ভালোবাসার চেয়ে বড় উপহার কী আছে?

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

‘উপহার’ একটি গৃহপালিত প্রাণী। এর দুটি শিং, একটি লেজ, দুটি কান, দুটি চোখ আছে কি না জানি না। তবে ঠ্যাং আছে, তা জানি। না হলে গিফট এমন হাঁটাচলা করে কী করে! এই কথাটা বলে আমার বন্ধু, প্রতিবেশী জাবেদ সাহেব (ছদ্মনাম) বলছিলেন, ‘আজকাল উপহারের মধ্যেও ভেজাল ঢুকে গেছে, বুজজুইন?’ কথাটার শেষে একটু নেত্রকোনার টান ছিল কি না বুঝিনি। তবে নেত্র-কোনায় কিছুটা জল দেখেছিলাম।

বিবাহবার্ষিকীতে বড় দুলাভাইয়ের দেওয়া এক মাইক্রোওয়েভ ওভেন তাঁর সংসার জীবনে এমন ম্যাক্রো-ওয়েভ ধাক্কা এনে দেবে, ভাবতেই পারেননি। দুলাভাই প্রায়ই ব্যবসার কাজে চীনে যান। সেখান থেকে নাম না জানা, বাংলাদেশে পাওয়াই যায় না এমন অত্যাধুনিক ওভেন কিনে এনেছেন। এই ওভেন পাওয়ার পর থেকে দাম্পত্য জীবন শীতল হতে শুরু করল জাবেদ সাহেবের।

বিয়ে-সংসার তো আর ফ্রিজের তরকারি না যে ওভেনে ঢোকালেই গরম হয়ে যাবে। আর তাঁর স্ত্রীর কথা সত্যি হলে, এই ওভেনে সেটা সম্ভবও ছিল না। এই ওভেনে খাবার ঢোকালে নাকি সেটা আরও বেশি ঠান্ডা হতো। ডিপ ফ্রিজের চেয়েও নাকি বেশি ঠান্ডা। স্ত্রী এমন দাবিও করছিলেন, গরম করার জন্য দুধ ঢুকিয়ে তিন মিনিটের টাইমার দিয়ে শেষে দেখেন, দুধ নাকি কুলফি হয়ে গেছে!

জাবেদ সাহেব কথাটা পরখ করতে পারেননি। তাই জানেন না, সমস্যা উপহারে নাকি উপহারদাতার মধ্যে। তাঁর বোন বনাম স্ত্রীর উপহার-সংক্রান্ত ঝামেলাটাও নতুন নয়। আপদ বিদায়ের সহজ রাস্তা ধরলেন। উপহারটা র‍্যাপিং পেপারে মুড়িয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই চালান করে দিলেন বন্ধুর বিয়েতে। বললেন, ‘অফিসের ছুটিতে চায়না গেছিলাম দোস্ত। তখনই তোর জন্য...।’

এটা গত কোরবানির ঈদের আগের ঘটনা। কোরবানির ঈদে জাবেদ সাহেব বদলি হয়ে আসা অফিসের নতুন সহকর্মীকে সপরিবার দাওয়াত করেছিলেন। ভদ্রলোক আদবকেতা জানেন বটে! আগে দাওয়াত পেলে মানুষ সঙ্গে আরও দুটি মানুষ নিয়ে যেত। এখন উপহার নিয়ে যায়। এটাই এখনকার কেতা। র‍্যাপিং পেপারের ঢাউস আকার দেখেই হয়তো জাবেদ সাহেবের স্ত্রী অনির্ধারিত মেন্যু হিসেবে আয়েশে পায়েশও খাওয়ালেন। অতিথিদের হাসিমুখে বিদায় দিয়ে, চটজলদি মোড়ক খুলতেই চক্ষু চড়কগাছ! না, কোনো ভুল নেই। এমনকি হাতলের দাগটাও মিলে গেল। এ সে-ই। কয়েক হাত ঘুরে সেই ওভেন আবার ফিরে এসেছে জাবেদ সাহেবের ঘরে।

এতটুকু পড়ে কেউ কেউ মিটিমিট হাসছেন। ভাবছেন, যাক, এমন কাণ্ড শুধু আমি করি না। উপহারের ধার-উধার বেশ চলছে দেখি। ভায়া, আপনি শুধু শিকারি? শিকারও নন তো! সাধে কি জাবেদ সাহেব বলেছেন, উপহারের মধ্যেও ভেজাল ঢুকে গেছে আজকাল।

তবে ভেজাল শুধু একই উপহারের হাতবদল নিয়ে নয়। সহকর্মী ইকবাল সাহেব গল্প করছিলেন এই তো গতকাল। বলছিলেন, তাঁদের পাশের বাসায় এক আদর্শ দম্পতি থাকেন। আদর্শ বলতে ৯৯ শতাংশ আদর্শ। শুধু প্রতিবার ঈদ এলে লেগে যান ঝগড়া। কারণ? সেই উপহার।

 ‘তোমার মায়ের শাড়িটা তো ভালোই কিনলা, আমার মায়ের বেলায় কিপটামি?’

