করোনায় আটকেপড়া ছেলেকে আনতে মায়ের ১৪০০ কিমি স্কুটি-যাত্রা

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কত কিছুই না দেখাল! স্বজনদের লাশ ফেলে পালানোর মতো ঘটনার সাক্ষী তো খোদ বাংলাদেশই। কিন্তু ব্যতিক্রমও কি নেই? অবশ্যই আছে। ভালোবাসা, সম্পর্ক, পরিবারের বন্ধন যে কতটা দৃঢ় হতে পারে, এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও আছে। আর তা দেখালেন ভারতের তেলেঙ্গানার রাজ্যের এক মা, নাম তাঁর রাজিয়া বেগম। ১৪০০ কিলোমিটার স্কুটি চালিয়ে লকডাউনে আটকে পড়া তরুণ ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে এনে রীতিমতো অসাধ্যসাধন করলেন এই মা।

ভারতের সংবাদপত্র ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’–এ রাজিয়া বেগমের তিন দিনের দুঃসাহসিক যাত্রার বিষয়টি উঠে এসেছে। তিনি ৬ এপ্রিল সোমবার সকালে যাত্রা শুরু করেন। ছেলেকে নিয়ে বাসায় ফেরেন ৮ এপ্রিল বুধবার সন্ধ্যায়। সাহসী এই নারীকে স্কুটি চালাতে হয় ২৩ থেকে ২৪ ঘণ্টা। এ হিসাবে ঘণ্টায় তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে ৬০ কিলোমিটারের মতো। 

রাজিয়া বেগমের পরিবার, তাঁর স্কুটি যাত্রা এবং ফিরে আসার পুরো ঘটনাটা জানলে আসলেই বিশেষ কিছু মনে হতে পারে। আর এ জন্যেই এটি খবরের পাতায় উঠে এসেছে। এবার দেখা যাক রাজিয়া বেগমের যাত্রাটা কেমন ছিল—

ভারতের তেলেঙ্গানা প্রদেশের নিজামাবাদের বোধান থেকে অন্ধ্র প্রদেশের নেল্লোর। দূরত্ব ৭০০ কিলোমিটার হবে। আসা-যাওয়া ধরলে ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। ভারতের ট্রেন ব্যবস্থা কিংবা সড়ক বিবেচনায় নিলে তা কিছুই নয়। কিন্তু এটা তো স্বাভাবিক অবস্থার কথা! হ্যাঁ বলা হচ্ছে করোনাভাইরাসকালের কথা। অর্থাৎ লকডাউন যুগের কথা। যেখানে বাস, ট্রেন সবই বন্ধ। ভারতে ২৩ মার্চ থেকে বেশির ভাগ রাজ্যে লকডাউন শুরু হয়। এখনো তা বলবৎ আছে।

রাজিয়া বেগমের বাস নিজামবাদের বোধানে। বয়স ৪৮। একটি সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক তিনি। তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন হায়দরাবাদের নারায়ণা মেডিকেল একাডেমির শিক্ষার্থী। বয়স ১৯ বছর। গত ১২ মার্চ নিজামের সহপাঠী অসুস্থ বাবাকে দেখতে যান। সঙ্গে নিলেন নিজামকে। অবশ্য একটি দরগা জিয়ারতও ছিল নিজামের লক্ষ্য। ফিরতি টিকিট ছিল ২৩ মার্চ। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সবকিছু বদলে দেয়। ট্রেন বাতিল হয়, শুরু হয় লকডাউন। নিজম আটকা পড়েন বন্ধুর বাড়িতে।

রাজিয়া বেগমের স্বামী মারা গেছেন ১৪ বছর আগে। তাঁর ভাবনায়, নেল্লোর করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেশি। ছেলে হয়তো নিজে থেকে করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনুসরণ করতে পারবেন না। এ জন্যে তাঁকে নিজের কাছে ফিরিয়ে আনতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করলেন। পুলিশের সহায়তা চাইলেন। কিন্তু লকডাউনের কড়াকড়ির কারণে বিফল হলেন।
রাজিয়া বলছিলেন, ‘আমি খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম। সে বাসায় থাকলে আমি তাঁকে চোখে চোখে রাখতে পারতাম। এ জন্য পুলিশের পরামর্শে লকডাউন শিথিল হয় কি না, সেই আশায় আমি অপেক্ষা করছিলাম।’

