করোনা মোকাবিলায় যেভাবে সফল দক্ষিণ কোরিয়া

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। একই সঙ্গে বেড়েছে মৃত মানুষের সংখ্যা। কিছু দেশ সময়মতো যথাযথ ও সময়োপযোগী কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে ভাইরাসটির বিস্তার কমিয়ে আনতে সফল হয়েছে। এর মধ্যে একটি দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। লকডাউন ছাড়াই দেশটিতে ব্যাপকভাবে পরীক্ষা, ট্রেসিং, চিকিৎসার নীতি বেশ প্রশংসিত হয়েছে। এর আগের মহামারি সার্স ও মার্স মোকাবিলার অভিজ্ঞতায় কাজে লাগিয়েছে তারা। দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্যের পেছনের গল্প।

জনসেবা সরবরাহে কার্যকর ব্যবস্থা
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্য আলোচনা করতে গিয়ে বেশির ভাগ সময় একটি বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়, তা হলো জনসেবা সরবরাহে খুবই কার্যকর ব্যবস্থা চালু আছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। অবকাঠামোর এই মৌলিক ভিত্তিটি শক্তিশালী না হলে পরীক্ষা, ট্রেস, সেবা দেওয়ার নীতি যে পর্যায়ে ছিল, তা টেকসইভাবে বা ব্যাপকভাবে প্রসারিত করা যেত না। কার্যকর নেতৃত্বও অনেক কিছুই অর্জন করতে পারে না যদি সার্ভিস সিস্টেমে ঘাটতি থাকে।

উন্নত বিমানবন্দর ও মেট্রো-সুবিধা
কোরিয়ার সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর ইনছন। বিশ্বর‍্যাঙ্কিংয়ে ধারাবাহিকভাবে সরকার পরিচালিত এই বিমানবন্দরের অবস্থান ভালো। বর্তমানে এই বিমানবন্দরের বিশাল ডিজিটাল স্ক্রিনে লেখা আছে ‘করোনামুক্ত বিমানবন্দর’। এ জন্য তারা এখন পর্যন্ত কোনো দেশের ওপর প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। তেমনি সিউল মেট্রো সিস্টেম সাশ্রয়ী ভাড়া ও দক্ষতার জন্য বিশ্বখ্যাত। এটি বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি ভূগর্ভস্থ চলাচল-ব্যবস্থার একটি।

বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা ও সরকারি বিমায় ভারসাম্য
দেশটির সরকার-চালিত স্বাস্থ্যসেবা-ব্যবস্থা ২০১৫ সালে ওইসিডি দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ স্থান অর্জন করেছিল। যদিও দক্ষিণ কোরিয়ার বেশির ভাগ হাসপাতাল বেসরকারি, তবে ৯৭ শতাংশ জনগণ বাধ্যতামূলক জাতীয় স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্পের আওতাভুক্ত। বেসরকারি হাসপাতালগুলো এবং সরকারি বিমা-ব্যবস্থার মধ্যে এই ভারসাম্য সর্বজনীন প্রবেশযোগ্যতা ও পর্যাপ্ত সংস্থান নিশ্চিত করেছে এবং এই করোনাভাইরাস সংকটে এর কার্যকারিতা প্রমাণ করেছে। কীভাবে এ অবস্থানে আসতে পারল দেশটি, এটি একটি প্রশ্ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপের অন্য দেশগুলোর মতো কল্যাণ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা দক্ষিণ কোরিয়ার একনায়ক শাসকের অগ্রাধিকার ছিল না।

এশিয়ার অনেক উন্নয়শীল দেশের মতো জোর দেওয়া হয়েছিল শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর। একই সময়ে স্বৈরশাসক জনসাধারণের জন্য অবকাঠামোতে প্রচুর বিনিয়োগ করে। কারণ, কোরিয়ার ক্রমবর্ধমান শিল্পের জন্য একে অপরিহার্য হিসেবে দেখা হচ্ছিল। ১৯৭৭ সালে প্রথম জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা চালু করে দক্ষিণ কোরিয়া, যদিও তা এখনকার মতো কিছুই ছিল না। ১৯৮৭ সালে দেশব্যাপী বিক্ষোভের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলেও রাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক মডেল ও অবকাঠামো-ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়নি। তবে মানুষে আচরণে অনেক পরিবর্তন হয়েছিল। ১৯৯০ থেকে ২০০০ পর্যন্ত অনেক সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয় দক্ষিণ কোরিয়ায়।

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন পার্ক জিউন-হাই। এরপর থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ ওটে। পার্কের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল তিনি তাঁর বন্ধুকে অবৈধভাবে ক্ষমতার নেপথ্যে থেকে দুর্নীতি করার সুযোগ করে দেন। পার্কের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নামে মানুষ। ২০১৬ সালের ৩ ডিসেম্বর ২৩ লাখ মানুষ রাস্তায় অবস্থান নেয়, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ৪ শতাংশ। এর মাধ্যমেই পরে অভিশংসিত হন পার্ক এবং কারাগারে যান।

১৯৯০-এর দশকের পর থেকে কোরিয়ার রাজনীতি এমন একটি সময়ে পৌঁছায়, যখন নাগরিকেরা তাদের নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে সোচ্চার হয় এবং সরকারকে তাদের সুস্থতার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে বাধ্য করে। সবচেয়ে স্পষ্ট হয় জনপরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা ও জ্বালানি সরবরাহের বিষয়টি। গড়পড়তা সবার জন্য এগুলো হলো প্রতিদিনের পরিষেবা ও নাগরিক অধিকার, যার জন্য করদাতারা কর পরিশোধ করে। সরকার যদি এসব দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সে ভোটার হারায় এবং পরের নির্বাচনে হেরে যায়। বলা যায় জনসাধারণের সেবার প্রতি এই সংবেদনশীলতা ও সরকারি জবাবদিহি করার দায়বদ্ধতা ২০ বছর ধরে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারি সেবার উন্নতির পেছনে প্রেরণা জুগিয়েছে। এর ফলে পাবলিক সার্ভিস বেসরকারীকরণও কঠিন হয়ে পড়ে।

মজার বিষয় হলো, বহু বছর ধরে কোরীয়রা বিশ্বাস করত যে বিশ্বমানের পাবলিক সার্ভিস থাকা আরও গণতান্ত্রিক এবং পশ্চিমা হওয়ার সমতুল্য। পশ্চিমে একই সঙ্গে যে ব্যাপক সরকারীকরণ ও আউটসোর্সিং করা হয়েছিল, সে সম্পর্কে তাঁরা অসচেতন ছিলেন। করোনাভাইরাস সংকট ইউরোপকে বিশৃঙ্খলতায় নিমজ্জিত করে এই আদর্শিক চিত্র নষ্ট করে দিয়েছে। তবে বহু বছর ধরে লালিত কোরিয়ান মডেলের সুবিধা পেল দেশটির নাগরিকেরা।