ভারতের বিড়ম্বনা বাড়াল নেপাল

নেপাল রোববার জাতীয় সংসদে পেশ করল `ম্যাপ আপডেট বিল`, যাতে কালাপানি, লিপুলেখ ও লিমপিয়াধুরার মোট ৩৩৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নেপালের অংশ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। নেপালের জাতীয় সংসদের এই ছবিটি ইউটিউব থেকে নেওয়া।
নেপাল রোববার জাতীয় সংসদে পেশ করল `ম্যাপ আপডেট বিল`, যাতে কালাপানি, লিপুলেখ ও লিমপিয়াধুরার মোট ৩৩৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নেপালের অংশ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। নেপালের জাতীয় সংসদের এই ছবিটি ইউটিউব থেকে নেওয়া।

ভারতের যাবতীয় বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে দ্বিপক্ষীয় সংঘাত তীব্র করে তোলার পথে আরো একধাপ এগিয়ে গেল নেপাল। ভারতের অসন্তোষ তীব্র করে তুলে উত্তরের এই প্রতিবেশী তাদের দেশের নতুন ম্যাপে সংসদীয় অনুমোদনের পথ প্রশস্ত করে তুলল। রোববার তারা জাতীয় সংসদে পেশ করল 'ম্যাপ আপডেট বিল', যাতে কালাপানি, লিপুলেখ ও লিমপিয়াধুরার মোট ৩৩৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নেপালের অংশ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় ইনিংসের প্রথম বর্ষপূর্তির সাফল্যের উপাখ্যানে নেপালের এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে অস্বস্তির বার্তা বয়ে এনেছে। নেপালের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। ভারতের কূটনৈতিক মহল মনে করছে, জাতীয়তাবাদ আঁকড়ে নরেন্দ্র মোদি যেভাবে তাঁর অবস্থান দিন দিন পোক্ত করে তুলেছেন, নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক মোকাবিলায় সেই জাতীয়তাবাদকে আঁকড়েই প্রধানমন্ত্রী খড়্গ প্রসাদ শর্মা ওলি তাঁর অধিষ্ঠান ধরে রাখতে ব্যগ্র। 

দেশের মানচিত্রে পরিবর্তন এনে নতুন এই ম্যাপ নেপালের মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়েছিল আগেই। সংসদীয় অনুমোদনের জন্য সংবিধান সংশোধন বিল জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থনে পাস হওয়া প্রয়োজন। বিলের বিরোধিতা দেশ ও জাতির বিরোধিতার সামিল হবে বলে বিরোধীরাও এই বিল সমর্থন করবে বলে জানিয়েছে। গত শনিবার প্রধান বিরোধী দল নেপালি কংগ্রেস বিল সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেয়। ওই সিদ্ধান্তের খবর জানা মাত্র রোববারে বিলটি সংসদের নিম্নকক্ষে পেশ করা হয়। মনে করা হচ্ছে, নেপালি কংগ্রেসের সমর্থন পেলে সংসদের নিম্ন ও উচ্চকক্ষ কোথাও দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন পেতে শাসক দলের অসুবিধা হবে না। অন্য বিরোধী দলগুলোর বিরোধিতা কোনোরকম বাধা হতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে আগামী দশ-বারো দিনের মধ্যেই বিলটি সংসদীয় অনুমোদন পেয়ে যাবে বলে নেপালের শাসক দলের ধারণা।

বিলটি সংসদে পাশ হয়ে গেলে ভারত–নেপাল সম্পর্ক অবশ্যই এক ভিন্ন মোড় নেবে। করোনার মোকাবিলায় দেশ যখন বিপর্যন্ত, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে যখন কিছুটা কোণঠাসা, তখন নেপালের এই সিদ্ধান্ত বাড়তি দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেপালের এই সিদ্ধান্তও সেই সময় যখন চীনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত বিবাদ উত্তেজনা ছড়িয়েছে। প্রায় এক মাস ধরে লাদাখের বেশ কিছু জায়গায় ভারত ও চীনের সেনারা মুখোমুখি চোখে চোখ রেখে নিজেদের দাবিতে অটল। করোনা ও চীনের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনার পরিস্থিতিতে নেপালের ম্যাপ–বিবাদ নরেন্দ্র মোদির কাছে ত্র৵হস্পর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নেপাল যখন চলতি মাসের মাঝামাঝি নতুন ম্যাপ প্রকাশ করে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিল, এই সিদ্ধান্ত ঐতিহাসিক ঘটনা ও প্রমাণসাপেক্ষ নয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব গত বৃহস্পতিবার বলেছিলেন, 'এই একক সিদ্ধান্ত ভারত মোটেই মেনে নেবে না। বিষয়টি আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি।' কিন্তু বিরোধী সমর্থন নিশ্চিত হওয়ার পর ভারতের প্রতিবাদ অগ্রাহ্য ও উপেক্ষা করে নেপাল এই সিদ্ধান্তে অবিচল থাকার বার্তা দিচ্ছে। সেই অনড় ও অবিচল মনোভাব কিসের জোরে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কূটনৈতিক মহলে চলছে তারই জল্পনা।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ফাইল ছবি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ফাইল ছবি

জনপ্রিয় ধারণা, রাজনৈতিক পালাবদলের পর ধীরে অথচ নিশ্চিতভাবে নেপাল চীনের দিকে ঢলে পড়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির মিলন সেই প্রবণতাকে ত্বরাণ্বিত করেছে। করোনার দরুণ আন্তর্জাতিক মহলে চীন কিছুটা কোণঠাসা। ভারতকে চাপে রাখার বাড়তি একটা তাগিদও তাই তারা অনুভব করছে। সেই জন্য নেপালকেও তারা ব্যবহার করছে।

নেপালে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত দেব মুখোপাধ্যায় অবশ্য নেপালি আচরণের পেছনে চীনের ভূমিকাকে খুব বড় করে দেখতে প্রস্তুত নন। কারণ, তাঁর কথায়, বিতর্কিত এই অঞ্চল নিয়ে চীন কখনো ভারতের সঙ্গে সেভাবে বিবাদে পড়েনি। লিপুলেখ, কালাপানি ও লিমপিয়াধুরায় ভারতের অধিকার নিয়ে সেভাবে প্রশ্ন তোলেনি। রোববার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, 'আমার ধারণা, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষমতার লড়াইয়ে জিততে প্রধানমন্ত্রী ওলি জাতীয়তাবাদকে হাতিয়ার করেছেন। বিষয়টি স্পর্শকাতর বলে বিরোধীরাও সমর্থন করছেন।' দেব মুখোপাধ্যায় নেপালের এই আচরণকে ভারতের জন্য 'বিশেষ উদ্বেগজনক' বলে মনে করছেন না। তাঁর কথায়, 'উদ্বেগ বলব না। তবে অস্বস্তিকর অবশ্যই।'

অস্বস্তিকর এই অবস্থার জন্য দেব মুখোপাধ্যায় ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং সেনা প্রধান মনোজ মুকুন্দ নারভানেকে কিছুটা দায়ী করেছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, '৮ মে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের ধুমধাম করে লিপুলেখ পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার রাস্তা উদ্বোধন করাটা ঠিক হয়নি। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যখন স্বাভাবিক নয়, তখন এই সব না করাই বাঞ্ছনীয়। দ্বিতীয় ভুল করেছেন ভারতের সেনা প্রধান। নেপালের আচরণ সম্পর্কে কিছুদিন আগে তিনি যে মন্তব্য করেছেন, তা করা অনুচিত। সেনা প্রধানদের রাজনৈতিক মন্তব্য করা সাজে না।'