জার্মানিতে করোনায় মৃত্যুর হার যে কারণে কম

জার্মানিতে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ৪৪ হাজার। মৃত ২৬৭। ছবি: রয়টার্স
জার্মানিতে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ৪৪ হাজার। মৃত ২৬৭। ছবি: রয়টার্স

জার্মানিতে অন্যান্য দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুর তুলনায় মৃত্যুর হার কম। নানা পরিসংখ্যান দেখিয়ে জার্মানির জীবাণুবিজ্ঞানীরা এ তথ্য তুলে ধরছেন। এ নিয়ে বিশ্বের অনেকেরই বেশ কৌতূহল।

জার্মানির চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা বিশ্বের অন্যতম সেরা বলে মনে করা হয়। জার্মানির প্রত্যেক নাগরিকের স্বাস্থ্য বিমা থাকা অত্যাবশ্যক। প্রত্যেক চাকরিজীবী নাগরিকের মাসিক বেতন থেকে স্বাস্থ্য বিমার অর্থ বিমা প্রতিষ্ঠানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যায়। যেসব নাগরিক বেকার বা সামাজিক ভাতার ওপর নির্ভরশীল, তাঁদের চিকিৎসাভাতার অর্থ সরকার দিয়ে থাকে।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, জার্মানির চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থার ধাঁচে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেই ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যা ওবামা কেয়ার নামে পরিচিতি পেয়েছিল। তবে দুর্ভাগ্য, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে তা বাতিল করে দেন।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংখ্যা দেশে দেশে লাফিয়ে বাড়ছে। আজ চীনে সর্বাধিক আক্রান্ত, তো কালকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স সর্বত্র গ্রাস করছে করোনার কালো ছোবল।

বিশ্বে চিকিৎসাশাস্ত্রের নানা বিষয়ের বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের করালগ্রাস থেকে রক্ষা পেতে নানা গবেষণা, পদ্ধতি বা পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করছেন। জার্মানির রাজধানী বার্লিনে বুধবার ২৬ মার্চ চার জীবাণুবিজ্ঞানী তাঁদের গবেষণার ফলাফল জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, জার্মানিতে কেন আক্রান্ত ব্যক্তিদের তুলনায় মৃত্যুহার তুলনামূলকভাবে কম।

এই গবেষেকদের ফলাফল নিয়ে বার্লিন চ্যারিটি ও সরকারি পরামর্শদাতা গবেষক ক্রিশ্চিয়ান ড্রস্টেন জানিয়েছেন, ‘মূল কারণটি হলো, আমরা জার্মানিতে দ্রুত করোনাভারাস শনাক্তকরণে বেশ কিছু পথ অবলম্বন করেছি। জার্মানিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ে পরীক্ষাগারগুলোতে বেশ আগে থেকেই দ্রুত ডায়াগনস্টিকস বা লক্ষণ শনাক্ত করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, এই মুহূর্তে জার্মানি প্রতি সপ্তাহে পাঁচ লাখ লোকের করোনাভাইরাসের লক্ষণ শনাক্তকরণের কাজ চলছে। শনাক্তকরণের পর দ্রুত তাঁদের রোগের লক্ষণ অনুযায়ী বাছাই বা বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। এই বিচ্ছিন্নতার কাজ না করলে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি দ্রুত অন্যদের সংক্রমিত করবে।

ক্রিশ্চিয়ান ড্রস্টেন বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ে আমেরিকা, চীন, ইতালি, স্পেন, জার্মানি ও ফ্রান্সে যে বিভীষিকাময় মৃত্যুর হার দেখছি, তা অকল্পনীয়। এই মুহূর্তে চীনকে পেছনে ফেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৮৫ হাজার ৩৭৭, মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ২৯৫। চীনে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৮১ হাজার ৩৪০, মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ২৯২। ইতালিতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৮০ হাজার ৫৮৯, মৃতের সংখ্যা ৮ হাজার ২১৫। ফ্রান্সে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ২৯ হাজার ১৫৫, মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ৬৯৬।

