আবার পশ্চিমে ফিরবে ওষুধ উৎপাদন শিল্প

করোনাভাইরাসে ওষুধ তৈরিতে চেষ্টা চালাচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাসে ওষুধ তৈরিতে চেষ্টা চালাচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো। ছবি: রয়টার্স

জ্বর বা মাথা ব্যথা কমছে না? অথবা, হঠাৎ করে আপনার ওজন কমে যাচ্ছে? একটা ফোন করুন। অধিকাংশ সময় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় নিশ্চিত। ডাক্তার আপনার প্রাথমিক পরীক্ষা করলেন। রক্তের কিছু পরীক্ষার পরামর্শ দিলেন। বললেন, কোথায় যেতে হবে পরীক্ষা করতে। আপনার রক্তের নমুনা পরীক্ষার জন্য নেওয়া হলো। নমুনা দেওয়ার জন্য ২০ থেকে ৩০ মিনিটের অপেক্ষা। ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সব পরীক্ষার ফলাফল তৈরি। আপনার পাড়ার ডাক্তারের কাছে পৌঁছে গেছে রোগের প্রকারভেদ ও আপনার চিকিৎসার পরবর্তী ধাপ নির্ধারিত।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা নতুন কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন হলে সেটাও এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যে নিশ্চিত। প্রয়োজনীয় ওষুধ আপনার ডাক্তারের কাছ থেকে আপনি পেয়ে যাবেন। ওষুধ লাগলে খরচ বাংলাদেশি টাকায় এক হাজার টাকার মতো। অর্থাৎ, ডাক্তার দেখানো, টেস্ট, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ, এক্স-রে এমআরআই স্ক্যান, রক্তের নমুনা পরীক্ষা, একাধিক বার পরীক্ষা বিনা মূল্যে। হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক, রক্তনালিতে ব্লক অথবা ক্যানসারের প্রয়োজনীয় সব চিকিৎসা হবে নিখরচায়। হয়তো কয়েক সপ্তাহের অপেক্ষা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপেক্ষা মাত্র কয়েক দিনের। শিশু থেকে ১৬ বছরের তরুণ, ষাটোর্ধ্ব বা সন্তানসম্ভবা এবং প্রতিবন্ধীর ওষুধ বিনামূল্যে। একবার দুবার নয়, যত দিন লাগে তত দিন এ সুবিধা। এটাই হলো যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা।

স্বাস্থ্য খাতে এমন সেবা দেওয়ার নজির পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই। ক্যানসার বা যেকোনো জটিল রোগের সবচেয়ে কার্যকরী চিকিৎসা প্রত্যেকের জন্য নিশ্চিত করা হয়। কোনো বিমার প্রয়োজন নেই। একজন রোগীর বিশ্বসেরা চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য অনেক সময় রোগী পিছু ব্যয় হয় লাখ লাখ টাকা। অনেক সময় অঙ্কটা কোটি ছাড়িয়ে যায়। রাষ্ট্র খরচ বহন করে।

এই ব্রিটেনে স্বাস্থ্যকর্মীরা প্লাস্টিকের ময়লা ফেলার ব্যাগ পরছেন করানো রোগীদের চিকিৎসায়। সুরক্ষার প্রয়োজনীয় এই পোশাকের বাজার মূল্য ১২০০ টাকার মতো। সরবরাহের ঘাটতি রয়েছে মুখে পরার মাস্কেরও। এর দাম ২০০ টাকার কম। যেখানে রোগীকে কোটি কোটি টাকার চিকিৎসা দেওয়া হয় বিনামূল্যে, সেখানে একজন স্বাস্থ্যকর্মীকে সেই দেশে সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পোশাক দিতে পারছে না? করোনারোগীর চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের এই সামান্য উপকরণ দেওয়ার সদিচ্ছা আর অর্থ কোনোটারই অভাব নেই। অভাব হচ্ছে সরবরাহের।

স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ পোশাক বা মাস্ক সবকিছু তৈরি হয় চীনে। সেখানে বন্ধ ছিল উৎপাদন। এর বাইরে ছিল বিশ্বব্যাপী ব্যাপক চাহিদা। এক সময় এসব কিছুই তৈরি হতো ইউরোপ বা আমেরিকায় সেই সঙ্গে নকশা বা উদ্ভাবন। এখন জরুরি চিকিৎসার অনেক কিছুর নকশা পশ্চিমে হলেও উৎপাদন চলে গেছে চীন বা ভারতে। কারণ অবশ্যই সস্তা শ্রম। পশ্চিমের ভোক্তারা বছরের পর বছর ধরে কম দামে পেয়েছে সস্তা শ্রমের দেশগুলোর তৈরি হওয়া পণ্য।

