বৈরুত কি আগের জায়গায় ফিরবে

বিস্ফোরণে সৃষ্ট কম্পনে ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনগুলোর একটি। গতকাল বৈরুত শহরে।  ছবি: এএফপি
বিস্ফোরণে সৃষ্ট কম্পনে ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনগুলোর একটি। গতকাল বৈরুত শহরে। ছবি: এএফপি

বৈরুত আর বিস্ফোরণ দীর্ঘদিন ধরেই সমার্থক শব্দ হিসেবে পরিগণিত। লেবাননে ১৫ বছরের গৃহযুদ্ধের প্রধান ক্ষেত্র ছিল এই শহর। কেবল এই সময়কালে শহরটি একের পর এক হত্যাকাণ্ড, দিনের পর দিন গৃহযুদ্ধ, মাসের পর মাস আন্তর্জাতিক যুদ্ধ ও বছরের পর বছর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অসন্তোষের সাক্ষী। এত কিছুর পরও লেবানিজরা দশকের পর দশক বিশ্বকে দেখাতে চেয়েছেন, তাঁরা এসব সংকটের সমষ্টির চেয়েও বেশি কিছু। লাখ লাখ লেবানিজ ও হাজার হাজার শরণার্থী শান্তিপূর্ণভাবে একসঙ্গে বসবাস করে আসছে। গভীর সাম্প্রদায়িক বন্ধন নির্মিত হয়েছে সেখানে। সব সমস্যার ঢেউ পেছনে ফেলে মানবিক শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে বৈরুত। সেখানকার বাসিন্দাদের মন সাহস আর স্বপ্নে ভরপুর।

কিন্তু গত মঙ্গলবার বৈরুত বন্দরের বিশাল বিস্ফোরণ শহর ও এর উপকণ্ঠের বাসিন্দাদের অসহায় করে ফেলে। বিস্ফোরণে ১০ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এত ভয়ংকর বিস্ফোরণ লেবাননের মানুষ আগে কখনো দেখেনি। পুরো এলাকা যেন ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে। তিন লাখের বেশি মানুষ ঘর হারিয়েছে। রাস্তাজুড়ে কাচের টুকরা। নিজেদের ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরের বাইরে সড়কে আশ্রয় নিয়েছেন বাসিন্দারা। হাসপাতালগুলো আহত লোকে ভরে গেছে। রক্তাক্ত বাচ্চাদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে হাসপাতালের পরিবেশ। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। কিন্তু প্রাণ বাঁচাতে চিকিৎসকদের নিরন্তর চেষ্টার কমতি নেই। বিদ্যুৎ না থাকলেও মুঠোফোনের আলো জ্বালিয়ে অস্ত্রোপচার করছেন তাঁরা।

দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক বিভেদ কোনো কিছুই বাছবিচার করেনি এই বিস্ফোরণ। লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, দেড় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন চার হাজারের বেশি। নিখোঁজ রয়েছেন আরও অনেকে।

সিএনএনের বিশ্লেষণে বলা হয়, বিস্ফোরণস্থল পোর্ট অব বৈরুত ছিল লেবাননের সঙ্গে বহির্বিশ্বের নৌ যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র। সেটি এখন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শহরের বেশির ভাগ মানুষ এখন অনির্দিষ্টকালের দুর্দশার মধ্যে ঢুকে পড়ল। শহরের বাসিন্দা ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, বৈরুত আগের অবস্থায় আর কখনোই ফিরবে না।

আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের সহযোগী অধ্যাপক করিম মাকদিসি বলেন, ‘বিস্ফোরণের প্রভাব অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী। আমি মনে করি না বৈরুত আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। বিশ্বের সঙ্গে লেবাননের যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র আক্ষরিক অর্থেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।’

লেবানন এমনিতেই ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার কয়েকটি কেন্দ্রের মধ্যে একটি ছিল পোর্ট অব বৈরুত। অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও পণ্য শিপমেন্ট (পণ্য খালাস) অব্যাহত রেখেছিল বন্দরটি। লেবানন মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য আমদানির ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল। বন্দরটি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে শিপমেন্ট বন্ধ থাকায় কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই প্রধান খাদ্যশস্য গমের সংকট তীব্র হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও উত্তরাঞ্চলীয় শহর ত্রিপোলির অনেক ছোট বন্দর শিপমেন্টের জন্য ব্যবহার করার চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ। তবে ওই বন্দরে বড় জাহাজগুলো নোঙর করার সুযোগ–সুবিধা না থাকায় দেখা দিয়েছে উদ্বেগ।

মাকসিদি বলেন, খাদ্যসংকট দেখা দিলে নতুন করে রাজনৈতিক আন্দোলন ও অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। এই বিস্ফোরণের ঘটনা এমন একসময় ঘটল, যখন লেবাননের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা বৃদ্ধির বিষয়ে সতর্কবার্তা দেন। মঙ্গলবার সকালে কর্মকর্তারা বলেন, হাসপাতালগুলোতে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি করোনারোগী ভর্তি হয়েছে। সংক্রমণ আরও বাড়ছে এবং তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

এর ওপর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বিস্ফোরণে আহত হাজারো ব্যক্তি। অনেক হাসপাতালও বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে কঠিন সময় পার করছে বৈরুতের মানুষ। 

সিএনএনের বিশ্লেষণ