কেইকো ওগুরা সেদিন যা দেখেছিলেন

কেইকো ওগুরা
কেইকো ওগুরা

‘১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসের ৫ তারিখে বিমান হামলার সতর্কতার সাইরেন অনেকবার বেজে উঠেছিল, তবে কোনো রকম বোমা হামলা সেদিন হয়নি। আমরা সবাই বাড়িতে ছিলাম এবং পরদিন সকালে আমার স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল। তবে সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবা বলেছিলেন, তাঁর মনে হচ্ছে কিছু একটা যেন ঘটে যেতে পারে, তাই আমি যেন স্কুলে না যাই। তবে আমার তেমন মনে হয়নি। সকাল সোয়া আটটার একটু আগে আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ ও সেই সঙ্গে উজ্জ্বল আলো আমাকে দিশেহারা করে ফেলে। এর ঠিক পরপর চারদিক অন্ধকার হয়ে অদ্ভুত এক নীরবতা নেমে আসে। বুঝতে পারছিলাম না আমার কী করা উচিত। আর ঠিক তখনই আমি কান্নার শব্দ শুনতে পাই। বুঝতে পারছিলাম এটা আমার ছোট ভাইয়ের কান্নার শব্দ। সেই শব্দ আমাকে অবচেতন অবস্থা থেকে জাগিয়ে তোলে এবং আমি দৌড়ে বাড়ি ফিরে যাই। ঘরে সবকিছু লন্ডভন্ড অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখি। তবে সৌভাগ্যবশত কাটাছেঁড়া মতো সামান্য আঘাত পেলেও সবাই নিরাপদ ছিলেন।’

পঁচাত্তর বছর আগের সেই ভয়াবহ দিনের বর্ণনা কেইকো ওগুরা শুরু করেছিলেন এভাবে। তিনি হলেন আণবিক বোমা হামলায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত প্রাণে বেঁচে যাওয়া একজন হিবাকুশ। এ বছর হিরোশিমায় আণবিক বোমা হামলার ৭৫তম বার্ষিকী সামনে রেখে এই নারী একটি ভার্চ্যুয়াল সাক্ষাৎকার ও অনলাইন সংবাদ সম্মেলনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল জাপানে বিদেশি সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহের কাজে সাহায্য করা ফরেন প্রেস সেন্টার।

৮৩ বছর বয়েসেও তিনি সক্রিয় আছেন পরমাণুমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার আন্দোলনে। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে রাখা বক্তব্যে তিনি তুলে ধরেন ৭৫ বছর আগের সেই দিনে তাঁর হওয়া অভিজ্ঞতার কথা। পাশাপাশি পরবর্তী জীবনে যেসব সমস্যার মধ্য দিয়ে তাঁকে এবং বোমা হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া অন্যদের যেতে হয়েছে, সেই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা।

এরপর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে পরিস্থিতির আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া ছাড়াও বিশ্বকে পরমাণু অস্ত্র মুক্ত করায় তাঁর নিজের ও অন্যদের চালানো প্রচেষ্টার ব্যাখ্যাও তিনি দেন।

কেইকো ওগুরার জন্ম হিরোশিমা শহরে ১৯৩৭ সালের ৪ আগস্ট। বোমা হামলার সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র আট বছর। বোমা হামলার কেন্দ্রবিন্দু বা জিরো পয়েন্ট থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে ছিল তাঁর পরিবারের বসবাস। গ্রীষ্মের ছুটি তখন চলতে থাকলেও স্কুলের ছাত্রছাত্রীদেরও যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত কাজে নিয়োগ করা হয়েছিল। কেইকো ওগুরা নিজে যেমন আরও প্রায় ৯০ জন বালিকার সঙ্গে মিলে বিমান হামলার সতর্কতা জারি করার কাজে কর্মকর্তাদের সহায়তা করছিলেন। আর সে কারণেই ৬ আগস্ট সকালেও তাঁর স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল। তাঁর বড় দুই ভাইয়ের একজনকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সবচেয়ে বড় ভাই ছিলেন জুনিয়র হাইস্কুলের ছাত্র। সেই ভাইকে যুদ্ধকালীন জরুরি কৃষিকাজে নিয়োগ করা হয় এবং হিরোশিমা স্টেশনের উত্তরে তিনি কর্মরত ছিলেন। ভাইয়ের অভিজ্ঞতা ছিল একেবারেই অন্য রকম।