ইউরোপ-আমেরিকায় বন্ধ হয়েছে একের পর এক কারখানা। চীনকে বলা হয় বিশ্বের কারখানা। নতুন ওষুধ তৈরির গবেষণা, আবিষ্কার সব হয়ে থাকে আমেরিকা ও ইউরোপে। নতুন ওষুধ বাজারে আসার ৫ থেকে ৭ বছর পর ওষুধ তৈরির ফর্মুলা উন্মুক্ত হয়ে যায় অন্য কোম্পানির জন্য। চীন আর ভারতের কোম্পানিগুলো সস্তায় তৈরি করতে থাকে এসব ওষুধ। প্রেসক্রিপশন ছাড়া কেনা যায় এমন সব ওষুধের অধিকাংশের মূল উপাদান তৈরি হয় ভারত বা চীনে।

সারা বিশ্বের প্রয়োজনীয় অনেক ওষুধ বা কাঁচামাল তারা তৈরি করে ভারত ও চীন। রপ্তানির বাজার ১৫০ বিলিয়ন ডলারের। অবরুদ্ধ চীন আর ভারতে বেশ কিছুদিন উৎপাদন ও রপ্তানি বন্ধ ছিল। প্যারাসিটামল কিনতে আমার মতো অনেকেরই দোকানের পর দোকান ঘুরতে হয়েছে লন্ডনে। উৎপাদন খরচ কম হওয়ার কারণে অনেক জরুরি ওষুধ তৈরি হয় ভারত বা চীনে। পরে সেগুলো আসে ইউরোপ-আমেরিকায়। ইউরোপ-আমেরিকায় ওষুধের কাঁচামালের ৮০ শতাংশ জোগানদাতা ভারত-চীন।

করোনাভাইরাসে অবরুদ্ধ চীন আর ভারত থেকে ওষুধের সরবরাহ নিয়ে চিন্তিত ইউরোপ-আমেরিকা। নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে অনেক দেশ। ভাবা হচ্ছে, জীবন বাঁচাতে দরকার এমন ওষুধের উৎপাদন নিজ দেশেই করতে হবে। ভারত বা চীনের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। করোনা পরবর্তী বিশ্বে ইউরোপ আমেরিকাতে চিকিৎসা সরঞ্জাম আর জরুরি ওষুধ তৈরির কারখানা আবার শুরু হবে বেশ বড় মাত্রায়।

লন্ডনের শহরতলির ছোট শহর হারলো। ছবির মতো এই শহর ছিল একাধিক গবেষণাগার। নব্বইয়ের দশকে এ শহরের প্রায় সবাই যুক্ত ছিলেন ওষুধ শিল্পের সঙ্গে। বন্ধ হয়ে গেছে সমস্ত ল্যাব। চীন আর ভারত থেকে পরীক্ষা করাতে খরচ কম। গতকালই ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করেছে, এই শহরের ল্যাবগুলো আবার চালু হবে। প্রস্তুত হবে ব্যাপক হারে ভ্যাকসিন তৈরির জন্য। বরাদ্দ হাজার কোটি টাকা। টেমস নদীর পাড়েই ছিল বিশ্বের অন্যতম ভ্যাকসিন তৈরির কারখানা। ফরাসি কোম্পানি সানোফির সে কারখানা কয়েক বছর আগে বন্ধ হয়ে যায়। হারিয়ে যায় এর শিল্পের প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল। গত ১০ বছরে ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রসায়নের ছাত্রসংখ্যা কমে গেছে দারুণভাবে। কারণ একের পর এক ওষুধ তৈরির কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাকরির বাজার সীমিত হয়েছে।

ওষুধের গবেষণা, আবিষ্কার আর ব্যাপকভাবে তৈরির জন্য দরকার হয় বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় দক্ষ জনগোষ্ঠী। হঠাৎ করে দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করা সম্ভব নয়। ওষুধ শিল্পে ব্রিটেন, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড আর যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে অত্যন্ত সমৃদ্ধ ইতিহাস। বিশ্বের অধিকাংশ নতুন আবিষ্কারের দেশগুলো এখনো অনেক এগিয়ে। করোনা পরবর্তী বিশ্বের ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল আর উৎপাদনের একটা বড় অংশ আবার পশ্চিমে চলে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

সুব্রত বোস: প্রবাসী বাংলাদেশি ও বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির ক্লিনিক্যাল ট্র্যায়ালস অ্যানালিটিকসের গ্লোবাল প্রধান।
subratabose 01@yahoo. com