চীনের গোপন নথি: প্রতি ৩ জনের ১ জনের শরীরে করোনার লক্ষণ ছিল না

মোট মৃত্যুর সংখ্যার হিসাবে ইতিমধ্যে সার্সকে ছাড়িয়ে গেছে করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
মোট মৃত্যুর সংখ্যার হিসাবে ইতিমধ্যে সার্সকে ছাড়িয়ে গেছে করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

চীনে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের বড় অংশই ছিল নীরব বাহক। তাদের শরীরে করোনায় আক্রান্তের লক্ষণ ছিল না কিংবা অনেক দেরিতে প্রকাশ পেয়েছিল। চীনা সরকারের একটি গোপন নথিকে উদ্ধৃত করে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট বলছে, নীরব বাহকদের সংখ্যা প্রতি তিনজনে একজন হতে পারে।

এই খবরে ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে যে দেশগুলো বিভিন্ন কৌশল নিয়ে কাজ করছে, তাদের উদ্যোগ আরও জটিলতার মুখে পড়ল। এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ২ লাখ ৮০ হাজার মানুষ, মারা গেছে ১৩ হাজারের বেশি।

ফেব্রুয়ারির শেষ ভাগে চীনে ৪৩ হাজার মানুষ কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হয়। তাদের কারও মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের কোনো লক্ষণ শুরুতে ছিল না। ডাটা বলছে, এ পরিস্থিতিকে বলা হচ্ছে অ্যাসিম্পটোমেটিক। তাদের কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছিল, তাদের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল। কিন্তু নিশ্চিত আক্রান্ত বলে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ওই সময়ে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার।
লক্ষণ ছাড়া করোনাভাইরাস কতটা সংক্রামক, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা একমত হতে পারেননি। একজন রোগীর শরীরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণগুলো প্রকাশ পায় সাধারণত পাঁচ দিনের মাথায়। যদিও এই লক্ষণ তিন সপ্তাহ পর্যন্ত সুপ্ত থাকে।

সবচেয়ে বড় বাধাটা হলো, একেক দেশ একেকভাবে করোনায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যার হিসাব করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরীক্ষা করে দেখার পর যাদের ফল পজিটিভ আসছে তাদেরই আক্রান্ত বলে ধরে নিচ্ছে। তাদের শরীরে করোনার লক্ষণ প্রকাশ পাক বা না পাক। দক্ষিণ কোরিয়াও তা–ই করেছে। কিন্তু চীনা সরকার ৭ ফেব্রুয়ারির করোনাভাইরাস নিয়ে দেশটির যে নির্দেশনা, তাতে কিছু পরিবর্তন এনেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইতালিও যাদের শরীরে কোনো লক্ষণ নেই, তাদের পরীক্ষা করছে না। তবে যারা দীর্ঘ সময় রোগীদের চিকিৎসাসেবায় যুক্ত ছিল, তাদের ক্ষেত্রে লক্ষণ না থাকলেও পরীক্ষা করা হয়েছে।

চীনে গত ফেব্রুয়ারিতে ৪৩ হাজার জনের মধ্যে কতজন নীরব বাহক ছিলেন এবং তাঁদের কতজনের মধ্যে পরে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়, তা এখনো পরিষ্কার নয়। সরকার গত শনিবার পর্যন্ত যে ৮১ হাজার ৫৪ জনের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছিল, এই ৪৩ হাজার তাদের বাইরে। কিন্তু মার্চের প্রথম সপ্তাহে রোগীর সংখ্যা কমে যায় অনেক। এর অর্থ ওই ৪৩ হাজারের শরীরে আর রোগ লক্ষণ প্রকাশই পায়নি। অর্থাৎ তারা ভাইরাসটি বহন করলেও অসুস্থতার কোনো লক্ষণ ছিল না।

চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া যারাই আক্রান্তের সংস্পর্শে এসেছে, তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল, তাই তাদের ভাইরাসটির সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করেছে। হংকং এমনকি বিমানবন্দরেও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করে, যাত্রীদের শরীরে রোগের লক্ষণ থাকুক বা না–ই থাকুক। এদিকে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু যাদের শরীরে লক্ষণ দেখা দিয়েছে, তাদের পরীক্ষা করেছে। এই দেশগুলোয় রোগ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে।

‘কোরিয়ায় এই মুহূর্তে লক্ষণ ছাড়া করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। হয়তো ব্যাপকভিত্তিক পরীক্ষা–নিরীক্ষার কারণেই এমনটা ঘটেছে’, দক্ষিণ কোরিয়ার সিডিসির পরিচালক জিয়ং ইউন কাইওং এক সংবাদ সম্মেলনে এ ১৬ মার্চ এ কথা জানান।
ডায়মন্ড প্রিন্সেস জাহাজ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হতে পারে। ইয়োকোহামা জাপানে এ জাহাজটি কয়েক সপ্তাহ কোয়ারেন্টিনে ছিল। এই জাহাজের সব আরোহী ও ক্রুকে পরীক্ষা করা হয়। জাহাজের ৭১২ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়, যদিও ৩৩৪ জনের কোনো লক্ষণ ছিল না। এই তথ্য জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে।

শুরুতে চীনে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
শুরুতে চীনে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিবেদন বলছে, ইতালিতে লক্ষণ প্রকাশ পায়নি, এমন রোগীর সংখ্যা মোট আক্রান্তের ৪৪ শতাংশ।
চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও হংকং নিউমোনিয়ার যে কেসগুলো এসেছিল ২৩ জানুয়ারি উহান লকডাউন হওয়ার আগে, এই কেসগুলোই ছিল সংক্রমণের উৎস। এর হার ছিল ৭৯ শতাংশ। এই রোগীদের মধ্যে করোনাভাইরাসের খুবই মৃদু বা কোনো লক্ষণই ছিল না।

অস্টিনে ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের গবেষণা বলছে যাদের শরীরে কখনো কোনো লক্ষণই দেখা যায়নি, তারা চীনের ৯৩টি শহরের ৪৫০ কেসের ১০ শতাংশের জন্য দায়ী। ইমার্জিং ইনফেকশাস ডিজিজেস নামে জার্নালে এই গবেষণা প্রতিবেদনটি ছাপা হওয়ার অপেক্ষায় আছে।
‘লক্ষণ নেই, এমন রোগীদের মধ্যে বড়দের চেয়ে শিশুদের সংখ্যাই বেশি’, গবেষক নিশিউরা লিখেছেন ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ইনফেকশাস ডিজিজ প্রকাশনায়।