স্পেনে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৫৭ হাজার ৭৮৬, মৃতের সংখ্যা ৪ হাজার ৩৬৫। জার্মানিতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৪৩ হাজার ৯৮৩, মৃতের সংখ্যা ২৬৭। ফ্রান্সে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ২৯ হাজার ১৫৫ মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ৬৯৬।

জার্মানিতে সংক্রমণের তুলনায় এখনো মৃত্যুর হার প্রসঙ্গে বার্লিন চ্যারিটি ও সরকারি পরার্শদাতা গবেষক ক্রিশ্চিয়ান ড্রস্টেন বলেন, ‘আমরা বেশ আগে থেকেই আমাদের পরীক্ষাগারগুলোতে করোনাভারাসের জন্য আলাদা প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। এ ধরনের প্রাক–প্রস্তুতি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত অনেক দেশ গ্রহণ করেনি। শুধু পরীক্ষাগারগুলোতে পরীক্ষা করলেই যে মৃত্যুর হার কমে যাবে, বিষয়টি তা নয়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত পর শুরু হবে মূল প্রক্রিয়া, করোনাভাইরাস রোগীর বয়স ও পারিপার্শ্বিকতা এবং অন্যান্য উপসর্গ দেখে তাঁর চিকিৎসা করা হচ্ছে। এসব কারণে এখনো জার্মানিতে করোনাভারাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুর হার কম।’

বার্লিনে চিকিৎসক–গবেষকদের এই সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁরা জানান, করোনাভারাসের চিকিৎসা শুধু মূল ব্যাপার নয়, এর বাইরে জনসচতেনতা এই সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব ছড়াতে মুখ্য ভূমিকা হিসেবে কাজ করছে।

জার্মানির শিক্ষা ও গবেষণাবিষয়ক মন্ত্রী আনিয়া কার্জিলেক জানিয়েছেন, করোনাভারাস প্রতিরোধে একটি সম্মিলিত টাস্কফোর্স গড়ে তুলতে ১৫ কোটি ইউরো অনুদান দেওয়া হয়েছে। এই সম্মিলিত টাস্কফোর্স এখন করোনাভারাসের বিস্তার রোধে নতুন নতুন গবেষণাসহ প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

প্রাথমিক পরিকল্পনা হিসেবে বিভিন্ন ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলো করোনাভারাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার পদ্ধতি ও ধরন এবং তাদের কার্যক্রম নিয়ে তথ্যবিবরণী তৈরিসহ অভিজ্ঞতা বিনিময় করবেন। এ তথ্যবিবরণী বা ডেটা বিশ্লেষণ করে এই মহামারি রুখতে ব্যবস্থাপনা, ভ্যাকসিন ও কী ধরনের থেরাপি প্রয়োজন, সে বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ক্রিশ্চিয়ান ড্রস্টেনের মতে জনসাধারণের সামাজিক ও সাধারণ জীবনের ওপরে এ মুহূর্তে যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে, একটি উপযুক্ত সময়ে তা ধীরে ধীরে তুলে নেওয়া উচিত। তবে কখন ও কাদের ওপর থেকে ক্রমান্বয়ে নিষেধাজ্ঞাগুলো শিথিল করা হবে, সে বিষয় আগে বিবেচনায় আনতে হবে। তবে বিষয়টি আবার এমন নয় যেন এই ভাইরাসে ঝুঁকিপূর্ণ প্রবীণ নাগরিকদের আলাদা করে রাখলেই করোনাভারাসের প্রাদুর্ভাব হ্রাস পাবে।

জার্মান গবেষকেরা আশা করছেন, জনসচেতনতা, নিষেধাজ্ঞা ও সম্মিলিত চিকিৎসা কার্যক্রম অচিরেই জার্মানিতে করোনাভারাসের প্রাদুর্ভাব হ্রাস করতে সহায়ক হবে।