যার বর্ণনা দিয়ে ওগুরা বলেছেন, ‘ভাই তখন আলুখেতে কাজ করছিল এবং শব্দ শুনে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটি বি-৫২ বোমারু বিমান উড়ে আসতে সে দেখে। এর পরপরই তার চোখে পড়ে বিমান থেকে কালো কী যেন একটা পড়ছে। তবে সৌভাগ্যবশত দৃষ্টি সরাসরি সেদিকে না থাকায় সেই যাত্রায় সে বেঁচে গিয়েছিল। হিরোশিমায় ঠিক কী হয়েছে, তা দেখার জন্য কাছের পাহাড়ে উঠে গেলে তার চোখে পড়ে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হারিয়ে যাওয়া এক শহর। পরে অবশ্য তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে আসার কারণে অসুখে ভুগে সে মারা যায়।’

আণবিক বোমার স্মৃতিস্তম্ভ, যেখানে সংরক্ষিত আছে নিহত সবার নাম।
আণবিক বোমার স্মৃতিস্তম্ভ, যেখানে সংরক্ষিত আছে নিহত সবার নাম।

ওগুরা বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পর একসময় দেখতে পেয়েছিলেন আগুন এগিয়ে আসছে। আর আগুনের সঙ্গে আসছে মানুষের ঢল। এদের অনেকের দেহ মারাত্মকভাবে পুড়ে যাওয়া। কারও দেহের ত্বক ঝুলে পড়ছে এবং সবাই ‘পানি, পানি’ বলে চিৎকার করছে। ‘সেই চিৎকার শুনে কয়েকজনকে আমি পানি দিয়েছিলাম। তবে পানি পান করার অল্প পরে মৃত্যুর কোলে তারা ঢলে পড়েন। আমি বুঝতে পারিনি কেন এমন হচ্ছে। তবে পরে জেনেছি যে আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষকে পানি দিতে নেই। সেই থেকে অনেক দিন অপরাধ বোধে আমি ভুগেছি। কেবলই মনে হয়েছে আমি মানুষ খুন করেছি।’

আগুন অবশ্য শেষ পর্যন্ত ওগুরাদের বাড়ি পর্যন্ত আসেনি। অল্প পরে বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টিতে বাইরে বের হলে আঠালো কালো বৃষ্টির পানিতে ভিজে গিয়েছিল তাঁর পরনের পোশাক। বৃষ্টি আঠালো ছাই রঙের কিছু রেখা বাড়ির দেয়ালজুড়েও রেখে যায়। সেই বৃষ্টি ছিল আণবিক বোমার কালো বৃষ্টি, তেজস্ক্রিয়তায় পরিপূর্ণ। এক দিন পর পাহাড়ে উঠে তিনি চেষ্টা করেছিলেন হিরোশিমা শহরকে দেখার। কিন্তু কিছুই তার দৃষ্টিতে পড়েনি। নিজের পরিচিত শহর যেন এক ফুঁৎকারে শূন্যে বিলীন হয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে আছে শুধু পুড়ে যাওয়া কিছু কাঠামো।

