করোনাভাইরাস: বিশ্ব যেভাবে বদলে যাবে পর্ব-৩

করোনাভাইরাসের এ মহামারির সময়ে পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে চলতি বছরেই নির্বাচনী ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাসের এ মহামারির সময়ে পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে চলতি বছরেই নির্বাচনী ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ছবি: রয়টার্স

সারা বিশ্বে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে নতুন করোনাভাইরাস। আক্রান্তের তালিকায় কোন দেশ নেই, তা খুঁজতে এখন রীতিমতো গলদঘর্ম হতে হবে। মহামারি ঠেকাতে নানা উদ্যোগ চলছে। একই সঙ্গে চলছে মহামারি-পরবর্তী বিশ্বের রূপটি কেমন হবে, তা নিয়ে নানা আলোচনা। এ নিয়ে নানা বিতর্ক হতে পারে, তবে একটা বিষয় নিশ্চিত, ভালো বা মন্দ—যেমনই হোক, এই সংকট অভাবনীয়ভাবে বদলে দেবে সামাজিক বিন্যাস।

মার্কিন পত্রিকা পলিটিকো গত সপ্তাহে বৈশ্বিকভাবে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া নতুন করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট সংকটের প্রেক্ষাপটে ৩০ জনের বেশি বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদের মতামত নিয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্ট এই ব্যক্তিবর্গ সমাজের ওপর চলমান এ সংকটের বহুমুখী প্রভাব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছেন, যা আদতে বার্তার চেয়েও বেশি কিছু।

লিলিয়ান ম্যাসন। ছবি: ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের ওয়েবসাইট।
লিলিয়ান ম্যাসন। ছবি: ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের ওয়েবসাইট।

সরকারি সেবার বৈশিষ্ট্য ফিরে পাচ্ছে
লিলিয়ানা ম্যাসন, ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক; ‘আনসিভিল অ্যাগ্রিমেন্ট: হাউ পলিটিকস বিকেম আওয়ার আইডেনটিটি’ বইয়ের লেখক।

রিগানের যুগ চলে গেছে। সাধারণভাবে মানুষের ধারণা হচ্ছে, সরকার সার্বিকভাবেই খারাপ। এই ধারণা করোনাভাইরাস পরবর্তী সময়ে আর টিকবে না। এই ঘটনাটির মধ্য দিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, একটি সুস্থ সমাজের জন্য কর্মক্ষম ও নিখুঁত সরকার ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘আমি সরকারে লোক, সাহায্য করতে এসেছি’—এই শব্দগুলো এখন আর আতঙ্ক জাগানিয়া নয়। আসলে মানুষ এখন এই কথাগুলোই শোনার জন্য উদ্‌গ্রিব হয়ে আছে। সরকারের হয়ে কাজ করলেই মিলবে দেশপ্রেমিকের মর্যাদা; বলা যায় এ ধারণার পুনর্জন্ম দেখব আমরা।

আরকন ফাং।ছবি: হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট।
আরকন ফাং।ছবি: হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট।

একটি নতুন নাগরিক কেন্দ্রীকরণ
আরকন ফাং, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জন এফ কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্টের সিটিজেনশিপ ও সেলফ-গভর্নমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মানসিক আঘাত একটি শক্তিশালী মার্কিন সরকার ও জাতীয় সংহতি সৃষ্টির ভিত্তি তৈরি করেছিল। ঠিক সেভাবেই করোনাভাইরাস সংকট নাগরিক পর্যায়ে নতুন কেন্দ্রের বীজ বপন করছে। এই ব্যবস্থায় অঞ্চল ও রাষ্ট্রই বিচার, সংহতি ও গণতান্ত্রিক সমস্যার দূরদর্শী সমাধানের কেন্দ্রে থাকবে। অনেক মার্কিনি এমন অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে এখন জাতীয় নেতৃত্বের ব্যর্থতা নিয়ে আক্ষেপ করছেন। পেছন ফিরলে আমরা দেখব যে, কিছু গোষ্ঠী এই সংকট অন্যদের চেয়ে ভালোভাবে মোকাবিলা করছে। অনুসন্ধান করলে দেখতে পাব যে-এই সফলতা সেই সব রাষ্ট্রেই এসেছে, যেখানে সরকার, নাগরিক ও বেসরকারি খাতের নেতারা সামগ্রিক কল্যাণের জন্য আত্মত্যাগের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে একযোগে হয়েছেন।

