মা-ই আমার নায়ক

মা রেহানা মাসউদের অনেক গুণই পেয়েছেন মেয়ে জয়া আহসান। ছবি: সংগৃহীত
মা রেহানা মাসউদের অনেক গুণই পেয়েছেন মেয়ে জয়া আহসান। ছবি: সংগৃহীত
>

আগামীকাল মা দিবস। পাঠকদের জন্য মায়ের কথাই লিখেছেন, অভিনয়শিল্পী জয়া আহসান। 

আমার মায়ের ডাকনাম কবিতা। যখন খুব ছোট ছিলাম, সবাই আমাকে ডাকত জাপানি ডল বলে। পরিচিতজনেরা আদর করে বলতেন, ‘এই পুতুলটা কে রে?’ আমি তখন ডাঁট দেখিয়ে বলতাম, ‘আমি কবিতার মেয়ে ববিতা।’

ববিতা সেই সময় চলচ্চিত্রের নন্দিত নায়িকা। না, আমি কখনো ববিতা বা নায়িকা—কিছুই হতে চাইনি। নিয়তিই যেন আমাকে এ পথে নিয়ে এসেছে।

মাকে নিয়ে লেখার শুরুতে কেন জানি না ছোট্টবেলার এই স্মৃতিটি ফিরে এল। হ্যাঁ, আমি কবিতারই মেয়ে। মায়ের অংশ থেকেই আমার জন্ম। তাই তাঁকে নিয়ে গুছিয়ে কিছু লেখা আমার জন্য খুব কষ্টের; খানিকটা অসাধ্যও বটে। আমাদের জীবনে ‘মা’ এত প্রাত্যহিক এবং নিবিড় বিষয় যে তাঁকে নিয়ে আলাদা করে কিছু লিখতে গেলে দুদণ্ড ভাবতে হয় বৈকি।

আমরা তিন ভাইবোন—আমি, কান্তা আর অদিত। মায়ের রক্ত আর ঘাম শুষেই তিনজন বড় হয়েছি। তাই আমাদের কাছে মা ঠিক মা নন, তাঁকে ভাবি আমাদের রক্ষাকর্তা।

আমাদের তিন ভাইবোনকে আদরে-শাসনে বড় করেছেন রেহানা মাসউদ, আমাদের মা। একদা তিনি ছিলেন বটে রেহানা খান, তবে বিয়ের পর নিজের নামের সঙ্গে স্বামীর নামের শেষাংশ ‘মাসউদ’ জুড়ে দিয়ে নিজেই নির্মাণ করে নিয়েছেন তাঁর অবয়ব। হাল ধরেছেন সংসারের। বাবা এ এস মাসউদ সংসারে থেকেও যেন সব সময় ছিলেন খানিক দূরে দূরে, সংসারের সুবিস্তৃত জটাজাল তেমন বুঝতেন না। ফলে মাকেই পালন করতে হয়েছে মুখ্য ভূমিকা।

মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটি খুবই অদ্ভুত। তাঁকে সালাম করতে কেমন যেন সংকোচ লাগে আমার। অন্য অনেকের মতো মাকে জড়িয়ে ধরতে পারি না। কিন্তু শারীরিক ও মানসিকভাবে মায়ের সঙ্গেই আমার বেশি মিল। তাঁর কাছ থেকে যে ভালো গুণটি আমি পেয়েছি, তা হলো ধৈর্য। মা অসম্ভব ধৈর্যশীল, আমিও বোধ হয় তা-ই। মায়ের আরও কিছু ব্যাপার-স্যাপার আছে আমার মধ্যে। মা যেমন বৈষয়িক নন, আমিও তেমনি। এমনকি আমার গলার স্বর ও বাচনভঙ্গিও অনেকটা মায়ের মতো। এখনো মায়ের গলা শুনে অনেকে জয়া বলে ভুল করেন। একই ব্যাপার ঘটে আমার ক্ষেত্রেও।

