আম্পানের তাণ্ডবে তছনছ কলকাতা ও দুই চব্বিশ পরগনা

কলকাতায় ঝড়ে মিনিবাসের ওপর পড়ে আছে গাছ। ছবি: রয়টার্স
কলকাতায় ঝড়ে মিনিবাসের ওপর পড়ে আছে গাছ। ছবি: রয়টার্স

ঝড়ের গতি অন্তত ১৩০ কিলোমিটার, বৃষ্টির প্রাবল্য এবং সমুদ্র ও নদীর জলোচ্ছ্বাসে প্রলয় ঘটে গেল পশ্চিমবঙ্গের দুই চব্বিশ পরগনাসহ কলকাতায়। বুধবার সন্ধ্যা থেকে ঘণ্টা চারেকের যে দুর্যোগ সুন্দরবন পেরিয়ে মেদিনীপুর ছুঁয়ে কলকাতা হয়ে দুই চব্বিশ পরগনাকে তছনছ করে বাংলাদেশের খুলনার দিকে চলে যায়, করোনা–আক্রান্ত পশ্চিমবঙ্গে তা কী পরিমাণ ক্ষতের সৃষ্টি করেছে বৃহস্পতিবারেও সেই আন্দাজ সম্পূর্ণ নয়। বুধবার রাত পর্যন্ত ১০-১২ জনের প্রাণহানির খবর সরকারের কাছে পৌঁছেছে। কিন্তু সম্পত্তি, গবাদিপশু ও খেতের ফসলের ক্ষতির পরিমাণের পূর্ণাঙ্গ হিসাব রাজ্য সরকারের কাছে এখনো এসে পৌঁছায়নি।

জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর মহাপরিচালক এস এন প্রধান জানিয়েছেন, কয়েক দিন ধরে বাহিনীর ৪১টি দল পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশায় কাজ করছে। আম্পানের তাণ্ডব শুরুর আগেই তারা পশ্চিমবঙ্গ থেকে ৫ লাখ মানুষকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে গেছে।

ঠিক ১১ বছর আগে বঙ্গীয় উপকূলে বিধ্বংসী আইলার ঝড়ের গতি ছিল ১২০ কিলোমিটার। কলকাতায় তা কমে হয়েছিল ১১০ কিলোমিটার। বুধবার আম্পান সেই রেকর্ড ম্লান করে দেয়। রাজ্যে স্থান অনুযায়ী ঝড়ের গতি ছিল কোথাও ১৩৩, কোথাও ১১৪ কিলোমিটার। সঙ্গে বৃষ্টির দমকা। উপকূলবর্তী এলাকায় এর সঙ্গে যুক্ত হয় জলোচ্ছ্বাস। এই ত্র৵হস্পর্শে রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় কোথাও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট, কোথাও দেয়াল চাপা পড়ে কোথাওবা গাছ ভেঙে কয়েকজনের মৃত্যু হয়। উড়ে যাওয়া টিনের আঘাতেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। হাওয়া অফিসের পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, কলকাতায় তাণ্ডবলীলা চালিয়ে ঝড়টি নদীয়া ও মুর্শিদাবাদ হয়ে বাংলাদেশের দিকে চলে যায়।

কলকাতায় ঝড়ে ভেঙে গেছে অনেক বাড়ির দেয়াল। ছবি: রয়টার্স
কলকাতায় ঝড়ে ভেঙে গেছে অনেক বাড়ির দেয়াল। ছবি: রয়টার্স

আম্পানের প্রশাসনিক মোকাবিলায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার নবান্নে থাকারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেখানেই খোলা হয়েছিল ‘ওয়ার রুম’। তাণ্ডব কিছুটা স্তিমিত হলে দৃশ্যত অসহায় মুখ্যমন্ত্রী বুধবার রাতেই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে দেশবাসীর সাহায্য চান। কেন্দ্রের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দৃষ্টিতে নয়, মানবিক হয়ে এই তাণ্ডবকে দেখুন। বাংলাকে ঘুরে দাঁড়াতে সবার সহযোগিতা চাই।’ তিনি বলেন, সব ক্ষতি বাংলাতেই। করোনার দরুন অর্থনীতি এমনিতেই স্তব্ধ। তার ওপর প্রকৃতির এই রোষ। রাজ্য পুনর্গঠনে অনেক টাকা প্রয়োজন। মুখ্যমন্ত্রী রাতেই বলেন, ‘এমন সাইক্লোন আগে কখনো দেখিনি। এখনো পর্যন্ত যা খবর এসেছে তাতে দুই চব্বিশ পরগনা, কিছুটা পূর্ব মেদিনীপুর ও হাওড়া লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। বহু এলাকা বিদ্যুৎহীন। পানীয় জলের সরবরাহ বিচ্ছিন্ন। গাছ পড়ে রাস্তা আটকে গেছে। মাটির ঘর ভেঙে গেছে। ঘরের চাল উড়ে গেছে। ভেঙে গেছে বাঁধ। ফসলের ক্ষতি কতটা, কোনো আন্দাজ এখনো নেই। বৃহস্পতিবার টাস্ক ফোর্সের বৈঠকে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বোঝার চেষ্টা হবে।’

বুধবার দুপুর থেকেই কলকাতায় সন্ধ্যা ঘনিয়েছিল। দক্ষিণ থেকে উড়ে আসা কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছিল কলকাতার আকাশ। সঙ্গে মাঝারি হাওয়া ও বৃষ্টি। বিকেল থেকে ঝড়ের বেগ বাড়তে শুরু করলে সন্ধ্যার আগেই নিষ্প্রদীপ হয়ে যায় এলাকার পর এলাকা। প্রবল ঝড়ে উপড়ে যায় শহরের প্রায় ৩০০ বড় গাছ। উপড়ে পড়ে বিদ্যুতের খুঁটি। ট্রাফিক সিগন্যাল। ভেঙে যায় পুরোনো বাড়ি। উড়ে যায় বিজ্ঞাপনের বড় বড় হোর্ডিং। কলকাতা বিমানবন্দরও প্লাবিত হয়ে যায়। পৌর প্রশাসক ফিরহাদ হাকিম রাতে বলেন, অন্তত ৩০০ গাছ ও কিছু বাতিস্তম্ভ উপড়ে পড়েছে। ৭টির মতো জীর্ণ বাড়ি ভেঙে গেছে। আলীপুর আবহাওয়া অফিস জানায়, মে মাসে ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের নিরিখে বুধবার রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। মোট বৃষ্টির পরিমাণ ২৪৪ দশমিক ২ মিলিমিটার।

কলকাতা ও আশপাশে গতকালের দৃশ্য। ছবি: রয়টার্স
কলকাতা ও আশপাশে গতকালের দৃশ্য। ছবি: রয়টার্স

করোনাকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে রাজ্যের মন–কষাকষি অব্যাহত। দুই পক্ষেই চলেছে দোষারোপের পালা। রাজ্য রাজনীতি উত্তপ্ত। এই অবস্থায় আম্পানের মার রাজ্য কীভাবে সামলাবে, সেই প্রশ্নের পাশে বড় হয়ে উঠছে কেন্দ্রীয় সহায়তা কতটা আসবে এবং কত দ্রুত। ‘পলিটিক্যালি’ না দেখে এই বিপর্যয়কে মানবিক দৃষ্টিতে বিচার করে সাহায্যের যে আবেদন মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, কেন্দ্র তাতে কতটা কর্ণপাত করে সেটাই দেখার।