ফিলিস্তিনিদের জন্য নতুন দুঃস্বপ্ন

সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ইসরায়েলের চুক্তির প্রতিবাদে ফিলিস্তিনে বিক্ষোভ। এ সময় বিক্ষোভকারীদের হাতে থাকা ব্যানারে আরবিতে লেখা ছিল ‘স্বাভাবিকীকরণের নামে বিশ্বাসঘাতকতা’। গাজা উপত্যকায় গত শুক্রবার।ছবি: এএফপি

ফিলিস্তিনিদের জন্য ১৬ টন চিকিৎসাসহায়তা নিয়ে গত মে মাসের এক রাতে ইসরায়েলের তেল আবিবের মাটিতে অবতরণ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি উড়োজাহাজ। না চাইতেই পাঠানো ওই দয়াদাক্ষিণ্য নিতে অস্বীকৃতি জানান ফিলিস্তিনি নেতারা। তাঁরা বলেছিলেন, এই চালানের বিষয়ে কেউ তাঁদের সঙ্গে কোনো রকমের সমন্বয় করেননি। ফিলিস্তিনিদের জন্য ঘটনাটি ছিল ‘বড় অপমানের’ এক আভাসমাত্র।

মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আভাস অনুযায়ী ফিলিস্তিনিদের জন্য ওই বড় অপমান ছিল গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিস্ময় জাগানো ঘোষণাটি। ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা বলেছেন, ওই দিন ঘোষণা দেওয়ার আগ পর্যন্ত এ নিয়ে কেউ তাঁদের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা, পরামর্শ করেননি। ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের কিছু অংশে অবৈধ ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ পরিকল্পনা স্থগিত করার বিনিময়ে ইসরায়েল ও উপসাগরীয় দেশ আরব আমিরাত নিজেদের সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিক করতে চুক্তি করেছে।

ফিলিস্তিন তথা আরব ভূখণ্ডে ইসরায়েলের ইহুদি বসতি স্থাপনের ওই আগ্রাসী ও জবরদখলমূলক কর্মকাণ্ড স্থগিতের সিদ্ধান্তকে কেউ কেউ হয়তো ফিলিস্তিনিদের কাটা ক্ষতে মলম লাগানো মনে করতে পারেন। তবে ফিলিস্তিনিদের কাছে এটি পিঠে ছুরিকাঘাতের মতোই। এ চুক্তি আসলে ইসরায়েলের পক্ষে এক কূটনৈতিক অভ্যুত্থান। বিপরীতে ফিলিস্তিন প্রশ্নে যুগ যুগ ধরে বিরাজমান আরব দেশগুলোর নামমাত্র ঐক্যকে ভেঙে ফেলার পদক্ষেপ।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইসরায়েল–সংযুক্ত আরব আমিরাত চুক্তি ফিলিস্তিনিদের জন্য হয়তো ‘ইসরায়েলি বসতি স্থাপন’ নামের দুঃস্বপ্নের আপাত অবসান ঘটাবে। তবে তা এক নতুন দুঃস্বপ্ন ডেকে আনবে। আর তা হলো, ফিলিস্তিনিদের বিবর্ণ ভবিষ্যতের বিষয়টি হয়তো আর কখনোই বিবেচনায় আনা হবে না।

যুক্তরাজ্যে ফিলিস্তিন মিশনের প্রধান হুসাম জমলতের মতে, এই চুক্তি শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য খুবই ক্ষতিকর। কেননা, এটি ইসরায়েলকে তার দখলদারির অবসান ও আরব বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার গুরুত্বপূর্ণ উদ্দীপনাগুলোর একটি নিভিয়ে দেবে। তিনি বলেন, এটি ইসরায়েলকে মূলত এ বার্তা দেবে যে ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড কেড়ে নেওয়া বন্ধের প্রতিশ্রুতির বিনিময়েই সে একটি আরব দেশের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।

চুক্তির পরদিন গত শুক্রবার ইসরায়েলের জনপ্রিয় পত্রিকা ইদিয়ত আহরনত–এর উচ্ছ্বসিত শিরোনাম ছিল, ‘ঐতিহাসিক চুক্তি’ ও ‘বসতির বিনিময়ে শান্তি’। কিন্তু ফিলিস্তিনের সরকার নিয়ন্ত্রিত আল–হায়াত আল–জাদিদা পত্রিকা ক্ষোভ ঝেড়ে লাল কালির শিরোনাম করে, ‘ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারের ওপর ত্রিপক্ষীয় আগ্রাসন’।

ইসরায়েল ও আমিরাতের মধ্যকার উদীয়মান এই সম্পর্ককে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইসরায়েলের রক্ষণশীল সরকার দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে ধারণা পোষণ করে আসছে, ইসরায়েলিদের দাবি–দাওয়ার বিষয়ে তারা একরোখা এবং এ নিয়ে সমঝোতায় আসতে তারা অনিচ্ছুক।