একটি বিষয় ভেবে দেখতে হবে যে, শুরুর দিকে যখন কোভিড-১৯-এর পরীক্ষা করাটা খুব বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল, তখন ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ভাইরোলজি ল্যাব এই কাজে সিডিসিসহ অন্য সংস্থাগুলোকে ছাড়িয়ে যায়। সামাজিক দূরত্ব মানা, ক্যাম্পাস ও বিভিন্ন স্থান বন্ধ করে বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণদের কাছে সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন গভর্নর, মেয়র, শিক্ষা কর্তৃপক্ষ ও নিয়োগকর্তারাই। আয় হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে ঘরে থাকা, সেলফ কোয়ারেন্টিনে থাকা লাখ লাখ সাধারণ মানুষ পরস্পরকে সহায়তা করেছেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য চিকিৎসা সামগ্রী জোগাড় করা থেকে শুরু করে তাদের প্রতি দায়িত্ব পালনের কাজটি এই সাধারণ মানুষ বা গোষ্ঠীই তাদের নিজস্ব নাগরিক কাঠামোর মাধ্যমে করেছে। করোনাভাইরাস এই শতাব্দীর সবচেয়ে জরুরি মানবিক চ্যালেঞ্জটির সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সামনে আরও অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে। এ সবের মধ্যে থাকতে পারে জলবায়ু পরিবর্তন ও ঐতিহাসিক বৈষম্যের এ যুগকে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির যুগে রূপান্তরের মতো বিষয়। এগুলো সামলেই রাষ্ট্র, শহর ও তার নাগরিকদের সংহতির এক নতুন দৃষ্টান্তের উদ্ভব হতে হবে।

অ্যাস্ট্রা টেইলর। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।
অ্যাস্ট্রা টেইলর। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।

আমাদের সব আইন কাজে আসবে না
অ্যাস্ট্রা টেইলর, চলচ্চিত্র নির্মতা এবং ‘ডেমোক্রেসি মে নট এক্সিস্ট, বাট উই উইল মিস ইট হোয়েন ইটস গন’ বইয়ের লেখক।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আমেরিকা যেভাবে সাড়া দিচ্ছে, তা থেকে একটা সরল সত্য প্রকাশ পেয়েছে। আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এত এত যে নিয়ম-নীতির কথা বলেন, তা কার্যকর করা অসম্ভব ও অবাস্তব। ২০১১ সালে ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলনের (অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট) কর্মীরা যখন শিক্ষা ও চিকিৎসা ঋণ মওকুফের দাবি তুলল, মূলধারার অনেক গণমাধ্যমে তখন অনেকেই বেশ হাসাহাসি করেছিল। কিন্তু এর পরের বছরগুলোতেও আমরা ধারাবাহিকভাবে দাবিটি করে গেছি। বলা হয়েছে, আমাদের এসব দাবি অযৌক্তিক। এখন আমরা জানি যে, যেসব ‘নিয়মের’ আওতায় আমরা বাঁচি, তা-ই বরং অপ্রয়োজনীয়; এগুলোই সমাজকে আরও বেশি ভঙ্গুর ও বৈষম্যপূর্ণ করে তুলেছে।

সব মিলিয়ে উচ্ছেদ এড়ানো যেত এবং গৃহহীনদের সরকারি ভবনে আশ্রয় দেওয়া যেত। বিল দিতে না পারলেও পানি ও বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করলেও চলত। সবেতন ছুটি হতে পারত সব কর্মীরই অধিকার। মর্টগেজের টাকা পরিশোধ করতে দেরি হলেও ব্যবস্থা না নিয়ে অপেক্ষা করা যেত। ঋণগ্রহীতাদের হয়তো ছাড় দিয়ে স্বস্তির ব্যবস্থা করা যেত। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে নেওয়া শিক্ষাঋণের ওপর সুদ এরই মধ্যে স্থগিত করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর নিউইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো অঙ্গরাজ্য সরকার থেকে নেওয়া চিকিৎসা ও শিক্ষাঋণ স্থগিত করেছেন। দীর্ঘ মেয়াদে শিক্ষাঋণ আদায় স্থগিত বা একেবারে মওকুফ করে দেওয়া যায় কিনা তা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানরা।

