'মাটিতে না পড়া পর্যন্ত ওরা আমাকে মারছিল'

এভাবেই কাঠের খণ্ড, বাঁশের লাঠি ও লোহার রোড দিয়ে দিনমজুর জুবায়েরকে পেটায় উন্মত্ত জনতা। চাঁদাবাগ, দিল্লি, ভারত, সোমবার। ছবি: রয়টার্স
এভাবেই কাঠের খণ্ড, বাঁশের লাঠি ও লোহার রোড দিয়ে দিনমজুর জুবায়েরকে পেটায় উন্মত্ত জনতা। চাঁদাবাগ, দিল্লি, ভারত, সোমবার। ছবি: রয়টার্স

মোহাম্মদ জুবায়েরেরর বাড়ি ভারতের দিল্লির চাঁদবাগে। পেশায় দিনমজুর। গত সোমবার যখন চাঁদবাগের বাড়ি থেকে বাইরে বের হন তিনি, তখন তাঁর মাথায় একটি বিষয়ই ছিল। আর তাহলো বাড়ি ফিরবেন ছেলেমেয়েদের জন্য হালুয়া-রুটি নিয়ে। আর সেই খাবার নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সহিংসতার শিকার হন জুবায়ের।

একদল মানুষ জুবায়েরকে কাঠের খণ্ড, বাঁশের লাঠি ও লোহার রোড দিয়ে বীভৎসভাবে পেটায়। তিনি বলেন, ভয়ানকভাবে তাঁকে পেটানো হয়েছে। ভীষণ যন্ত্রণায় জ্ঞান হারানোর আগেও পেটানো বন্ধ করতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা।

দিনমজুর জুবায়েরের ওপর নির্যাতনের ছবি ক্যামেরাবন্দী করে সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের এক আলোকচিত্রী। সেই ছবি গত মঙ্গলবার প্রকাশ করা হয়।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়, দিল্লির জিটিবি হাসপাতালে পায়চারি করে নিজের ওপর হামলার বিষয়টি স্মরণ করার চেষ্টা করছিলেন জুবায়ের। কিন্তু খুব বেশি স্মরণ করতে পাচ্ছিলেন না তিনি। সেই ছবিটি তাঁকে বেদনাদায়ক স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয়। জুবায়ের তখন বলতে থাকেন, ‘আমি মাটিতে লুটিয়ে না পড়া পর্যন্ত তারা আমাকে আঘাত করেছিল। আঘাত না করতে আমি তাদের অনুরোধ করেছিলাম, তারা আরও জঘন্যভাবে মারধর করে। তারা সাম্প্রদায়িকভাবে আঘাত করেছে, তিরস্কার করেছে, ওই সময় তাদের মুখে (বিজেপি নেতা) কপিল মিশ্রের নাম শোনা গেছে। এর চেয়ে আর বেশি কিছু স্মরণ করতে পাচ্ছি না। আমি শুধু আশা করেছিলাম, আমার ছেলেমেয়েরা যেন নিরাপদে থাকে। আমার ছবিটা দেখে আমি সহ্য করতে পারছি না, ব্যথায় আমার পা কাঁপছে।’

গত সোমবার সকালে দোয়া অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন জুবায়ের। পরে প্রতিবাদকারীরা তাঁকে ধরে ফেলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জ্ঞান হারানোর আগ পর্যন্ত তাঁকে কাঠের খণ্ড ও লোহার রোড দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। তাঁর মাথায়, বাহু, কাঁধ ও দুই পায়ে আঘাত লেগেছে। চিকিৎসার পর এরই মধ্যে তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।

দুই কন্যা ও এক ছেলেসন্তানের জনক মোহাম্মদ জুবায়ের। এক কন্যার বয়স পাঁচ ও অপরজনের বয়স দুই বছর। আর ছেলের বয়স চার বছর। নিরাপত্তার আশঙ্কায় তাদের তিনি গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

জুবায়ের বলেন, ‘আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা এখন অনেক দূরে। আমি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি নই। আমি শুধু স্থানীয় একটি দোয়া অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম এবং ছেলেমেয়েদের জন্য বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে ফিরছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, মিষ্টি পেয়ে ওরা খুশি হবে। আমি এখন জানি না তাদের সঙ্গে আমার কবে দেখা হবে।’

জুবায়ের শ্রমিকের কাজ করেন। প্রতি মাসে রোজগার ১৫ হাজার রুপি। রাজনীতির জটিল সমীকরণ তাঁর জানা নেই। এভাবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হবেন, সেটা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। চাঁদবাগে দুই কক্ষের বাসা তাঁর। একপাশে তাঁর ছোট ভাই থাকেন, অন্য পাশে পরিবার নিয়ে থাকেন তিনি।

বাড়ির বাইরে সহিংসতার কথা শুনে জুবায়েরের বৃদ্ধ মা সব সময় উদ্বিগ্ন ছিলেন। সহিংসতার শিকারের আশঙ্কায় তাঁর ছেলেমেয়েরা ঘর থেকে বের হতে সাহস পাচ্ছেন না। ভয় এবং নিজেদের নিরাপত্তার আশঙ্কায় জুবায়েরের সঙ্গে তাঁর ভাই এবং পরিবারের সদস্যরা দেখা পর্যন্ত করতে পারেননি। এ ঘটনায় লোকজন তাঁর ভাইকে থানায় অভিযোগ করতে বলেছেন। তাঁর ভাই বলেন, ‘কার বিরুদ্ধে অভিযোগ? উন্মত্ত জনতা? আমরা অতি সাধারণ মানুষ। আমাদের কিছুই করার নেই, প্রতিবাদ জানানো ছাড়া।’

সোমবার বিকেলে যা ঘটেছিল, তা নিয়ে জুবায়েরের এখনো পরিপূর্ণ বুঝে উঠতে পারেননি। জুবায়ের বলেন, ‘আমার হিন্দু বন্ধুরা আছে। এটি আমাকে পীড়া দেয় যে আমার সঙ্গে এ রকম ঘটনা ঘটেছিল।’