করোনা সংক্রমণে ইউরোপ প্রবাসী বাঙালিরা কেমন আছেন

করোনাভাইরাসে জার্মানিতে একটি বোর্ডে তথ্য প্রদর্শন করা হচ্ছে। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাসে জার্মানিতে একটি বোর্ডে তথ্য প্রদর্শন করা হচ্ছে। ছবি: রয়টার্স

ইউরোপ মহাদেশের উত্তর থেকে মধ্য, দক্ষিণ সর্বত্র এখন করোনাভাইরাসের মরণ থাবা গ্রাস করেছে। দক্ষিণ ইউরোপের দেশ, ইতালি, স্পেনে ও মধ্য ইউরোপের জার্মানিসহ উত্তরের নরওয়ে, সুইডেন পর্যন্ত এই সংক্রামক ব্যাধি ক্রমাগত বিস্তৃত হচ্ছে। গত ছয় সপ্তাহ থেকে ইউরোপে করোনাভাইরাসের বিস্তার আর মৃত্যু ইউরোপের দেশগুলিতে বড় রকমের আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস আক্রান্ত প্রথম দশটি দেশের মধ্য আটটি হলো ইউরোপ মহাদেশের। ইউরোপে প্রথম করোনভাইরাসের আক্রান্তে মৃত্যুর খবরটি প্রকাশ প্রায়, ১৫ ফেব্রুয়ারি প্যারিস থেকে।প্যারিসে বেড়াতে আসা ৮০ বছর বয়সী এক চীনার মৃত্যু ঘটে।

ইউরোপের নানা দেশে দীর্ঘ সময় থেকে বাংলাদেশিদের বাস। এই দুর্যোগময় সময়ে ইউরোপ প্রবাসী বাঙালিরা কেমন আছেন তা জানতে চেয়ে এ প্রতিবেদক ইউরোপের আটটি দেশ গ্রিস, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, হল্যান্ড, বেলজিয়াম ও সুইডেনে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা এই সংকটময় সময়ে জীবন-জীবিকা আর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।

যুক্তরাজ্যে পর এই মুহূর্তে সব থেকে বেশি বাংলাদেশি থাকেন ইতালি ও স্পেনে। ইউরোপে এই মুহূর্তে এই দুটি দেশ সব থেকে বেশি করোনায় আক্রান্ত।উত্তর ইতালির আড্রিয়াটিক সাগর ঘেঁষে ছবির মতো শহর ভেনিস। এই শহরে বসবাস করেন প্রায় ১৫ হাজার বাংলাদেশি। ইতালির এই শহরে দীর্ঘ দিন থেকে বাস করছেন রেহান উদ্দিন দুলাল। ভেনিস শহরেই পর্যটকদের জন্য তাঁর একটি রেস্ট হাউস রয়েছে।

তিনি জানালেন, উত্তর ইতালির বলজানো, ভেনিজা, লমবার্ডি, ব্রেশিয়া, বরগামো, এমিলিয়া, রোমাঙ্গানা, ভেন্টো প্রভৃতি পাশাপাশি অবস্থিত অঞ্চল ও প্রদেশ গুলোতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেশি।বড় শহর ও বেশি ঘনবসতিপূর্ণ মিলান ও রোমে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রকট। ভারী শিল্পের জন্য বিখ্যাত ইতালির বেরগামো প্রদেশটিতেও ঘন বসতির কারণে সংক্রমণের হার বেশি বলে তিনি জানান। এ ছাড়া ১৯ ফেব্রুয়ারি মিলানোর সান সিরো স্টেডিয়ামে ইতালির বেরগামো আটালান্টা ও স্পেনের ভ্যালেনসিয়া দলের চ্যাম্পিয়নস লীগ ফুটবল খেলাতে ৪০ হাজার দর্শক উপস্থিত ছিলেন। যাদের মধ্য আড়াই হাজার দর্শক স্পেন থেকে মিলানে এসেছিলেন, সেখান থেকে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আরও বেড়ে যায় বলে তাঁর ভাষ্য। বিষয়টি স্থানীয় সরকারও স্বীকার করেছেন। ইতালিতে প্রায় ২ লাখ বাংলাদেশি বসবাস করেন। তবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্য আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৬০ জন এবং তাদের মধ্য ৬ জন মারা গেছেন। দেশটিতে লকডাউন জারির পর থেকে বহু প্রবাসী বেকার হয়ে পড়েছেন। দেশটিতে সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে মৃত্যুর সংখ্যা ১৮ হাজার ৮৪৯ জন।

