ধলাই নদের উৎস মুখে

ছবি: আনিস মাহমুদ
ছবি: আনিস মাহমুদ

ধলাই নদ। সিলেটের সীমান্তবর্তী এক নদ। ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে নেমে এসেছে। কোম্পানীগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ দিয়ে প্রবাহিত। উৎসমুখ ভোলাগঞ্জ। ধলাই নামকরণ কেমন করে হলো? ধবল থেকে কি? ধবল মানে সাদা। সিলেটে আঞ্চলিক ভাষায় সাদাকে ‘ধলা’ বলা হয়ে থাকে। শব্দের অপভ্রংশে হয়তো সাদা থেকে ধলা, নির্দিষ্টকরণ করতে শেষে যুক্ত হয়েছে ‘ই’। সোজাসাপ্টা নাম—ধলাই!

এসবই হচ্ছে যাত্রাপথের আড্ডা-কথা। নৌযাত্রা, তাই কথাও চলছিল কথার কথা নিয়ে বিরামহীনভাবে। গন্তব্য ধলাই নদের উৎসমুখ। গেল পাহাড়ি ঢলে উৎসমুখে পাঁচ একর জায়গাজুড়ে পড়েছে পলির মতো করে পাথরের স্তূপ। সাদা সাদা পাথর। দেখতে অবিকল বিছনাকান্দির মতো। সাদা পাথরের আরেক বিছনাকান্দি!

গত ২৮ জুলাই সকালবেলা নৌপথে যাত্রা। সঙ্গী প্রথমআলোর আলোকচিত্রী আনিস মাহমুদসহ কয়েকজন সংবাদকর্মী বন্ধু। সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ মহাসড়কে সংস্কারকাজ চলছিল। গাড়ি চললেও ভোগান্তি বেশি। সময়ও লাগে বেশি। বর্ষায় সচল নৌপথে স্বস্তি নিয়ে যাতায়াত।

সিলেট সদর উপজেলার উমাইরগাঁওয়ের নয়াবাজারে নৌকাঘাট। সরাসরি কোম্পানীগঞ্জ। জনপ্রতি ভাড়া ১০০ টাকা। কোম্পানীগঞ্জ গিয়ে আছে আরও দুটি ঘাট। টুকেরবাজার ও ভোলাগঞ্জ। এঘাট থেকে ওঘাটে গেলে ভাড়া বাড়ে ৫০ টাকা। আমরা দলবদ্ধ। তাই এঘাট-ওঘাটে যেতেও বাধা নেই। ভাদেশ্বরা নদী হয়ে পাথরচাউলি হাওর দিয়ে ধলাই নদে ঢুকল নৌকা। গল্প, আড্ডা ফুরানোর আগেই এক ঘণ্টা ১০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম কোম্পানীগঞ্জ। ডাকবাংলোতে যাত্রাবিরতি দিয়ে এবার সোজা গন্তব্য সাদা পাথরের বিছানার খোঁজে।

ধলাই নদের বুকে আছে বিরাট সেতু। সিলেট বিভাগের দীর্ঘতম এ সেতুর নিচে পলি-বালুর স্তূপ পড়েছে। সেতুর রূপ ভরা বর্ষায়ও জলতরঙ্গহীন। যাওয়ার পথে বাঁ দিকে একগুচ্ছ গ্রাম। নাম গুচ্ছগ্রাম। সেখানে ধলাই প্রমত্তা। তীর ভাঙছে দেখার মধ্যেই। ঢেউ আর পাহাড়ি ঢলের ধকল গুচ্ছগ্রামকে সইতে হয় পুরো বর্ষাকাল। যেতে যেতে ডান দিকে ব্রিটিশ ঐতিহ্যের রজ্জুপথের (রোপওয়ে) সুবিশাল স্থাপনা। এ জায়গা পাড়ি দিতেই ধলাই নদের ঘোলা জল স্বচ্ছ হয়ে দেখা দিল। যেন কোনো নীল নদ। যত এগোয় নৌকা, তত স্বচ্ছ নীল পানি। এর মধ্যে আকাশে হেলান দিয়ে থাকা পাহাড় আসে দৃষ্টিসীমায়।

দেখতে সেই বিছনাকান্দির মতোই। ঘন সবুজ পাহাড়ের ভাঁজ থেকে নেমে এসছে সরু ঝরনা। ধলাই নদের জলপ্রবাহের উৎস এই ঝরনার পানি। নৌকা ভেড়ে তীরে। না তীর নয়, পাথরের স্তূপে। পাথরগুলো সব সাদা। ছোট, মাঝারি, বোল্ডার আকৃতির পাথর। সাদার মধ্যে নিকষ কালো পাথরও আছে। কোনোটি খয়েরিও। পাথর মাড়িয়ে ঝরনার আবাহন। কোথাও হাঁটুসমান আবার কোথাও কোমরপানি। পাথরের ওপর দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে গিয়ে তৃষ্ণার্ত ধলাইয়ের মুখে।