‘আমার চোখের সামনে মৃত্যুর কোলে যারা ঢলে পড়েছেন, তাদেরকে আমি কখনো ভুলতে পারব না। আমি নিজে এ কারণে সৌভাগ্যবান ছিলাম যে বড় কোনো আঘাত আমি পাইনি। পরিবারে আমি হচ্ছি একমাত্র ব্যতিক্রম, যাকে সেভাবে ভুগতে হয়নি। আমার যে ভাই নিজের চোখে বিমান থেকে বোমা পড়তে দেখেছিল, পরে সে ক্যানসারে মারা যায়। তবে অন্য এক ভয় আমাকে সব সময় তাড়া করেছে। আণবিক বোমা হামলার পর বলা হতো, আমরা যেন আমাদের দুঃখ আর যন্ত্রণার কথা না বলি, পাছে মানুষের মধ্যে এ নিয়ে ভুল–বোঝাবুঝি দেখা দেয়। আমার সমবয়সী মেয়েদের মধ্যে অনেকে দীর্ঘকাল এ রকম আতঙ্কে ভুগেছে যে তাদের হয়তো বিয়ে হবে না, কিংবা বিয়ে হলেও সন্তানের জন্ম দিতে তারা সক্ষম হবে না। আমার নিজের বেলায়ও সে রকম চিন্তা কাজ করেছে। তবে পরে আমি বিয়ে করেছি এবং দুই সন্তানের মা হতে পেরেছি।’

হিরোশিমার বোমা হামলায় যারা প্রাণে বেঁচে গেছেন, তাদের মধ্যে এ রকম মানসিক পীড়া হচ্ছে বড় এক সমস্যা। সেদিনের বিভীষিকাময় স্মৃতি বারবার তাদের মনে ফিরে আসে। ভয়ংকর সেই দুঃস্বপ্নের পুনরাবৃত্তি যেন আর না ঘটে, সেই তাড়না থেকে এদের অনেকে পরবর্তী জীবনে যুক্ত হয়েছেন শান্তি আন্দোলনের সঙ্গে, এই আশা নিয়ে যে নিজেদের মর্মান্তিক স্মৃতি তুলে ধরার মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে মানুষকে শান্তি আন্দোলনে তারা যুক্ত করতে পারবেন, পরমাণুমুক্ত বিশ্ব গড়ে তুলতে যে আন্দোলন পালন করবে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা। কেইকো ওগুরা নিজেও যুক্ত আছেন সে রকম আন্দোলনের সঙ্গে।

তাঁর স্বামী কাওরু ওগুরা ছিলেন হিরোশিমা শান্তি স্মৃতি জাদুঘরের পরিচালক এবং পরমাণুমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার আন্দোলনের সক্রিয় এক কর্মী। ১৯৭৯ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর কেইকো ওগুরা নিজেও আন্দোলনের সঙ্গে আরও বেশি সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন এবং বিদেশ থেকে আসা শান্তি আন্দোলনের কর্মীদের সাহায্য করার উদ্দেশ্যে দোভাষীদের সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি শান্তির জন্য হিরোশিমার দোভাষী নামের একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন, আণবিক বোমা হামলার স্মৃতি নিজের চোখে দেখার জন্য বিদেশ থেকে আসা ভ্রমণকারীদের যে সংগঠন সাহায্য করে আসছে।

আণবিক বোমা গম্বুজ ও প্রার্থনারত বৌদ্ধ পুরোহিতের ভাস্কর্য
আণবিক বোমা গম্বুজ ও প্রার্থনারত বৌদ্ধ পুরোহিতের ভাস্কর্য

সংবাদ সম্মেলনে নিজের বক্তব্য তুলে ধরার পর বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর ওগুরা দিয়েছেন। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার এই সময়ে তাঁর অনুভূতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেছেন, এখনকার এই সময়টা তাঁকে মনে করিয়ে দিচ্ছে ১৯৪৫ সালে যে অনুভূতি তাঁর হয়েছিল, সেই স্মৃতি। ‘করোনার বিরুদ্ধে টিকা এখনো আমাদের হাতে আসেনি। পঁচাত্তর বছর আগে একইভাবে ওষুধের অভাবে মানুষ একের পর এক মারা যাচ্ছিলেন। ফলে পরমাণু অস্ত্রের ভান্ডার গড়ে না তুলে মানবকল্যাণে আমাদের আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত।’