এটা পরিষ্কার যে এই সংকটের সময় সব আইন প্রয়োগ করা যাবে না। আপনি হয়তো বিস্মিত হয়ে বলবেন, তাহলে এসব আইন আছে কি জন্য। আমি বলব, এটাই সুযোগ। শুধু বিদ্যমান ব্যবস্থা স্থগিত এবং সাময়িক উপশমের জন্য নয়, বরং এসব বিধি-ব্যবস্থা চিরতরে বদলে দেওয়ার এটাই সুযোগ, যাতে লাখ লাখ মানুষকে ভবিষ্যতে যেন আবার দুরবস্থার মধ্যে পড়তে না হয়।

মিশিকো কাকুতানি। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমসের সৌজন্যে।
মিশিকো কাকুতানি। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমসের সৌজন্যে।

প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা বাড়বে
মিশিকো কাকুতানি, নিউইয়র্ক টাইমসের গ্রন্থ-সমালোচনা বিভাগের সাবেক প্রধান এবং বেস্টসেলার ‘দ্য ডেথ অব ট্রুথ’ (২০১৮) বইয়ের লেখক।

করোনাভাইরাসের মহামারির প্রেক্ষাপটে মার্কিনিরা বুঝতে পারবেন—প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে মূল্যবোধ নিয়ে দেশ চালাচ্ছেন, তার বদলে কার্যকর গণতন্ত্র অপরিহার্য, যা কার্যকরভাবে জাতীয় সংকট মোকাবিলায় সক্ষম। করোনার প্রেক্ষাপটে স্পষ্ট হয়েছে যে, যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান জনগণের স্বাস্থ্য, স্বাধীনতা ও জাতীয় নিরাপত্তার দেখভাল করে, সেসব প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক অনুগতদের পরিবর্তে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা উচিত। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত যুক্তিসংগত প্রক্রিয়ায়, যার ভিত্তি হবে বিজ্ঞান, ইতিহাস ও ভূরাজনৈতিক জ্ঞান। কোনোভাবেই এর ভিত হবে না ট্রাম্পের ‘বিকল্প সত্য’, যাকে থমাস পিনচন বলছেন, ‘উন্মত্ততা, বিভ্রম ও নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ বিশৃঙ্খলা।’ ট্রাম্পের ‘আমেরিকা প্রথম’ পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রের বহুপক্ষীয় কূটনীতিতে ফিরে যাওয়া দরকার। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন ও ভাইরাসের মহামারির মতো বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবিলায় শত্রু-মিত্র সবার সঙ্গে সহযোগিতার বিষয়টির গুরুত্ব বোঝা উচিত।

সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের মনে রাখা উচিত, জনগণের আস্থা সরকারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এই আস্থা নির্ভর করে সত্য বলার ওপর। ১৯১৮ সালের ভয়াবহ ফ্লু মহামারিতে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫ কোটি মানুষ মারা যায়। সেই বিপর্যয়ের মূল শিক্ষা হলো—ক্ষমতাসীনদের অবশ্যই জনগণকে আস্থায় রাখতে হয়। আর তার উপায় হলো কোনো কিছু বিকৃত না করা, কারসাজির চেষ্টা না করা।

ক্যাথি ও’নিল। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।
ক্যাথি ও’নিল। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।