ইসরায়েল ও আমিরাতের মধ্যে চুক্তি ২০০২ সালের ‘আরব পিস ইনিশিয়েটিভ’–এর প্রস্তাবের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। আরব লিগের প্রস্তাবটিতে ইসরায়েলের প্রতি ১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের আগ পর্যন্ত বিদ্যমান সীমানা থেকে তার দখলদারি ছেড়ে দিতে অনুরোধ জানানো হয়। বিনিময়ে দেশটির সঙ্গে আরব ও এই অঞ্চলের ইসলামি দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

ব্যাপক অর্থে, আরব আমিরাতের সঙ্গে ইসরায়েলের চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে ইরানকে হুমকি হিসেবে দেখা দেশগুলোর মধ্যে এক নতুন জোটের প্রতিফলন ঘটিয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এ অবস্থায় ফিলিস্তিনিদের স্বার্থের বিষয়টি আর মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার কেন্দ্রে থাকবে না।

ফিলিস্তিনিদের বিবর্ণ ভবিষ্যতের বিষয়টি আর কখনোই বিবেচনায় আনা হবে না বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে

এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনিদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই উল্লেখ করে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের নির্বাহী কমিটির মহাসচিব ও প্রবীণ ফিলিস্তিনি মধ্যস্থতাকারী সায়েব এরেকাত বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ কখনো উপেক্ষিত বা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার নয়। আমিরাতের একজন নাগরিকও কখনো কোনো যুদ্ধে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করেননি। আমিরাত ও ইসরায়েলের মধ্যে কোনো সংঘাত নেই।

এই দৃশ্যের অপর পাশে, প্রায় এক যুগ ধরে আমিরাতের সঙ্গে ফিলিস্তিনের তিক্ত সম্পর্ক বিরাজমান। ফিলিস্তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের নথিপত্রে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়, ২০১৪ সাল থেকে রামাল্লাভিত্তিক ফিলিস্তিন সরকারকে কোনো অর্থসহায়তা দেয়নি আমিরাত। এরেকাত বলেন, ‘তারা এমনকি তাদের জাতীয় দিবসে আমাদের আমন্ত্রণ জানায় না।’

কিছু ইসরায়েলি কর্মকর্তা মনে করেন, ফিলিস্তিনে অবৈধ ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হলে সরকারের ভেতরকার ক্ষোভ প্রশমনে নেতানিয়াহু কৌশলে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারেন।

ইসরায়েল–আমিরাত ফোন লাইন চালু

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, চুক্তি সইয়ের ঘোষণার তিন দিন পর গতকাল রোববার আরব আমিরাত ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি ফোন লাইন চালু হয়েছে। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে আরব আমিরাতের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক সাড়া পাওয়া যায়নি।

করোনাভাইরাস নিয়ে যৌথ গবেষণা

আরব আমিরাতের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ডব্লিউএএমের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, করোনাভাইরাস নিয়ে যৌথ গবেষণা এবং পরীক্ষা–নিরীক্ষার কাজ চালাতে আমিরাত ও ইসরায়েলের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়েছে। আমিরাতের অ্যাপেক্স ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি ও ইসরায়েলের তেরা গ্রুপের মধ্যে গত শনিবার রাতে আবুধাবিতে ওই চুক্তি সই হয়।

এ ঘটনায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে অ্যাপেক্সের চেয়ারম্যান খলিফা ইউসেফ খোউরি বলেছেন, ‘তেরা গ্রুপের সঙ্গে এই সহযোগিতার বন্ধনে আবদ্ধ হতে পেরে আমরা আনন্দিত। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, অর্থনীতি ও কার্যকর অংশীদারত্বের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় এটিই প্রথম উদ্যোগ।’

কুয়েতের অবস্থান অপরিবর্তিত

আমিরাতের সঙ্গে চুক্তি সই করায় ইসরায়েলের ব্যাপারে নিজেদের অবস্থানে পরিবর্তন হবে না বলে জানিয়েছে কুয়েত। সরকারি সূত্রের বরাতে আল–কাবাস পত্রিকা গতকাল এই খবর প্রকাশ করেছে। তবে এ বিষয়ে কুয়েতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো বক্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি।

গাজায় ইসরায়েলের বিমান হামলা

ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে গতকাল বিমান হামলা চালিয়েছে বলে জানিয়েছে এএফপি। ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের দাবি, ফিলিস্তিনের ভেতর থেকে রকেট ও বোমা ছোড়ার জবাবে এ হামলা চালানো হয়েছে।