।’ অভিযোগ, একটি ক্ষেত্রেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথম দিন, ২৩ ফেব্রুয়ারি, রোববার, ফোন গেছে ৭০০টি। দ্বিতীয় দিন, ২৪ তারিখে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৫০০। ২৫ তারিখে বাঁচার তাগিদ ছিল সবচেয়ে বেশি। ৭ হাজার ৫০০ ফোন করা হয়েছে থানাগুলোয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি সেই সংখ্যা কমে হয় দেড় হাজার।

প্রতিটি ফোনেই ছিল বাঁচার আকুল আর্তি। কোথায় গুলি চলছে, কোথায় আগুন লাগানো হয়েছে, কোথায় সশস্ত্র মানুষ লুটপাট করছে, কোথায় ভাঙচুর হচ্ছে—পুলিশের কল রেকর্ডে তা লেখা হয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়ার জায়গা খালি। আর্তি, আরজি বা অনুরোধে পুলিশ কান দেয়নি।

শুধু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেই নয়, দিল্লি পুলিশ ওই চার দিন বধির সেজে ছিল শাসক দলের নেতাদের কাছেও। যমুনা বিহারের বিজেপি কাউন্সিলর প্রমোদ গুপ্ত সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, বারবার ফোন করা সত্ত্বেও পুলিশ তা ধরেনি। তিনি বলেন, পুলিশ চটজলদি ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না।

একই অভিযোগ বিজেপির শরিক অকালি দলের নেতা ও রাজ্যসভার সদস্য নরেশ গুজরালের। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দর কুমার গুজরালের ছেলে নরেশ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, গত বুধবার রাতে তিনি ফোন করে জানান, মৌজপুরে এক বাড়িতে ১৬ জন মুসলমান বাসিন্দা আটকে রয়েছেন। দাঙ্গাবাজেরা তাঁদের বাড়িতে ঢোকার জন্য সব রকম চেষ্টা চালাচ্ছে। রাত পৌনে ১২টায় তাঁর ফোনের প্রাপ্তি স্বীকার করা হলেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। চিঠিতে নরেশ লিখেছেন, ‘নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিলাম আমি একজন সাংসদ। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি।’ ওই বাড়ির আটক বাসিন্দারা প্রাণে বেঁচেছিলেন স্থানীয় কিছু হিন্দু প্রতিবেশী সাহায্য করেছিলেন বলে।

শুধু নিষ্ক্রিয়তাই নয়, দাঙ্গার সময় পুলিশি নৃশংসতার দৃশ্যও সামাজিক মাধ্যমে ঘুরছে। এমন এক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, অত্যাচারে আধমরা পাঁচ যুবককে রাস্তায় ফেলে রেখে তাঁদের দিয়ে জবরদস্তি জাতীয় সংগীত গাওয়ানো হচ্ছে। তাঁদের পাশেই রয়েছে উর্দিধারী পুলিশ। চুলের মুঠি ধরে ওই যুবকদের মাথা রাস্তায় ঠুকে দেওয়া হচ্ছিল। জানতে চাওয়া হচ্ছিল, ‘আর আজাদি চাই?’ ওই যুবকদের একজনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর নাম ফাইজান। বয়স ২৩।

দিল্লি পুলিশের লোকবল প্রায় ৮০ হাজার। এর বাইরে চাইলেই পাওয়া যায় আধা সামরিক বাহিনীর সাহায্য। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর দিল্লি দাঙ্গার সময়েও পুলিশ ঠিক এভাবে নিষ্ক্রিয় ছিল। আজকের শাসক বিজেপি এখনো কংগ্রেস আমলের সেই পুলিশি অপদার্থতার সমালোচনায় মুখর হয়। এবারের দাঙ্গায় শাসক বিজেপির অনুগত পুলিশের ভূমিকাও যেন সেই ৩৬ বছরের পুরোনো আচরণের প্রতিচ্ছবি। অথচ পুলিশি ভূমিকা নিয়ে বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব আশ্চর্য রকমের নীরব! প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কারও মুখে এখনো রা নেই!

দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে ত্রাণ দেওয়ার কথা আগেই জানিয়েছিলেন। আজ রাজ্য সরকার রাজধানীর সব বড় বড় খবরের কাগজে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন দিয়েছে। কাদের কত অর্থ সাহায্য দেওয়া হবে, তার উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে দেওয়া হবে ১০ লাখ রুপি, অপ্রাপ্তবয়স্কদের ৫ লাখ। সম্পূর্ণভাবে অক্ষমদের ৫ লাখ, গুরুতর আহতদের ২ লাখ, অল্পবিস্তর আহতদের ২০ হাজার, অনাথদের ৩ লাখ রুপি করে দেওয়া হবে। মৃত গরু-ছাগল-মহিষপিছু ৫ হাজার, পুড়ে যাওয়া রিকশার জন্য ২৫ হাজার এবং ব্যাটারিচালিত রিকশার জন্য ৫০ হাজার রুপি দেওয়া হবে। যাঁদের বাড়ি পুরো পুড়ে গেছে, তাঁরা পাবেন ৫ লাখ, মারাত্মক নষ্ট হলে আড়াই লাখ, অল্প ক্ষতির জন্য ১৫ হাজার রুপি। কেন্দ্রীয় সরকার কিন্তু কোনো ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেনি। ঘরহারাদের জন্য দিল্লি সরকার ৯টি আশ্রয়স্থল তৈরি করেছে। যদিও ঘরহারাদের অধিকাংশকে আশ্রয় দিয়েছেন প্রতিবেশীরা। অনেকে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন আত্মীয়দের কাছে।

মানুষের বিপদে মানুষই এগিয়ে আসে। দিল্লিও ব্যতিক্রম নয়। সবহারাদের দুই বেলা খাওয়ানোর দায়িত্ব নিয়েছে স্থানীয় হিন্দু, মুসলমান ও শিখেরা। বহু বেসরকারি সংস্থাও তাদের মতো করে সাহায্যে এগিয়ে এসেছে।