রাজনৈতিক বিপ্লব প্রত্যাশা করুন
ক্যাথি ও’নিল, গাণিতিক নিরীক্ষা কোম্পানি ওআরসিএএর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী এবং ‘ওয়েপনস অব ম্যাথ ডেস্ট্রাকশন: হাউ বিগ ডেটা ইনক্রিজেস ইনেকুয়ালিটি অ্যান্ড থ্রেটেনস ডেমোক্রেসি’ বইয়ের লেখক।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পরিণামগুলোর মধ্যে একটি হতে পারে নতুন রাজনৈতিক বিপ্লব—ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব। তবে এবার তা হবে আরও ব্যাপক আকারে এবং ক্ষোভের সঙ্গে। চলমান এই স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা শেষ হলে আমরা দেখতে পাব, ধনী এবং যোগাযোগ ও সম্পদে সুবিধাপ্রাপ্তরা কতটা ভালোভাবে টিকে গেছে; আর দুর্বল, দরিদ্র ও ঐক্যবদ্ধ নয়—এমন গোষ্ঠীগুলো ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। উপরন্তু, আমরা এখন দেখব, কীভাবে রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব—প্রয়োজনকে জরুরি মনে করলে লাখো কোটি ডলারের আর্থিক সহায়তা ও প্রকল্প কীভাবে দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়। এই অসামঞ্জস্য দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে বার্তা দিচ্ছে যে, তাদের প্রয়োজনীয়তাগুলোয় এত দিন শুধু মনোযোগই দেওয়া হয়নি, যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন, তাও ছিল না, যার পরিণতি হবে মারাত্মক।

জো ব্রাদারটন। ছবি: ডেমোক্রেসি লাইভের সৌজন্যে।
জো ব্রাদারটন। ছবি: ডেমোক্রেসি লাইভের সৌজন্যে।

মূলধারায় আসবে ইলেকট্রনিক ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা
জো ব্রাদারটন, ইলেকট্রনিক ব্যালট প্রস্তুতকারী উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ডেমোক্রেসি লাইভ-এর চেয়ারম্যান

কোভিড-১৯ এর অন্যতম ভুক্তভোগীতে পরিণত হবে ভোট দেওয়ার পুরোনো ব্যবস্থা, যেখানে নির্বাচনকেন্দ্রে ভোটারদের সমবেত হওয়াটা আবশ্যকীয়। ফলে অন্যদের সংস্পর্শে থাকার আশঙ্কাও বেশি। আমরা ২০১০ সাল থেকে এই মডেল থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছি। ওই সময় মার্কিন কংগ্রেস একটি আইন পাস করে, যার মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর সদস্য ও বিদেশে থাকা ভোটারেরা ইলেকট্রনিক ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদান করতে পারছেন। কিছু অঙ্গরাজ্য এখন এই সুবিধা চাইছে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও শারীরিক প্রতিবন্ধী ভোটারদের জন্য, যাতে তারা বাড়ি থেকে ভোট দিতে পারে। নির্বাচন কর্মকর্তারা যেখানে মহামারির মধ্যে নিরাপদ ভোট নিশ্চিতে হিমশিম খাচ্ছেন, সেখানে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করাই দীর্ঘ মেয়াদে যুক্তিযুক্ত। যে ব্যবস্থায় নিরাপদ, স্বচ্ছ ও সাশ্রয়ীভাবে সেলফোন বা এ ধরনের বহনযোগ্য ডিভাইসের মাধ্যমে ভোট দেওয়া যাবে। ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কিছু এলাকায় একটি হাইব্রিড মডেল ব্যবহার হতে পারে, যেখানে কাগজের ব্যালটের পাশাপাশি সেলফোনে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। এই বিকল্প আরও ব্যাপকভাবে ব্যবহার হবে বলেই মনে হয়। পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে, কাগজের ব্যালটের পাশাপাশি এখনই এমন প্রমাণিত প্রযুক্তি রয়েছে, যা ঘরে বসে ভোট দেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। এই ব্যবস্থা কোনো ধারণাপ্রসূত নয়; এটি বাস্তবতা, যা প্রায় এক দশক ধরে এক হাজারের বেশি নির্বাচনে বিদেশে অবস্থানরত আমাদের সামরিক বাহিনীর সদস্য ও প্রতিবন্ধী ভোটারেরা ব্যবহার করে আসছেন। এটাই নতুন বাস্তবতা হওয়া উচিত।

লি ড্রুটম্যান। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।
লি ড্রুটম্যান। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।

নির্বাচনের দিন না হয়ে হয়তো হবে নির্বাচনী মাস
লি ড্রুটম্যান, নিউ আমেরিকার জ্যেষ্ঠ ফেলো এবং ‘ব্রেকিং দ্য টু-পার্টি ডুম লুপ: দ্য কেস ফর মাল্টি পার্টি ডেমোক্রেসি ইন আমেরিকা’ বইয়ের রচয়িতা।

