করোনা-আক্রান্তদের ৮০ শতাংশ ইউরোপ-আমেরিকায়

করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এখন যুক্তরাষ্ট্রে। ছবি: রয়টার্স
করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এখন যুক্তরাষ্ট্রে। ছবি: রয়টার্স

এখনো ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো চষে বেড়াচ্ছে করোনাভাইরাস। করোনা–আক্রান্ত ২০ লাখের মধ্যে ১৬ লাখ মানুষ এই অঞ্চলের। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই আছেন আক্রান্তের প্রায় ৩১ শতাংশ মানুষ। তবে শীর্ষে থাকা দেশগুলোর কয়েকটিতে করোনা–আক্রান্তের হার কয়েক দিন কমে আবার বাড়তে শুরু করেছে। এ ছাড়া ইউরোপের অন্য দেশগুলোতেও হার বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে বাড়তে শুরু করেছে দক্ষিণ এশিয়ায়।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় বলছে, বিশ্বজুড়ে ১৮৫টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস। এতে ২০ লাখ ৬৪ হাজার ৬৯৫ জনের শরীরে নতুন করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। একই সময়ে মারা গেছেন ১ লাখ ৩৭ হাজারের বেশি মানুষ। ওই সময় পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে করোনায় আক্রান্ত হওয়া রোগীদের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে প্রথম আলো।

ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনে শুরু হয় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। এরপর এটি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ৬৭ দিনের মাথায় এক লাখ লোকের করোনা শনাক্ত হয়। ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর মার্চের শেষ দিকে আক্রান্তের হার বাড়তে শুরু করে। তিন মাসের মাথায় ৩১ মার্চ গিয়ে ৮ লাখ ছাড়ায় করোনা শনাক্তের সংখ্যা। আর এপ্রিলের ১৫ দিনেই করোনা শনাক্ত হয়েছে প্রায় ১২ লাখ।

প্রথম আলোর বিশ্লেষণ বলছে, প্রথম ১০ লাখ পর্যন্ত ৫২ শতাংশ রোগী ছিল ইউরোপের। ২০ লাখ পার হওয়ার পর এটি কমে দাঁড়িয়েছে ৪৬ শতাংশে। এর মধ্যে বেড়ে গেছে উত্তর আমেরিকায়। এই অঞ্চলে ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে রোগীর সংখ্যা। এ দুই মহাদেশ মিলিয়েই রোগী আছে ৭৯ শতাংশের বেশি। এশিয়ায় আক্রান্তের হার আগের চেয়ে কমেছে। ২০ থেকে এটি ১৬ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বাড়তে শুরু করেছে। প্রথম ১০ লাখে দক্ষিণ এশিয়ায় রোগী ছিল ১ শতাংশের অর্ধেকের কম। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে আক্রান্ত বেড়ে যাওয়ায় এখন এটি ১ শতাংশ পার করেছে। তবে সবচেয়ে উন্নতি হয়েছে ওশেনিয়া বা অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে।

আক্রান্ত শীর্ষ দেশগুলোয় করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সব দেশেই এক থেকে দেড় মাস পরে বড় ধরনের উত্থান ঘটেছে করোনার। ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র, ২৯ জানুয়ারি ইতালি, ৩০ জানুয়ারি স্পেন, ২৬ জানুয়ারি জার্মানি ও ২৩ জানুয়ারি ফ্রান্সে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। তবে দেশগুলোয় করোনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে মার্চে। যুক্তরাষ্ট্র ৬ লাখ ছাড়িয়েছে। ইতালি, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্সও লাখের ঘর পার করেছে। এ দেশগুলোতে এখন শনাক্তের হার কমছে। তবে লাখ ছুঁই ছুঁই যুক্তরাজ্যে এখনো বাড়ছে আক্রান্তের হার।

প্রায় একই সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় আঘাত হানে করোনা। ২৩ জানুয়ারি প্রথম করোনা-আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করে নেপাল। গত বুধবার পর্যন্ত দেশটিতে আক্রান্ত হয়েছেন মাত্র ১৬ জন। ২৬ জানুয়ারি করোনা শনাক্ত হয় শ্রীলঙ্কায়। এখন সেখানে রোগীর সংখ্যা ২৩৮। ২৯ জানুয়ারি ভারত, ২৩ ফেব্রুয়ারি আফগানিস্তান, ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান, ৫ মার্চ ভুটান, ৬ মার্চ মালদ্বীপ ও সর্বশেষ ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়।

