হাড়ভাঙার চিকিৎসাই চলছে খুঁড়িয়ে

সংক্রমণের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও রোগী রাখা হয়েছে বারান্দায় শয্যা পেতে। রোগীর চাপে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খান চিকিৎসকেরাও। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের এখন এই হাল। ছবিটি গত মঙ্গলবার দুপুরে তোলা l জুয়েল শীল
সংক্রমণের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও রোগী রাখা হয়েছে বারান্দায় শয্যা পেতে। রোগীর চাপে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খান চিকিৎসকেরাও। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের এখন এই হাল। ছবিটি গত মঙ্গলবার দুপুরে তোলা l জুয়েল শীল

রোগীতে ঠাসা ওয়ার্ড। শয্যা ছাপিয়ে মেঝে-বারান্দায়ও রোগী। এমনকি চিকিৎসকের কক্ষের সামনেও পাতা হয়েছে শয্যা। কারও পায়ে ব্যান্ডেজ, কারও হাত গলায় ঝোলানো। এ চিত্র চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের। এই বিভাগটি হাসপাতালের পঞ্চম তলায় হলেও চতুর্থ তলার বারান্দায় পর্যন্ত পৌঁছেছে রোগী। ১ আগস্ট হাসপাতালে গেলে দেখা যায় এই চিত্র।

চিকিৎসকেরা বলেন, ওই দিন বিভাগে (নারী ও পুরুষ ওয়ার্ড) রোগী ভর্তি ছিল ২৯০ জন। অথচ ওয়ার্ডে মূল শয্যা ৮৮টি। প্রতিদিনই এই অবস্থা। গড়ে তিন গুণ রোগী থাকে। এভাবেই চলছে চিকিৎসা। ফলে সবকিছুতেই সংকট।

সরেজমিনে দেখা গেছে, চতুর্থ তলার বারান্দায় শয্যা দেওয়া হয়েছে এক রোগীকে। তাঁর নাম আবদুল কাদের (৪০)। সড়ক দুর্ঘটনায় ডান পা ভেঙে তিন দিন আগে তিনি হাসপাতালে আসেন। প্লাস্টারের পর তাঁর জায়গা এখানে।

পাশে বসা কাদেরের স্ত্রী বলেন, চিকিৎসকেরা একবার এসে দেখে যান। কোনো অসুবিধার জন্য নার্সদের ডাকলেও পাওয়া যায় না। এ ছাড়া শৌচাগার খুব নোংরা থাকে।

এক সপ্তাহ আগে ভাঙা ডান পা নিয়ে ভর্তি হওয়া মিলন দেবনাথেরও (৬০) প্রথমে স্থান হয়েছিল চতুর্থ তলার বারান্দায়। চার দিন পর তিনি পঞ্চম তলার বারান্দায় ওঠেন। এখন মূল ওয়ার্ডের শয্যায় অপেক্ষায় রয়েছেন। মিলন দেবনাথ বলেন, এখানে অনেক সমস্যা। বৃষ্টি হলে বাইরে থেকে পানি পড়ে। শৌচাগারের সমস্যা তো রয়েছেই।

হাসপাতালের বারান্দায় পাতা শয্যায় এক রোগী l প্রথম আলো
হাসপাতালের বারান্দায় পাতা শয্যায় এক রোগী l প্রথম আলো

জানতে চাইলে অর্থোপেডিক বিভাগের রেজিস্ট্রার মো. কামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের মূল সমস্যা মাত্রাতিরিক্ত রোগী। এতে রোগীরা যেমন কষ্ট পাচ্ছে, আমরাও সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি। কোনো রোগীকে তো ফেরত দেওয়া যায় না। বেশি রোগীর কারণে মাঝে মাঝে ইনফেকশন (সংক্রমণ) হয়।’

বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে বড় অস্ত্রোপচার হয় ৩০ থেকে ৩৫টি। আর জরুরি ভিত্তিতে ছোটখাটো অস্ত্রোপচার হয় গড়ে ৭০টি।

ওয়ার্ডের সহযোগী অধ্যাপক মো. হোসাইন বলেন, এখন দুর্ঘটনা বেড়েছে। তাই রোগীও দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু রোগী রাখার জায়গা নেই। তবু রাখতে হচ্ছে।

তাঁর পাশে থাকা ওয়ার্ডের আরেক সহকারী অধ্যাপক মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, বৃষ্টি হলে বারান্দায় রোগীদের শয্যা ভিজে যায়। ইনফেকশন হয়। তার ওপর রয়েছে লোকবলের অভাব।

চিকিৎসকেরা জানান, রোগী অনুযায়ী চিকিৎসক ও নার্সের অভাব রয়েছে। মোট চিকিৎসক রয়েছেন ১৩ জন। এর মধ্যে সাতজন শিক্ষক, চারজন সহকারী রেজিস্ট্রার ও দুজন চিকিৎসা কর্মকর্তা। এ ছাড়া ৩৩ জন পোস্টগ্র্যাজুয়েশনের শিক্ষার্থী রয়েছেন। মূলত এই ৩৩ জনের কারণে ওয়ার্ডটিতে এখনো সেবা পাওয়া যাচ্ছে। এই ৩৩ জন ভাগ হয়ে এই ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেন। এ ছাড়া ওয়ার্ডে তিন পালায় মোট ২৬ জন নার্স দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ছুটির কারণে এক পালায় আটজনের বেশি পাওয়া যায় না।

এ ছাড়া রোগীদের বেশি ভোগায় শৌচাগারের অভাব। এ বিভাগে দুটি ওয়ার্ডে মোট শৌচাগার আছে আটটি। ফলে ভোগান্তির শেষ নেই।

চিকিৎসকেরা জানান, দুটি ওয়ার্ডের শৌচাগার রয়েছে ৮৮টি জনের আনুপাতিক হারে। এখন রোগী ভর্তি থাকছে তিন গুণ বেশি।

 এ ছাড়া এখানকার রোগীর স্বজনেরা ওষুধপথ্য কিনতে গিয়ে দালালের খপ্পরে পড়েন বলে অভিযোগ রয়েছে। শামসুল ইসলাম নামে রোগীর এক স্বজন বলেন, ‘৩১ জুলাই আমার ভাইয়ের অস্ত্রোপচার হয়। ওই দিন চিকিৎসকেরা একটি ওষুধের স্লিপ ধরিয়ে দিলেন। বাইরে একজন স্লিপটি নিয়ে আমাকে ওষুধগুলো কিনে দিলেন। পরে দেখা গেল ওষুধের দাম বেশি নেওয়া হয়েছে।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার কামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা রোগীদের ওষুধের স্লিপ দিয়ে বলি হাসপাতালের ভেতরের নায্যমূল্যের দোকানে যেতে। কিন্তু অনেকে সেখানে যান না। তাই বেশি দামে ওষুধ কিনতে হয়।’