স্পেনের রাজধানী মদ্রিদে দীর্ঘ ১০ বছর থেকে বসবাস করেন বাংলাদেশের রতন শিকদার।তিনি জানালেন এই মাদ্রিদ শহরেই প্রায় ১৫ হাজার বাংলাদেশির বাস। সারা স্পেনে প্রায় ৩০ হাজার। মাদ্রিদ শহরে রতন শিকদারের তিনটি ফলের দোকান রয়েছে। লকডাউনের পর থেকে একটি বন্ধ, আর দুটি খোলা। তিনি বললেন, মাদ্রিদ প্রবাসী অনেক ভ্রাম্যমাণ বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর ব্যবসা বন্ধ রয়েছে। তারা সবাই চিন্তিত কবে নাগাদ আবার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। তবে স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটির বিভিন্ন সংগঠন কষ্টে থাকা প্রবাসীদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে। স্পেন প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্য আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৭০ জন এবং তাদের মধ্য ৩ জন মারা গেছেন। এই মুহূর্তে ইউরোপে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা স্পেনে সব থেকে বেশি। দেশটিতে সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে মৃত্যুর সংখ্যায় বিশ্বের মধ্য তৃতীয়। স্পেনে এই পর্যন্ত মোট ১৬ হাজার ৩৫৩ জন মানুষ মারা গেছেন।

গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে দীর্ঘদিন থেকে বসবাস করেন রেজাউল আজাদ। তিনি জানালেন, সারা গ্রিসে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার বাংলাদেশির বসবাস।তিনি এথেন্সে বা গ্রিসের অন্যান্য শহরে খুব কড়া নিয়মে লকডাউন জারির কথা বললেন। সরকারি ভাবে দেওয়া নম্বর ১৩০৩৩ ফোন করলে আপনাকে জানাবে আপনি কোন অপশনে কথা বলতে চান। অপশনে জরুরি প্রয়োজন, চিকিৎসক, ওষুধের দোকান বা প্রয়োজনীয় সউদা প্রভৃতি বিষয়গুলি রয়েছে। অপশন নম্বর টিপলে ফোন নম্বরে একটি ম্যাসেজ আসবে।তখন আপনি আপনার পরিচয়পত্র ও মোবাইল ফোনে আসা ম্যাসেজ নিয়ে বাইরে যেতে পারবেন। বাইরে প্রতিনিয়ত পুলিশ সবাইকে চেক করছেন। মোবাইল ফোনে বাইরে বের হওয়ার অনুমতি পত্র না থাকলে পুলিশ ১৫০ ইউরো বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৫ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। গ্রিস অত্যন্ত কড়াকড়ি লকডাউনের কারণে আক্রান্তের সংখ্যাও কম এবং এই পর্যন্ত মারা গেছেন ৯২ জন। এখন পর্যন্ত গ্রিসে কোনো প্রবাসী বাংলাদেশির আক্রান্তের বা মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।

প্যারিসে দীর্ঘদিন থেকে বসবাস করেন শরীফ ভুইয়া। চাকরি করেন এয়ার ফ্রান্সে। তাঁর স্ত্রী মরক্কো বংশোদ্ভূত ফরাসি হাফিদা একটি ব্যাংকে চাকরি করেন। প্রতিবেশী জোয়ানা নামের এক পর্তুগিজ নারীকে হাসপাতালে পাঠানোর জন্য সহযোগিতা করতে গিয়ে উভয়েই করোনাভারাসে আক্রান্ত হন। শরীফ ও হাফিদা দুই সপ্তাহ থেকে ঘরেই আছেন। চিকিৎসকেরা বলেছেন উভয়ের সংক্রমণ এখন ভালোর দিকে।শরীফ ভুইয়া জানালেন, এই সময় পর্যটকদের কোলাহল প্যারিস শহর থাকে জীবন্ত। কিন্তু এখন সেই শহর মৃত নগরে পরিণত হয়েছে।প্যারিস শহরেও কড়া লকডাউন জারি রয়েছে। বাইরে বের হলে একটি ওয়েব সাইট থেকে ফর্মুলা প্রিন্ট করে, কোনো নির্দিষ্ট কাজে বের হচ্ছেন, নাম, ঠিকানা, জন্ম তারিখ প্রভৃতি উল্লেখ করতে হবে বের হতে হবে। প্রিন্ট করবার সুযোগ না রইলে তা কাগজে হাতে লিখে বের হতে হবে। ফ্রান্সে আনুমানিক প্রায় ৪০ হাজার বাংলাদেশি আছেন বলে ধারণা করা হয়। এদের মধ্য অর্ধেকের বসবাস প্যারিস শহর ও সংলগ্ন এলাকাগুলোতে। ফ্রান্সে কিছু প্রবাসী বাংলাদেশি আক্রান্ত হলেও কেউ মারা যাননি।

ফ্রান্স এই মুহূর্তে করোনাভারাসে আক্রান্ত তৃতীয় ইউরোপীয় দেশ। এই পর্যন্ত দেশটিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৩ হাজার ১৯৭ জন।

সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে দীর্ঘদিন থেকে বসবাস করছেন বাংলাদেশের মারুফ আনোয়ার। পেশায় একজন আইটি সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার। জেনেভাতে লকডাউন শুরু হওয়ার পর হোম অফিস করছেন। জেনেভা শহরে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অফিস থাকায় এখানে নানা দেশের মানুষের বাস। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে জেনেভা শহরটি তিনদিক থেকে ফ্রান্সের সীমান্ত দিয়ে ঘেরা। প্রতিদিন এই আন্তর্জাতিক শহরটিতে ফ্রান্স থেকে প্রচুর মানুষ কাজ করতে আসেন। আবার জেনেভা থেকে ফ্রান্স সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অনেকেই ফ্রান্সে সুলভে বাজার করতে যান। আর এসব কারণে সুইজারল্যান্ডের অন্য শহরগুলোর তুলনায় জেনেভাতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সংখ্যা বেশি। এই শহরে প্রায় ৪০০ বাংলাদেশি বসবাস করেন।বেশ কিছু বাংলাদেশি জুরিখ শহরেও বসবাস করেন।এদের মধ্য জেনেভাতে দুজন ও জুরিখ শহরে মোট চারজন বাংলাদেশি রয়েছেন। জেনেভাতে একজন বাংলাদেশি এখনো হাসপাতালে রয়েছেন।

হল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডাম শহরের উপকণ্ঠে সানডাম এলাকায় বসবাস করেন বাংলাদেশের ডেভিড রহমান। তিনি আমস্টারডামে একটি মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ উপদেষ্টা হিসেবে চাকরি করছেন। দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ঘরে বসে হোম অফিস করছেন। হল্যান্ডে লকডাউন ব্যবস্থা শিথিল আকারে হচ্ছে। সেখানকার মানুষ ইচ্ছায় নিজ দায়িত্ব থেকে প্রয়োজন ছাড়া ঘর থকে বের হচ্ছেন না। আমস্টারডাম শহর এই সময় পর্যটকদের ভিড়ে পরিপূর্ণ রইলেও এখন সবকিছু ফাঁকা। শহরের বিখ্যাত আমস্টাল নদীর তীর দিয়ে যে পর্যটক বন্যা বা অসংখ্য সাইকেল চালকদের পদচারণায় মুখরিত থাকত তা এখন থেমে গেছে। দেশটিতে এখনো পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশি আক্রান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন ডেভিড রহমান।

বেলজিয়ামের এন্টর্প শহরে বসবাস করেন বাংলাদেশের সোহেল পারভেজ।তিনি জানিয়েছেন বেলজিয়ামে প্রায় ২০ হাজার মানুষ বসবাস করেন। পেশায় ব্যবসায়ী সোহেল পারভেজ লকডাউনের কারণে ঘরেই অবস্থান করছেন। তিনি জানালেন বেলজিয়ামের টেলিভিশনে সারা দিন বিভিন্ন বয়সী মানুষের জন্য করোনা প্রতিরোধে সচেতনমূলক অনুষ্ঠান দেখানো হচ্ছে।তবে বেশির ভাগ মানুষ নিজ দায়িত্বের কথা ভেবে বাইরে অকারণে বের হচ্ছেন না। তিনি জানিয়েছেন এই পর্যন্ত বেলজিয়ামে কোনো প্রবাসী বাংলাদেশি আক্রান্ত হয়নি বা মারা যাননি।

উত্তর ইউরোপের দেশ সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে দীর্ঘদিন থেকে বসবাস করছেন তসলিমা মুন।দীর্ঘদিন সরকারি চাকরি করলেও এখন স্থানীয় সামাজিক গণতন্ত্রী দলের রাজনীতির সঙ্গে নানা কর্মসূচিতে ব্যস্ত থাকেন। তিনি জানালেন, ইউরোপে দেশে দেশে লকডাউন ব্যবস্থা চালু হলেও সুইডেন হলো ব্যতিক্রম। সেখানে নানা বিষয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পরামর্শ দিয়ে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। সেখানে কোনো লকডাউন বিধি জারি করা হয়নি। সুইডেনে বাংলাদেশিদের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার, এদের মধ্য বেশির ভাগ মানুষ রাজধানী স্টকহোমে ও উপসালা শহরে বসবাস করেন। তবে এখনো পর্যন্ত সেখানে ১২ জন প্রবাসী করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হলেও তারা এখন সুস্থ হওয়ার পথে। তসলিমা মুন বলেন স্টকহোম শহরের কেন্দ্রে এই মুহূর্তে চেরি ফুলের জন্য বিখ্যাত কনগসগার্টেন এলাকায় দর্শনার্থীদের ভিড় না করবার জন্য শহর কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দিয়েছেন।

সারা ইউরোপে এই মুহূর্তে চমৎকার রোদের আবহাওয়া ও ইস্টারের ছুটি উপলক্ষে যেন মানুষজন ঘরের বাইরে না বের হয় সেই বিষয়ে বিশেষ সতর্ক করা হয়েছে।নানা জায়গায় পুলিশ টহল বেড়েছে।