এক সপ্তাহে নেই হয়ে গেল ৫০ হাজার মানুষ

করোনায় আক্রান্ত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। ১১ জানুয়ারি করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘোষণা দেয় চীন। ভাইরাসটি ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়তে থাকে। ১৯ মার্চ প্রথম এক দিনে এক হাজার ছাড়ায় মৃত্যু। ওই দিনে মারা যায় ১ হাজার ৭৯ জন। এপ্রিলে এসে ভয়াবহ রূপ নেয় করোনা। ২ এপ্রিল প্রথম এক দিনে ৫ হাজার ছাড়ায় মৃত্যু। আর ১০ এপ্রিল ছাড়িয়ে যায় ১০ হাজার। এরপর একটু কমলেও এপ্রিলে গড়ে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ৬ হাজারের বেশি মানুষ।

যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় বলছে, বিশ্বজুড়ে ১৮৫টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস। ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত ২২ লাখ ছাড়িয়েছে করোনাভাইরাস শনাক্ত মানুষের সংখ্যা। একই সময়ে মারা গেছে দেড় লাখের বেশি মানুষ (রাত ২টা পর্যন্ত ১,৫১,০০৬ জন)।

করোনায় মৃত্যুর তথ্য বলছে, প্রথম মৃত্যুর পর ৫০ হাজার ছাড়াতে সময় লেগেছে ৮২ দিন। আর এর পরের ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু হতে সময় লেগেছে মাত্র ৮ দিন। এক দিন কমে পরের সাত দিনেই মারা গেছে আরও ৫০ হাজার। মাত্র এক সপ্তাহে পৃথিবী থেকে নেই হয়ে গেল ৫০ হাজার মানুষ। ১১ জানুয়ারি প্রথম মৃত্যুর পর ২ এপ্রিল ৫০ হাজার ছাড়ায় বরোনায় মুত্যু। এরপর ১০ এপ্রিল এটি ছাড়িয়ে যায় ১ লাখ। আর ১৭ এপ্রিল এসে ১ লাখ ৫১ হাজার ৬ জন।

এখনো ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো চষে বেড়াচ্ছে করোনাভাইরাস। করোনায় আক্রান্ত ৮০ শতাংশ মানুষ ইউরোপ–আমেরিকার। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই আছে আক্রান্তের প্রায় ৩১ শতাংশ মানুষ। মৃত্যুর দিকে থেকও শীর্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে এখন পর্যন্ত মারা গেছে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে ৭টি ইউরোপের। আর বাকি দুটি দেশ এশিয়ার। শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে ইতালিতে ২২ হাজার ৭৪৫, স্পেনে ১৯ হাজার ৬১৩, ফ্রান্সে ১৮ হাজার ৮৬১, যুক্তরাজ্যে ১৪ হাজার ৫৭৬, বেলজিয়ামে ৫ হাজার ১৬৩, ইরানে ৪ হাজার ৯৫৮, চীনে ৪ হাজার ১৯৩, জার্মানিতে ৪ হাজার ১৯৩ ও নেদার‍ল্যান্ডসে মারা গেছে ৩ হাজার ৪৫৯ জন। এর মধ্যে চীন নতুন করে মৃত্যুর তথ্য সংশোধন করেছে। এতে আগের চেয়ে ৪৬ শতাংশ বেড়েছে। এরপরও চীনের অবস্থান অষ্টম।

তবে মৃত্যুর হারের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে বেলজিয়াম। দেশটিতে আক্রান্তের ১৪ শতাংশ মানুষ মারা গেছে। দেশটিতে আক্রান্ত হয়েছে ৩৬ হাজার। এর মধ্যে মারা গেছে ৫ হাজারের বেশি মানুষ। যুক্তরাজ্য ও ইতালিতে ১৩ শতাংশ, ফ্রান্সে ১২ শতাংশ, নেদারল্যান্ডসে ১১ শতাংশ ও স্পেনে প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ মানুষ মারা গেছে। তবে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে আছে জার্মানি। আক্রান্তের দিক থেকে দেশটি পাঁচ নম্বরে থাকলেও মৃত্যুর হারের দিকে থেকে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে দেশটির অবস্থান দশম। ১ লাখ ৩৮ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হলেও দেশটিতে মৃতের সংখ্যা বাড়েনি। চীনে করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই দেশটি করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রস্তত করে রেখেছিল। তাই চিকিৎসা দিতে তেমন বেগ পেতে হয়নি দেশটিকে। দেশটিতে মৃত্যুুর হার ৩ শতাংশের কম।