মায়ের কোলে ছোট জয়া
মায়ের কোলে ছোট জয়া


বরাবরই মাকে ভয় পেতাম আমরা। তিনি কষ্ট পান, পারতপক্ষে এমন কিছু করতাম না। ছোটবেলায় একটা ঘটনা প্রায়ই ঘটত আমাদের। মানে আমি আর আমার ছোট বোন কান্তার। তখন সপ্তম কি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। বাড়িতে কান্তা আর আমি একসঙ্গে পড়তে বসতাম। মা নিয়ম করে দিয়েছিলেন, জোরে জোরে শব্দ করে পড়তে হবে। পড়তে পড়তে খুব ঘুম পেত দুজনেরই। কান্তা আমাকে বলত, ‘আমি যখন ঘুমাব, তুমি আমাকে পাহারা দেবে, আর তুমি ঘুমালে আমি।’ বেশির ভাগ সময় দেখা যেত, কান্তা আমাকে পাহারা দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ও ঘুমালে আমি আর দিচ্ছি না। তো, এক রাতে পড়তে পড়তে কেমন যেন ঝিমুনি এল। কান্তাকে বললাম, আমি একটু চোখ বুজি, তুমি পাহারা দাও। এই বলে দুচোখের পাতা যেই এক করেছি, কয়েক মুহূর্ত পরই সচকিত হলাম হাততালির শব্দে। হাততালি দিতে দিতে মা মুখে উচ্চারণ করলেন, ‘বাহ্! বাহ্! বাহ্! ভালোই তো! এ জন্যই এত কষ্ট করছি।’—এই যে এতটুকু বললেন তিনি, এতেই আমার হয়ে গিয়েছিল।

মা জানতেন কখন কী করতে হবে। আজ নির্দ্বিধায় বলি, মায়ের কারণেই আমি এত দূর। আমার ওপর তাঁর এই বিশ্বাস আছে যে তাঁর শিক্ষায় শিক্ষিত আমি জীবনে চলার পথে কোনো ভুল পদক্ষেপ নেব না।

শেষ পর্যন্ত মা-ই আমার নায়ক। মনে আছে, একসময় কী পরিশ্রমই না করেছেন আমাদের জন্য। তিন ভাইবোনের পড়াশোনা যেমন তদারক করেছেন, একইভাবে সামলেছেন সংসার। ঢাকা শহরে কয়েকটি বুটিক হাউস চালিয়েছেন, সেই নব্বইয়ের দশকে। নিজে হাতে শাড়িতে ব্লক করেছেন। এত বেশি ব্লকের কাজ করেছেন যে হাতের কবজিটি ফুলে গেছে। ফলে মায়ের সেই ফোলা হাতের জন্য এখন আর মাপমতো চুড়ি মেলে না। কোথাও গেলে মায়ের জন্য বড় মাপের চুড়ি কিনি আমি, তাঁর হাতের মাপে যদি মেলে।

মায়ের দিকে তাকিয়ে আজকাল খুব অপরাধবোধ জাগে। আমাদের জন্য এত কিছু করলেন যে মানুষটি, কাজকর্মের ব্যস্ততায় তাঁকে এখন সেভাবে সময় দিতে পারছি না আমি। যদিও কোথাও বেড়াতে গেলে তিনিই আমার ভ্রমণসঙ্গী।

আমার মায়ের বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা দেখে অবাকই হই। এই সামান্য পানি দেখে উচ্ছল হয়ে উঠছেন, ওই আইসক্রিম পেয়ে বাচ্চাদের মতো দিলখুশ হয়ে যাচ্ছেন। আবার ছাদের বাগানে নাইট কুইন ফুটলে আনন্দে মাতিয়ে তুলছেন বাড়ি। এই-ই তো আমার মায়ের অবয়ব।

সবকিছুর পর মায়ের মুখে তাকিয়ে অনির্বচনীয় এক শান্তি পাই। তাকাতেই দেখি, এক হাসিমাখা মুখচ্ছবি। কী স্নিগ্ধ, কী অমলিন সেই হাসি! দিন শেষে ওই হাসিমাখা মুখই তো আমার পরম আশ্রয়।

লেখক, অভিনয়শিল্পী