মার্কিন প্রশাসন একদিকে মুখে মুখে আশ্বস্ত করেছে, অন্যদিকে রোগ পরীক্ষা ও লোকজনকে কোয়ারেন্টিন-আইসোলেশনের পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেয়নি। ছবি: রয়টার্স
মার্কিন প্রশাসন একদিকে মুখে মুখে আশ্বস্ত করেছে, অন্যদিকে রোগ পরীক্ষা ও লোকজনকে কোয়ারেন্টিন-আইসোলেশনের পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেয়নি। ছবি: রয়টার্স

করোনা শনাক্তের শুরুতেই লকডাউন (অবরুদ্ধ) ঘোষণা করে নেপাল ও ভুটান। এর ফল পেয়েছে দেশ দুটি। ভুটানে আক্রান্ত হয়েছেন মাত্র পাঁচজন। একটু দেরিতে হলেও লকডাউন ঘোষণা করে অনেকটা প্রতিরোধ করেছে মালদ্বীপ। দেশটিতে শনাক্ত হয়েছেন ২৩ জন। এ তিনটি দেশে করোনা–আক্রান্ত ব্যক্তিদের কেউ মারা যাননি।

তবে ভাইরাস প্রতিরোধের কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে আলোচিত লকডাউনের মতো সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করায় কিছুটা বিপাকে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলো। এ কারণেই পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশে সংক্রমিত হয়েছেন রোগীরা। গতকাল পর্যন্ত ভারতে ১২ হাজার ৪৫৬, পাকিস্তানে ৬ হাজার ৫০৫, আফগানিস্তানে ৭৮৪ ও বাংলাদেশে ১ হাজার ৫৭২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে কিছুদিন ধরে সবচেয়ে বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশে।

বাড়া-কমার মধ্যেই আছে শীর্ষ ১০ দেশ

জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির তথ্য বলছে, মাত্র ১০টি দেশে আছে ৭৮ শতাংশ করোনা রোগী। এর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, চীন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইরান, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক ও বেলজিয়াম। প্রথম ১০ লাখ রোগীর মধ্যে শীর্ষ দশে সুইজারল্যান্ড থাকলেও দেশটি বেরিয়ে গেছে এখন। তাদের বদলে শীর্ষ ১০ আক্রান্তের তালিকায় ঢুকেছে বেলজিয়াম। গতকাল দেখা যায়, শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে ইরান ছাড়া সবার রোগী বেড়েছে আগের দিনের তুলনায়। যদিও চীনে আক্রান্ত খুব বেশি নয়। প্রথম দফায় নিয়ন্ত্রণ করা চীনে এখন দেশের বাইরে থেকে নতুন করে কিছু লোক আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে শীর্ষ দেশগুলোতে গতকালের আগে টানা চার দিন নতুন শনাক্তের হার কম ছিল।

শিগগিরই ইউরোপ ছাড়ছে না করোনা

ইউরোপের মোট ৪৬টি দেশে করোনা ছড়িয়েছে। এগুলোর মধ্যে করোনা–আক্রান্ত শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে আছে ১২টি। সবচেয়ে বেশি করোনা শনাক্ত হয়েছে স্পেনে। গতকাল পর্যন্ত পাওয়া গেছে ১ লাখ ৮০ হাজার ৬৫৯ জন। শীর্ষ ১০–এ থাকা দেশগুলো ছাড়াও রাশিয়া, সুইডেন, আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল, সার্বিয়া, পোল্যান্ড, ডেনমার্কে নতুন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। শীতপ্রধান অঞ্চল হিসেবে পরিচিত ইউরোপের দেশগুলো থেকে তাই শিগগিরই করোনা মুক্তির আভাস মিলছে না। এখন পর্যন্ত ৯ লাখ ৫৯ হাজার আক্রান্ত হওয়ায় ইউরোপে মারা গেছেন প্রায় ৮৮ হাজার মানুষ।

জীবাণুনাশক স্প্রে করছেন এক কর্মী। করোনা মহামারিতে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইতালি। ছবি: রয়টার্স
জীবাণুনাশক স্প্রে করছেন এক কর্মী। করোনা মহামারিতে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইতালি। ছবি: রয়টার্স