করোনাভাইরাসের এই মহামারির কালে আমরা কী করে নির্বাচন করব? আমরা ভোট দেওয়ার পদ্ধতিকে সহজ করে আনতে পারি। যেমন ভোটাররা যখন যেখানে ভোট দিতে চান, সেখানে ভোটের ব্যবস্থা করা। এতে করে নির্বাচনী দিনের ভিড় বা লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে থেকে যে স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে, তা এড়ানো যায়। পরিবর্তন আসতে পারে আগাম ভোট বা ভোট কেন্দ্রে না গিয়ে মেলে ভোট দেওয়ার যে ব্যবস্থা তার প্রয়োগের বিস্তার ঘটিয়ে। এতে করে কার্যত নির্বাচনটা আর দিনে দিনে হবে না, এটি হবে মাসজুড়ে। অর্থাৎ ইলেকশন ডের পরিবর্তে ইলেকশন মান্থ চালু হতে পারে (অথবা কয়েক মাস ধরেও নির্বাচন হতে পারে। এটি নির্ভর করবে নির্বাচনগুলো কতটা বিরতিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং ইলেকশন ডের তারিখ লেখা ব্যালট কত দিন পর্যন্ত গ্রহণ করা হবে তার ওপর।) এই পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট চিন্তাভাবনার প্রয়োজন, যেন প্রত্যেক সম্প্রদায়ের ভোটাধিকার নিশ্চিত হয় এবং জাল ভোট না পড়ে। জনাকীর্ণ নির্বাচনী কেন্দ্রগুলো ঝুঁকিতে থাকা ভোটকর্মীতে (যারা সাধারণত বয়স্ক) ভরা থাকে। এমন পরিস্থিতিতেও নির্বাচন যেন অনুষ্ঠিত হয় সে জন্য নতুন পরিকল্পনা গ্রহণের তীব্র চাপ পড়তে পারে রাষ্ট্রের ওপর। আর একবার নাগরিকেরা এমন অভিজ্ঞতা পেলে, তা সহজে ছেড়ে দিতে চাইবে না। ভোট দেওয়াটা যত সহজ হবে, ভোট পড়ার হারও তত বাড়বে, যা দলীয় আনুগত্যের ধারায় একটি বড় বদল আনবে।

কেভিন আর কোসার। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।
কেভিন আর কোসার। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।

চিঠির মাধ্যমে ভোটই স্বাভাবিক হয়ে উঠবে
কেভিন আর কোসার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান আর স্ট্রিট ইনস্টিটিউটের সহসভাপতি

এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া, কেনটাকি, লুইজিয়ানা, ম্যারিল্যান্ড ও ওহাইও প্রাইমারি স্থগিত করেছে। অন্য অঙ্গরাজ্যগুলোকেও হয়তো এ পথেই হাঁটতে হবে। কিন্তু এই নির্বাচনগুলো অনির্দিষ্টকাল ধরে স্থগিত থাকতে পারে না। দলগুলোকে এই শরতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের আগেই সম্মেলন শেষ করে একজন প্রার্থীকে মনোনীত করতে হবে। বেশ কিছু প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা হয়তো যুক্তরাষ্ট্রকে জুন মাস এমনকি গ্রীষ্মের শেষ অবধি ভোগাতে পারে। এর মানে বেশির ভাগ অঙ্গরাজ্যে নির্বাচনী নীতিতে একটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। সময় কিন্তু বয়ে যাচ্ছে।

আশার কথা, জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যবস্থার মধ্য থেকে একটিকে বেছে নেওয়ার দায় থেকে মুক্তির একটি পরীক্ষিত পদ্ধতি রয়েছে, সেটা হলো চিঠিতে ভোট দেওয়া। দেশের বাইরে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা দশকজুড়েই এভাবে ভোট দিয়ে আসছেন। ওয়াশিংটন, ওরেগন ও ইউটাহের মতো কিছু অঙ্গরাজ্যে এখনই বাসায় বসে ভোট দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তারা ভোটারদের কাছে ব্যালটসহ চিঠি পাঠায়। ফলে কেন্দ্রে গিয়ে বা চিঠির মাধ্যমে ভোট দেওয়ার বিকল্পটি ভোটারদের হাতেই থাকে। দুর্ভাগ্যবশত, বেশির ভাগ অঙ্গরাজ্যেই ব্যক্তিকে নিজেকে ভোট দিতে হয় এবং কেউ চিঠির মাধ্যমে ভোট দিতে চাইলে, তার অনুমতি আগেই নিতে হয়। ভোটাররা এখনই নিবন্ধন কার্ড ও নির্বাচনী নির্দেশনা চিঠিতে পেয়ে থাকেন। তাহলে ব্যালট কেন নয়? নিজে ভোট দিতে গিয়ে যে ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন ভোটারেরা, সে কথা মাথায় রেখে সনাতন সেই পদ্ধতির আধুনিকায়ন জরুরি এবং আমাদেরও উচিত দ্রুতই পরিবর্তনের আশা করা।