সমতল থেকে ওপরে তাকালেই পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে মেঘের আনাগোনা। সাদা মেঘের ভেলা। বাংলাদেশ সীমানার ওপারে লুংলংপুঞ্জি। তারপর বৃষ্টিবহুল চেরাপুঞ্জি। দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। পাহাড়ি ঝরনা হয়ে চেরাপুঞ্জির বৃষ্টির পানি এসে পড়ে এখানে। বরফ গলার মতো ঠান্ডা পানি। বেশিক্ষণ গা ভেজালে শরীরে শীতের কাঁপন লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়।

পুরো এলাকা বাংলাদেশ ভূখণ্ডের। সীমান্তের শূন্যরেখা (জিরো লাইন) হওয়ায় আছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের বিশেষ ফাঁড়ি। তাহলে নতুন করে দেখা কেন? এ প্রশ্নের জবাবটা পেলাম কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ আবুল লাইছের কাছে। এবার দৃশ্যমান হয়ে ওঠার পেছনে গল্প হচ্ছে, গেল পাহাড়ি ঢলের সময় যত্রতত্রভাবে পাথর উত্তোলন করতে দেওয়া হয়নি। পুরো এলাকা অনেকটা সংরক্ষিত ছিল। বলতে গেলে প্রশাসন আগলে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ঢলের পানি নামার পরপরই বিছনাকান্দির মতো দেখাচ্ছে।

ছবি: আনিস মাহমুদ
ছবি: আনিস মাহমুদ

মানুষের দেখতে আসা শুরু সর্বশেষ ১৭ জুলাই পাহাড়ি ঢলের পর থেকে। দিন দিন দেখতে আসা মানুষের ভিড় বাড়ছে। প্রশাসনও সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড সাঁটিয়েছে। পাথরসম্পদ সংরক্ষণ ও পর্যটন সম্ভাবনার কথা। পাঁচ একর জায়গা ধলাই নদের উৎসমুখ বলে চিহ্নিত। আলাদা করে কোনো নাম নেই।

কী নামে ডাকব? হাঁটুজলে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে গোসল করছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) আবদুল করিম চৌধুরী। তিনিও নাম খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বলছিলেন, বিছনাকান্দির চেয়ে বড় পরিসর, পাথরগুলোও পরিষ্কার, পানিও স্বচ্ছ। সব মিলিয়ে আরও সুন্দর আরেক বিছনাকান্দি। কিন্তু কী নামে ডাকি, এটা খোঁজার কসরত ঢেকে যাচ্ছে জল-প্রকৃতির মুগ্ধতায়।

বিছনাকান্দি যাননি, কিন্তু ধলাইয়ের উৎসমুখে আরেক বিছনাকান্দি দেখতে এসেছেন সিলেটের মুক্তচিন্তার সংগঠন ‘সমাজ অনুশীলন’-এর সদস্যসচিব মুক্তাদির আহমদ। তিনিও জানালেন নাম না জানার কথা। বড় পাথরে বসে পাহাড়ের পানে তাকিয়ে আছেন মারুফ আহমদ মান্না। ছুটির সুযোগে পর্যটক হয়ে আসা সুনামগঞ্জের চাকরিজীবী এই তরুণের কাছে জানতে চাইলে তাঁরও একই অভিব্যক্তি। এযাত্রায় নাম না জানা নিয়ে ফিরতে হচ্ছে।

ফেরার পথে আবার ধলা-কথন। সাদা সাদা পাথর, সবই তো ‘ধলা ধলা’।

যেভাবে যাবেন

সড়কপথ: সিলেট শহর থেকে সালুটিকর। সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে ভোলাগঞ্জ। ভাড়া জনপ্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। ভোলাগঞ্জ থেকে নৌকা ভাড়া করতে হয়। সময়ভেদে ভাড়া ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা।

নৌপথ: সিলেট শহর থেকে বাদাঘাট হয়ে উমাইরগাঁও। সেখান থেকে সরাসরি ভোলাগঞ্জের নৌকা ভাড়া করা যায়। ভাড়া ২০০০ টাকা।

যাত্রা মৌসুম ও সতর্কতা

পাহাড়ি ঢলের সময় যাওয়া বিপজ্জনক। শরৎ ও হেমন্তকাল হচ্ছে এখানে বেড়ানোর সবচেয়ে ভালো সময়। সংরক্ষিত এলাকা হওয়ায় প্রবেশমুখে আছে পুলিশি পাহারা। ভেতরে আছে বিজিবির বিশেষ ক্যাম্প।