রাস্তাঘাটে জীবাণুনাশকে ভাইরাস মরে না, বরং স্বাস্থ্যের ঝুঁকি

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ছবি: রয়টার্স
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর রাস্তাঘাট, বাজার ও খোলা জায়গায় জীবাণুনাশক স্প্রে করা হচ্ছে দেশে দেশে। কিন্তু এ বিষয়ে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তারা বলেছে, উন্মুক্ত জায়গায় এভাবে জীবাণুনাশক ছিটালে করোনা ভাইরাস মরে না, বরং এটি স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

গত শুক্রবার প্রকাশিত এক নির্দেশিকায় এ কথা বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। করোনা মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে উন্মুক্ত জায়গা কীভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে, তা নিয়ে স্বাস্থ্যকর্মী, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং নীতিনির্ধারক ও তা বাস্তবায়নকারীদের প্রতি বিভিন্ন নির্দেশনা রয়েছে এতে।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১৮টি পানি ছিটানোর গাড়ি দিয়ে প্রতিদিন রাজধানীর প্রধান সড়কসহ অলিগলিতে ব্লিচিং পাউডার মিশ্রিত পানি ছিটানো হচ্ছে। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৮টি এবং উত্তর সিটি করপোরেশনে ১০টি গাড়ির মাধ্যমে পানি ছিটানো হয়। দুই সিটিতে দৈনিক প্রায় ২ লাখ লিটার তরল জীবাণুনাশক ছিটানো হচ্ছে বলে সিটি করপোরেশন জানিয়েছে।

উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মানবদেহে ছিটানোর বিষয়ে সতর্ক করেছে। আর সিটি করপোরেশন সড়কে জীবাণুনাশক ছিটাচ্ছে। তারপরও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো কিছু সিটি করপোরেশন করবে না। ডব্লিউএইচও থেকে তরল জীবাণুনাশক না ছিটানোর নির্দেশনা দেওয়া হলে সিটি করপোরেশন ছিটানো বন্ধ করে দেবে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ক্লোরিনজাতীয় যেকোনো জীবাণুনাশক মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। মার্কেটে ঢোকার মুখে মানুষের শরীরে জীবাণুনাশক ছিটানো হচ্ছে, সেগুলো অত্যন্ত ক্ষতিকর। করোনাভাইরাস তো রাস্তাঘাটে থাকে না। সেখানে তরল জীবাণুনাশক ছিটানো আসলে অপচয়।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে উন্মুক্ত স্থান যেমন রাস্তাঘাট বা বাজারে জীবাণুনাশক ছিটিয়ে যে কাজ হয় না, তার ব্যাখ্যা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তারা বলছে, ‘ধুলা–ময়লা এবং আবর্জনার মধ্যে পড়ে জীবনটা অকার্যকর হয়ে পড়ে।’ সংস্থাটি আরও বলেছে, জীবাণুনাশক ছিটালেই জীবাণু নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় না। তার জন্য ছিটানো জীবাণুনাশককে একটা ন্যূনতম সময় জীবাণুর সংস্পর্শে থাকতে হয়। উন্মুক্ত স্থানে ছিটানো জীবাণুনাশক ততটা সময় জীবাণুর সংস্পর্শে থাকার সুযোগ হয় না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, সড়ক ও ফুটপাত করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানোর উৎস নয়, বরং এসব জায়গায় জীবাণুনাশক ছিটালে তা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করবে। নির্দেশিকায় মানুষের ওপরও জীবাণুনাশক ছিটানোর বিপক্ষে মত দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, যেকোনো পরিস্থিতিতে মানুষের ওপর জীবাণুনাশক ছিটানো অনুচিত। মানুষের ওপর জীবাণুনাশক ছিটালে তা শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। এই প্রক্রিয়া একজন সংক্রমিত ব্যক্তির মুখ নিঃসৃত তরল কণা (ড্রপলেট) বা সংস্পর্শের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়ানো কমাতে সহায়ক নয় বলেও মন্তব্য করেছে সংস্থাটি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওই নির্দেশিকায় বলা হয়, জীবাণুমুক্ত করতে মানুষের ওপর ক্লোরিন বা অন্য বিষাক্ত রাসায়নিক ছিটালে তা চোখ ও ত্বকে জ্বালাপোড়া, ব্রঙ্কোস্পাজম ও পেটের সমস্যার কারণ হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘরের ভেতরেও বিভিন্ন পৃষ্ঠে জীবাণুনাশক ছিটানোর বিপক্ষে মত দিয়েছে। একটি গবেষণার বরাত দিয়ে সংস্থাটি বলেছে, এ ক্ষেত্রেও জীবাণু নিষ্ক্রিয় হওয়ার আশঙ্কা কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, জীবাণুনাশক যদি প্রয়োগ করতেই হয়, তাহলে তাতে কাপড় ভিজিয়ে পৃষ্ঠ মোছাই উত্তম।

গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিড-১৯ রোগ সৃষ্টিকারী নতুন করোনাভাইরাস যেকোনো পৃষ্ঠ ও বস্তুর সঙ্গে লেগে থাকতে পারে। তবে এটি এই অবস্থায়ও সংক্রামক থেকে যায় কি না, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ভাইরাসটি কোনো কোনো পৃষ্ঠে কয়েক দিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। তবে এই বিষয়টিও পুরোপুরি নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। কারণ, গবেষণার ওই ফলাফলগুলো পাওয়া গেছে গবেষণাগারে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পরীক্ষা চালিয়ে। বাস্তব পৃথিবীর পরিবেশে বিভিন্ন পৃষ্ঠে ভাইরাসটির আচরণ ও টিকে থাকার ক্ষমতা সম্পর্কে এখনো মানুষ অনেকাংশেই অন্ধকারে।