হিরোশিমার ধ্বংসযজ্ঞের পাশাপাশি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জাপানের করা যুদ্ধাপরাধকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি দেখছেন, সেই প্রশ্নের উত্তরে ওগুরা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের শ্রোতাদের সামনে কথা বলার সময় তিনি যা বলেন, তা হলো অস্ত্র, তা পরমাণু কিংবা সনাতন, যেকোনো অস্ত্রই হোক না কেন, মানুষের প্রাণ তা বধ করে থাকে। ফলে আণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞ এবং যুদ্ধের সময় যেসব অন্যায় জাপান করেছে, সেই শিক্ষা তরুণদের দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমেরও দায়িত্ব হচ্ছে সঠিক সংবাদ পৌঁছে দেওয়া। দুঃখজনকভাবে সে দায়িত্ব এরা পুরোপুরি পালন করতে পারছে না।

এ প্রসঙ্গে নিজের যুক্তরাষ্ট্র সফরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেছেন যে প্রথম যখন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন, দর্শকদের মধ্যে অনেকেই তাঁর দুর্দশার বর্ণনা এবং পরমাণু অস্ত্র বিলুপ্তির আহ্বান শুনে বলেছিলেন যে হিরোশিমায় আণবিক বোমা ফেলা না হলে ভাষণ দেওয়ার জন্য সেখানে তিনি উপস্থিত হতে পারতেন বলে তাঁরা মনে করেন না। ওগুরা বলেছেন যে সরকারের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমের প্রচার থেকে এ রকম ধারণা এদের হয়েছে যে আণবিক বোমা ফেলা না হলে যুদ্ধের ভয়াবহতায় আরও অনেক বেশি মানুষের মৃত্যু হতো। অর্থাৎ এরা মনে করেন, আণবিক বোমা হামলা যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছে। ওগুরা উল্লেখ করেছেন যে তাদের সেই যুক্তি শুনে পালটা যে প্রশ্ন তিনি তাদের করেছিলেন তা হলো, তাই যদি হয়, তবে তিন দিন পর নাগাসাকিতে দ্বিতীয় বোমা হামলা কেন? সেটার তো কোনো প্রয়োজন ছিল না। ফলে তিনি মনে করেন, সঠিক সংবাদ মানুষের কাছে যাচ্ছে না এবং সেই পরিস্থিতির বদল হওয়া দরকার।

কেইকো ওগুরা তাঁর নিজের ভাষণের এক জায়গায় বলেছিলেন যে পরমাণুমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার ইতিবাচক কিছু পদক্ষেপের দেখা এখন পাওয়া যাচ্ছে, যার মধ্যে একটি হলো পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তি। এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, জাপানের সেই চুক্তিতে স্বাক্ষর না করাকে তিনি কীভাবে দেখছেন।

নিজের দেশের সরকারের সেই অবস্থানকে সরাসরি দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক আখ্যায়িত করে তিনি বলেছেন, আণবিক বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের অনেকেই সরকারের এ আচরণে ক্ষুব্ধ। তবে তিনি এ রকমও মনে করেন যে একা তাঁদের পক্ষে সরকারকে প্রভাবিত করা কঠিন। ফলে বাংলাদেশসহ পরমাণু অস্ত্র যাদের নেই, সেসব রাষ্ট্রের উচিত হবে চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য জাপানের ওপর চাপ দিয়ে যাওয়া। সেই সাহায্য এদের কাছ থেকে তিনি প্রত্যাশা করছেন।

কেইকো ওগুরার গড়ে তোলা সংগঠন শান্তির জন্য দোভাষী প্রতিবছর ৬ আগস্ট হিরোশিমা সফরে আসা বিদেশিদের জন্য হিরোশিমা শান্তি স্মৃতি উদ্যান এবং এর চারপাশে সংরক্ষিত বোমা হামলার বিভিন্ন স্মৃতি ভ্রমণের আয়োজন করে থাকে। এবারে অবশ্য করোনাভাইরাসের কারণে হচ্ছে না সেই ভ্রমণ। তবে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আয়োজকেরা দিনভর ইন্টারনেট অনলাইনে ভার্চ্যুয়াল ভ্রমণের ব্যবস্থা করছেন, বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকে আগ্রহী মানুষ যে ভ্রমণে যোগ দিতে পারবেন।