কিন্তু রাজিয়াকে হতাশ করে ৫ এপ্রিল লকডাউন বাড়ানো হয়েছে। এবার রাজিয়া সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি নিজেই যাবেন এবং স্কুটিতে বসিয়ে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। যে কথা, সেই সিদ্ধান্ত। গত সোমবার সকালে নিজের স্কুটিতে রওয়ানা দেন তিনি। কারণ, লকডাউনের মধ্যে কোনো গাড়িচালক রাজি হচ্ছিলেন না। এ ছাড়া গাড়ি নিয়ে গেলে মহাসড়কে পুলিশের বাধার মুখে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। রাজিয়া বলছিলেন, ‘আমি ২৫ বছর ধরে (টু হুইলার) স্কুটি চালাই। তাই স্কুটি চালানো নিয়ে ভীত ছিলাম না। কিন্তু দূরত্বটা ছিল আসলেই বেশি। এই যাত্রার কথা আমি ছেলেকেও জানাইনি। এমনকি আমার ভাইবোনদেরও না। আমি সোমবার সকালে যাত্রা করি এবং হায়দরাবাদের বাইরে গিয়ে ছেলেকে জানাই যে আমি তাকে নিতে আসছি।’

যাত্রাপথে রাজিয়া বেগম যেখানেই পেট্রলপাম্প পেয়েছেন, জ্বালানি ভরে নিয়েছেন। এ ছাড়া একটি ক্যানে সব সময় বাড়তি জ্বালানি রেখেছেন। আর ক্ষুধা নিবারণের জন্য বহন করেন রুটি ও সবজি। রাজিয়া বলছিলেন, ‘আমি পেট্রলপাম্পে ১৫-২০ মিনিট বিরতি দিতাম। পানি পান করতাম। আর স্কুটির ইঞ্জিনটিকে ঠান্ডা হওয়ার সুযোগ দিতাম। ভাগ্য ভালো, স্কুটিটি মাঝপথে বিকল হয়নি।’
রাজিয়া যখন তেলাঙ্গানা অন্ধ প্রদেশ সীমান্তে পৌঁছান, তখন সন্ধ্যা হওয়ার পথে। তাঁর যাত্রা শুরু এবং গন্তব্যের কথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ভড়কে যান। কারণ, মহাসড়কে আর কোনো যানবাহন নেই। নিরাপত্তার কথা বলে ফেরত যেতে বলেন। কিন্তু রাজিয়া তাদের বোঝাতে সক্ষম হন যে তিনি নিরাপদ পথ চলতে পারবেন।

রাজিয়া বলছিলেন, ‘মহাসড়ক ছিল অন্ধকার এবং সুনসান। কিন্তু আমাকে আমার ছেলেকে আনতে যেতেই হবে। রাত ২টার দিকে পুলিশ চেক পয়েন্টে থামায়। তারা আমার উদ্দেশ্যে সম্পর্কে শোনে। সামনের সড়ক খুবই বিপজ্জনক উল্লেখ করে সেখানেই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরামর্শ দেয়। চেকপোস্টের কাছে কিছুক্ষণ আশ্রয় নিয়ে রাত চারটায় রওনা করি। তখন ছেলেকে ফোনে বলি আমি কাছাকাছি চলে এসেছি।’
ছেলে নিজামউদ্দিন মায়ের সম্পর্কে বলেন সকাল সাড়ে ৭টার দিকে তাঁর মা তাঁকে নিতে আসেন, ‘আমাকে নেওয়ার জন্য ২৩-২৪ ঘণ্টা স্কুটি চালিয়েছেন। আমি তাঁকে দেখে বিহ্বল ও আনন্দিত ছিলাম। ওই দিনই বিকেলে আমরা ফিরতি যাত্রা শুরু করি। বুধবার সন্ধ্যায় বোধানে ফিরে আসি। তখনই মা দুই দিন পর ঠিকমতো খাবার গ্রহণ করেন।’

বোধানের সহকারী পুলিশ কমিশনার ভি জয়পাল রেড্ডি বলেন, ‘রাজিয়া খুবই সাহসী নারী। আমি তাঁকে একটা গাড়ি ভাড়া করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। এত টাকা খরচ করতে পারবেন না বলে তিনি স্কুটিতেই যেতে চাইলেন। তিনি তাঁর এই যাত্রার উদ্দেশ্য লিখে একটি কাগজ দেওয়ার অনুরোধ করলেন, যাতে পথে পুলিশ আটকালে দেখাতে পারেন। আসলে তাঁর সাহসেই তিনি আটকে পড়া ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন।’