ডেল হো। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।
ডেল হো। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।

ঝুঁকি কমাতে চিঠির মাধ্যমে ভোটই বিকল্প
ডেল হো, আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের ভোটাধিকার বিষয়ক প্রকল্পের পরিচালক

বেশির ভাগ মানুষ নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে গিয়ে যেভাবে ভোট দিয়ে আসছেন, তার ওপর কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব অকল্পনীয়। কিন্তু স্বাস্থ্য ও ভোটাধিকার এ দুয়ের মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার বিকল্প দেওয়ার বদলে আরও অনেক পদক্ষেপ নেওয়ার আছে।

প্রথমত, প্রত্যেক ভোটারকে ব্যালটসহ চিঠি পাঠানো যেতে পারে ফিরতি খামসহ। নির্বাচনের তারিখেই পোস্ট করা হয়েছে—এমন চিহ্ন থাকলেই সেগুলো গ্রহণ করতে হবে ও গুনতে হবে। ভোটার যদি কোনো ভুল করে থাকেন, তবে তাঁকে না জানিয়ে ভোট বাতিল করা যাবে না। পাশাপাশি ভুল শোধরানোর সুযোগও তাঁদের দিতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিবন্ধী বা ভাষায় অদক্ষ ব্যক্তি, যাদের ভোট দিতে অন্যের সহায়তা প্রয়োজন বা ডাকযোগে ভোট দেওয়ার সুযোগ যাদের সীমিত, তাদের জন্য কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে রাষ্ট্রকে।

যেসব ভোটার নিজেরা ভোটকেন্দ্রে আসবেন তাঁদের ঝুঁকি কমাতে এবং যে বিপুলসংখ্যক ভোট চিঠিতে পৌঁছাবে সেগুলো দ্রুত ও নির্ভুলভাবে গণনার জন্য নির্বাচনী প্রশাসনকে তরুণ নির্বাচনকর্মী নিয়োগ দিতে হবে। এ কাজের জন্য অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ দেওয়া উচিত। অঙ্গরাজ্যগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে, যেন নির্বাচনী কর্মকর্তারা চিঠিতে পাঠানো ব্যালট নির্বাচনের তারিখের আগেই গণনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান বাধা দূর হয় (১৫টি অঙ্গরাজ্যে এমন নিয়ন্ত্রণ আছে)। মিডিয়ার দায়িত্ব হবে মানুষকে বোঝানো যে, এমন একটা পরিবেশে যখন বিপুলসংখ্যক ভোট চিঠিতে পৌঁছাচ্ছে, তখন বিজয়ীর নাম ঘোষণায় সময় বেশি লাগবে। এমন দেরির সঙ্গে আমরা অভ্যস্ত নই।

যদি কোনো অঙ্গরাজ্য এ সব উপায়ের সবগুলো গ্রহণ করতে না–ও পারে, যতগুলো সম্ভব ততগুলো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। চলমান সংকট এই ধরনের পরিবর্তনের আবশ্যকীয়তার কথা বলছে জোরেশোরে—পরিবর্তনগুলো ঘটবেও। (চলবে)

(অনুবাদ করেছেন: ফারুক হোসেন, শেখ সাবিহা আলম, নাজনীন আখতার, তপতী বর্মন, শুভা জিনিয়া চৌধুরী, ফজলুল কবির, সাইফুল ইসলাম, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, শাকিলা হক, রাজিউল হাসান ও অর্ণব সান্যাল।)