সারা বিশ্বে দেখা মিলছে মানবিক মানুষের

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এই সময়ে এই মানুষেরা সংকট থেকে উত্তরণের আশা দেখাচ্ছেন। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এই সময়ে এই মানুষেরা সংকট থেকে উত্তরণের আশা দেখাচ্ছেন। ছবি: রয়টার্স

নতুন করোনাভাইরাসের এই বিস্তারের সময়ে চারপাশ যেন দুঃসংবাদে ভরে উঠেছে। প্রতিটি মৃত্যু বুকের ওপর ভারী পাথর হয়ে চেপে বসছে। বিশ্বের যে প্রান্তেই মানুষ মারা যাক না কেন, তা ব্যথিত করছে মানুষকে। হঠাৎ করে ঘরবন্দী হয়ে পড়ার এই অভিনব বাস্তবতায় আতঙ্ক ও নিরাশাই কি একমাত্র সত্য হয়ে উঠেছে তবে? না, আছে মানবতা, আছে প্রেম, সহমর্মিতা। মানুষ মানুষকে ভালোবাসছে। এগিয়ে আসছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এই সময়ে এই মানুষেরা সংকট থেকে উত্তরণের আশা দেখাচ্ছেন। দেশে দেশে গড়ে ওঠা এমন কিছু উদ্যোগের কথা এখানে তুলে ধরা হলো—

ইতালির বারান্দায় বারান্দায় আশ্বাসের বাণী
নতুন করোনাভাইরাস চেনা ইতালিকে বদলে দিয়েছে একেবারে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা যখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, তখন আতঙ্কগ্রস্ত মানুষকে আশ্বস্ত করতে শুরু হয় ‘ফ্লাশ মবস’। না কয়েক বছর আগে যেমনটা দেখা গিয়েছিল, তেমন নয়। এই হঠাৎ নেচে-গেয়ে ওঠার বিষয়টি কোনো খোলা রাস্তা বা ভিড়ভাট্টার শপিংমলে হয়নি। বরং ঘরবন্দী মানুষেরা তাদের বারান্দায় এসে নেচে-গেয়ে পাশের মানুষটিকে, প্রতিবেশীকে আশ্বস্ত করেছে ও করছে। বব মার্লের মতো করেই তারা বারবার করে বলছে, ‘ভয় পেয়ো না, খুশি থাকো, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ ইতালির সিসিলি, রোম, নেপলস থেকে শুরু করে সব অবরুদ্ধ শহর ও অঞ্চলেই এই আশ্বাসের বাণী ছড়িয়েছে মানুষেরা। তাদের এই বাণী শুধু ইতালির মানুষকেই নয় ইউটিউবের কল্যাণে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়েছে আশাও।

খাবার পৌঁছাতে দুই তরুণের উদ্যোগ
নিউইয়র্ক নগরীর দুই তরুণ ঘরবন্দী হয়ে পড়া নিম্ন আয়ের মানুষদের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে একটি উদ্যোগ নেন। লিয়াম একিন্ড ও সিমোন পলিকিনো নামের ওই দুই তরুণ তাঁদের এই উদ্যোগের নাম দেন ‘ইনভিজিবল হ্যান্ডস’। মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের এ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হন ১ হাজার ৩০০ জনেরও বেশি স্বেচ্ছাসেবক। তুলনামূলক কম ঝুঁকিতে থাকা লোকেদের নিয়ে গড়ে ওঠা এই স্বেচ্ছাসেবক দল খাবারসহ নিত্যপণ্য পৌঁছে দিচ্ছে বয়স্ক ও বেশি ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের কাছে।

কানাডায় ‘কেয়ারমঙ্গারিং’
কানাডায় প্রচলিত শব্দ জোড় ‘ফিয়ারমঙ্গারিং’-এর বদলে একদল স্বেচ্ছাসেবক নিয়েছেন ‘কেয়ারমঙ্গারিং’ উদ্যোগ। নাম থেকেই বোঝা যায় যে, তাঁরা ভয়ের বদলে ‘যত্নের কারবার’ করতে চান। তাই করছেন। অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে মানুষকে শক্তি ও সাহস জোগানোর পাশাপাশি তাঁরা মানুষের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছেন খাদ্য ও ওষুধ।