সব ছাপিয়ে শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র

উত্তর আমেরিকায় করোনা শনাক্ত হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৮৪ হাজার। এর মধ্যে ৬ লাখ ৪০ হাজার রোগী শুধু যুক্তরাষ্ট্রে। আর কানাডায় আছে ২৮ হাজারের বেশি। এই দুটি দেশ বাদ দিলে এই অঞ্চলের ২২টি দেশের মধ্যে মেক্সিকো, পানামা ও ডমিনিকান রিপাবলিক ছাড়া আর কোনো দেশে করোনা শনাক্তের সংখ্যা হাজার পার হয়নি। শুধু আক্রান্তের দিক থেকেই নয়, মৃত্যুর দিক থেকেও সবার ওপরে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে গতকাল পর্যন্ত মারা গেছেন প্রায় ২৭ হাজার মানুষ।

তবে এমআইটির গবেষণা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরের দিকের রাজ্যগুলোর তাপমাত্রা কম এবং সেখানে সংক্রমণের হার অপেক্ষাকৃত উষ্ণ দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর তুলনায় বেশি। তাই ইতিমধ্যেই কিছু রাজ্যের লকডাউন খুলে দিতে শুরু করেছে দেশটির সরকার। দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছেন, করোনা প্রাদুর্ভাবের সর্বোচ্চ পর্যায় পার করে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র।

আফ্রিকায় তেমন ছড়াচ্ছে না করোনা

আফ্রিকা মহাদেশের ৫০টি দেশে ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস। গতকাল পর্যন্ত নিশ্চিত রোগী পাওয়া গেছে ৬ হাজার ৩৫৮ জন। এর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় এককভাবে আছেন ১৭ হাজার ১৩৯ জন। বিশ্বজুড়ে চিহ্নিত রোগীর মাত্র ১ শতাংশ আছে এই মহাদেশে। এখানে নতুন নতুন দেশ যুক্ত হলেও করোনা শনাক্তের হার খুবই কম। দক্ষিণ আফ্রিকা, মিসর, মরক্কো, আলজেরিয়া এবং চারটি দেশে তা দুই হাজার ছাড়িয়েছে। বাকি কোনো দেশ এক হাজার পার করেনি। অধিকাংশ দেশে আক্রান্তের হার পঞ্চাশেও পৌঁছায়নি। দক্ষিণ আফ্রিকা ইতিমধ্যেই সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছে।

ইউরোপে ইতালির পর সবচেয়ে বেশি ভুগছে স্পেন। রয়টার্স ফাইল ছবি
ইউরোপে ইতালির পর সবচেয়ে বেশি ভুগছে স্পেন। রয়টার্স ফাইল ছবি

দক্ষিণ আমেরিকায় বাড়ছে ব্রাজিলে

করোনা শনাক্ত বাড়তে শুরু করেছে দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশে। বিশ্বের ৩ শতাংশ রোগী আছে এই অঞ্চলে। যদিও প্রথম ১০ লাখের মধ্যে ছিল ২ শতাংশ। এই অঞ্চলের ১৫টি দেশে ছড়িয়েছে করোনা, এগুলোর মধ্যে ৯টি দেশে নিয়ন্ত্রণেই আছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্রাজিলে। দেশটিতে ইতিমধ্যেই আক্রান্ত ছাড়িয়েছে ২৮ হাজার। এ ছাড়া চিলি, পেরু, ইকুয়েডরেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ভাইরাসটির সংক্রমণ।

এশিয়ায় কমেছে আক্রান্তের হার

ভাইরাসটির জন্ম এশিয়ার চীনে। তবে এই অঞ্চলে আক্রান্তের হার কমে এসেছে। প্রথম ১০ লাখে এশিয়ায় রোগী ছিল ২০ শতাংশ। ২০ লাখ পার হওয়ার পর এটি ১৬ শতাংশে নেমে এসেছে। চীন সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারায় এটি হয়েছে। এর আগে ২০ শতাংশের মধ্যে চীনের রোগী ছিল ৮ শতাংশ। এখন এটি কমে ৪ শতাংশে নেমে এসেছে।

চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইসরায়েলসহ অধিকাংশ দেশ ভাইরাসের সংক্রমণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। শঙ্কা তৈরি করছে নতুন করে বাড়তে থাকা কয়েকটি দেশ। এগুলোর মধ্যে এশিয়ায় এখন সবচেয়ে বেশি নতুন রোগী ইরান ও তুরস্কে। এর বাইরে বড় ঝুঁকি তৈরি করছে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। তিনটি দেশেই বাড়ছে আক্রান্তের হার।