করোনায় আক্রান্তের শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত মৃত্যু হার কমিয়ে রাখতে পেরেছে। প্রায় ৭ লাখ করোনা শনাক্ত রোগীর মধ্যে মারা গেছে ৫ শতাংশের মতো। তবে দেশটিতে প্রতিদিনই মৃত্যু বাড়ছে। সুস্থ হয়েছে মাত্র ৫৬ হাজারের বেশি মানুষ। ৬ লাখের বেশি করোনা আক্রান্ত এখনো চিকিৎসাধীন। এ ছাড়া চীনে মারা গেছে ৪ শতাংশ আর ইরানে ৬ শতাংশের কিছু বেশি।

ডিসম্বেরের শেষ দিকে চীনে শুরু হয় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। এরপর এটি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ৬৭ দিনের মাথায় ১ লাখ লোকের করোনা শনাক্ত হয়। ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর মার্চের শেষদিকে আক্রান্তের হার বাড়তে শুরু করে। তিন মাসের মাথায় ৩১ মার্চ গিয়ে ৮ লাখ ছাড়ায় করোনা শনাক্তের সংখ্যা। আর এপ্রিলের ১৭ দিনেই করোনা শনাক্ত হয়েছে প্রায় ১৪ লাখ।

প্রথম আলোর বিশ্লেষণ বলছে, ৪৬ শতাংশ রোগী ইউরোপের। উত্তর আমেরিকায় ৩৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে রোগীর সংখ্যা। এ দুই মহাদেশ মিলিয়েই রোগী আছে ৭৯ শতাংশের বেশি। এশিয়ায় আক্রান্তের হার কমে ১৬ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বাড়তে শুরু করেছে। প্রথম ১০ লাখে দক্ষিণ এশিয়ায় রোগী ছিল ১ শতাংশের অর্ধেকের কম। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে আক্রান্ত বেড়ে যাওয়ায় এখন এটি ১ শতাংশ পার করেছে। তবে সবচেয়ে উন্নতি হয়েছে ওশেনিয়া বা অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে।

আক্রান্ত শীর্ষ দেশগুলোয় করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সব দেশেই এক থেকে দেড় মাস পরে বড় ধরনের উত্থান ঘটেছে করোনার। ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র, ২৯ জানুয়ারি ইতালি, ৩০ জানুয়ারি স্পেন, ২৬ জানুয়ারি জার্মানি ও ২৩ জানুয়ারি ফ্রান্সে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। তবে দেশগুলোয় করোনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে মার্চে। যুক্তরাষ্ট্র ৬ লাখ ছাড়িয়েছে। ইতালি, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্সও লাখের ঘর পার করেছে। এ দেশগুলোতে এখন শনাক্তের হার কমছে। তবে লাখ ছুঁই ছুঁই যুক্তরাজ্যে এখনো বাড়ছে আক্রান্তের হার।

প্রায় একই সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় আঘাত হানে করোনা। ২৩ জানুয়ারি প্রথম করোনা-আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করে নেপাল। গত বুধবার পর্যন্ত দেশটিতে আক্রান্ত হয়েছে মাত্র ১৬ জন। ২৬ জানুয়ারি করোনা শনাক্ত হয় শ্রীলঙ্কায়। এখন সেখানে রোগীর সংখ্যা ২৩৮। ২৯ জানুয়ারি ভারত, ২৩ ফেব্রুয়ারি আফগানিস্তান, ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান, ৫ মার্চ ভুটান, ৬ মার্চ মালদ্বীপ ও সর্বশেষ ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়।

করোনা শনাক্তের শুরুতেই লকডাউন (অবরুদ্ধ) ঘোষণা করে নেপাল ও ভুটান। এর ফল পেয়েছে দেশ দুটি। একটু দেরিতে হলেও লকডাউন ঘোষণা করে অনেকটা প্রতিরোধ করেছে মালদ্বীপ। এ তিনটি দেশে এখনো করোনা আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা যায়নি। তবে ভাইরাস প্রতিরোধের কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে আলোচিত লকডাউনের মতো সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করায় কিছুটা বিপাকে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলো। এ কারণে পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশে বেশি হারে সংক্রমিত হচ্ছে মানুষ। এখন পর্যন্ত ভারতে ৪৫২ জন, পাকিস্তানে ১৩৫ জন, আফগানিস্তানে ৩০ জন ও বাংলাদেশে ৭৫ জন করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। আর শ্রীলঙ্কায় মারা গেছে ৭ জন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশি মৃত্যু হচ্ছে বাংলাদেশে। ১ হাজার ৮৩৮ জনের মধ্যে মারা গেছে ৭৫ জন। ৪ শতাংশ মৃত্যুর হার দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। আফগানিস্তানে ৩ দশমিক ৬, ভারতে ৩ দশমিক ৩, শ্রীলঙ্কায় ২ দশমিক ৯ ও পাকিস্তানে ১ দশমিক ৮ শতাংশ করোনা রোগী মারা গেছে।