লকডাউনে রোস্তোরাঁকর্মীদের পাশে মার্কিন ক্রেতারা
বর্তমানে আক্রান্ত ও মৃত্যু বিচারে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রে। এ অবস্থায় টেক্সাসে লকডাউন ঘোষণা করলে বাধ্যতামূলকভাবে রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ করার বাস্তবতা তৈরি হয়। এ অবস্থায় হিউস্টনের এক রেস্তোরাঁয় এক দম্পতি গিয়ে কিছু খাওয়া দাওয়া করেন। বিল আসে ৯০ ডলার। কিন্তু তাঁরা বিল পরিশোধের পর টিপস হিসেবে দেন ১৯০০ ডলার। ওই বাড়তি অর্থের ওপর রাখা একটি কাগজে লিখে দেন—পরের সপ্তাহগুলোয় কর্মীদের বেতন পরিশোধের জন্য। শুধু টেক্সাসে নয়, একই ঘটনা ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের বহু শহরে। বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় তার নিয়মিত ক্রেতারা গিয়ে কর্মীদের বেতনের জোগান দিয়ে এসেছেন এভাবেই।

অনলাইনে উন্মুক্ত হয়েছে বড় বড় জাদুঘর ও পাঠাগারগুলো
এই দুঃসময়ে ঘরে থাকতে বাধ্য হওয়া মানুষদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বড় বড় জাদুঘর, পাঠাগার, অপেরা হাউস থেকে শুরু করে নানা মহাফেজখানা। ফ্রান্সের লুভ, স্মিথসোনিয়ানসহ বেশ কয়েকটি জাদুঘর অনলাইনে বিনা মূল্যে তাদের সংগ্রহশালা ঘুরে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। নিউইয়র্ক সিনিট মেট্রোপলিটন অপেরাও নিজেদের নানা আয়োজনে বিনা মূল্যে প্রবেশাধিকার দিচ্ছে। খুলে দেওয়া হয়েছে ডিসি পাবলিক লাইব্রেরি; অবশ্যই অনলাইনে। একইভাবে সিডনি অবজারভেটরি দিচ্ছে বিনা খরচায় রাতের আকাশ দেখার সুযোগ।

ইরানের মসজিদগুলোয় তৈরি হচ্ছে মাস্ক
গণজমায়েত অনেক আগেই নিষিদ্ধ হয়েছে ইরানে। ফলে দেশটির মসজিদগুলো আক্ষরিক অর্থেই শূন্য হয়ে পড়েছে। এদিকে জরুরি নিরাপত্তা সরঞ্জাম হিসেবে ফেসমাস্কের সরবরাহ সংকটে তো ভুগছে পুরো বিশ্ব, যার বাইরে নয় ইরানও। এ অবস্থায় নিরাপদ পরিবেশে ফেসমাস্ক তৈরির জন্য এক দল তরুণ উদ্যোগ নেয়। এতে বিভিন্ন মসজিদ কর্তৃপক্ষও সাড়া দেয়। বেশ কয়েকটি মসজিদে এখন মাস্ক সেলাইয়ের কাজ হচ্ছে।

স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশে গ্যারি নেভিল
এই সময়ে সামনের সারিতে থেকে সব মানুষের হয়ে লড়াইটি লড়ছেন চিকিৎসক, নার্সসহ জরুরি স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্ত সবাই। তাঁদের অনেককেই পরিবার ছেড়ে থাকতে হচ্ছে। এই অবস্থায় ব্রিটেনের ফুটবলপ্রেমী ও হোটেল মালিক গ্যারি নেভিল তাঁর মালিকানাধীন দুটি হোটেল স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। কোনো অতিথি নয়, শুধু স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা থাকবেন এ দুই হোটেলে। একই সঙ্গে হোটেল দুটির কর্মীদের যাবতীয় দেখভালের দায়িত্বও নিয়েছেন তিনি।