 ‘তোমার বাবার পাঞ্জাবিটা তো দারুণ! বাহ্‌! হাজার হোক নিজের বাবা। আমার বাবা তো আর তোমার আপন কেউ না!’

 ‘আমার ছোট ভাইবোনদের জন্য...।’

ভাবছেন সহজ সমাধান তো আছেই। সবার জন্য একই ডিজাইনের জামাকাপড় কিনলেই তো হয়। তা কি আর তাঁরা করেননি? গতবার এই বুদ্ধিটাই বের করা হয়েছিল। তাতেও নাকি ঝামেলা মেটেনি। একজনের গিফটের প্যাকেট একটু ছেঁড়া ছিল। তাতেই যত গন্ডগোল!

ভেজালের ভিড়ে কি একটুও শান্তি নেই? আছে! তাহলে আরেকটা গল্প বলি। এটাও আমার পরিচিত এক পরিবারের গল্প। আপনার-আমার চেনা আর দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই সেই পরিবার।

বাবার আয় সামান্য। এই দিয়েই প্রতিবার ঈদে কেনাকাটা হয়। কেনাকাটা শেষে দেখা যায়, সবার কিছু না কিছু হয়েছে। কেউ হয়তো একটু বেশি দামের জামা-জুতাটা কিনেছে; কারও দামটা একটু কম। এ নিয়ে ভাইবোনদের মধ্যে যে খুনসুটি হয় না; তা না। হয়। চাঁদরাতে এ নিয়ে মিষ্টি ঝগড়াও চলে।

কিন্তু প্রতিবার ঈদের নামাজ পড়ার জন্য সবাই তৈরি হতে গিয়ে দেখে, বাবা পুরোনো পাঞ্জাবিটাই পরছেন। আহা, তা-ই তো। বাবার জন্য তো কিছু কেনা হলো না এবারও! আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবা একটা পার্শ্বচরিত্র যেন। বাবা নিয়ে আমাদের তেমন আদিখ্যেতাও নেই। বাবা দিবসে বড় বড় আবেগমাখা স্ট্যাটাসও আমরা তেমন লিখি না, যতটা লিখি মাকে নিয়ে।

আমরা যত বড় হই, বাবাদের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব তত বাড়ে। মায়ের সঙ্গে সম্পর্কটা কিন্তু ঠিক থাকে। তখন মায়ের কাছেই আমাদের যত আবদার।

সেই পরিবারটাও ব্যতিক্রম কিছু নয়। সেই পরিবারের বাবাও আর সব বাবার মতো। হয়তো কখনো টাকার টান পড়ে। হয়তো ধারদেনা করেন। হয়তো বিপদের দিনের কথা ভেবে যক্ষের ধনের মতো লুকিয়ে রাখা সঞ্চিত টাকায় হাত দেন। তবু বাবা কাউকে নিরাশ করতে চান না। সবাইকে দিয়েই তাঁর আনন্দ। ঈদের দিনে সবার পরনের নতুন জামার ঘ্রাণের মধ্যেই তিনি ভুলে যান নিজের তিলে পড়া পাঞ্জাবিটার কথা।

সেই পরিবার এবার কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে আপনাকে চুপি চুপি বলি। তারা ঠিক করেছে, এবারও কেনাকাটা করতে গিয়ে বাবাকে সঙ্গে নেওয়া হবে না। বাবা কি আর এ যুগের পছন্দের সঙ্গে মানানসই? বাবা তো সেকেলে। বাবা শুধু টাকা দিলেই হবে।

এবারও ঈদের কেনাকাটায় বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে হইহুল্লোড় করে বের হবে সব ভাইবোন। ফিরবে ঈদের কেনাকাটা করে। তারপর ঈদের দিন নতুন প্যাকেট থেকে বের করে আনবে নতুন জামা। আর দেখা যাবে, তারা নিজেদের জন্য কিছুই কেনেনি। বরং সব টাকা দিয়ে বাবার জন্য উপহার কিনেছেন। পাঞ্জাবি, দুটো কি তিনটে প্যান্ট, এক জোড়া জুতা আর এক জোড়া স্যান্ডেল। আর একটা মোবাইল ফোন। এই যুগে বাবাটা এখনো কী এক ভাঙা মোবাইল ব্যবহার করেন, সেটাও যে তারা আবিষ্কার করেছে অনেক পরে।

তারপর সব উপহার নিয়ে হাজির হবে বাবার কাছে। বাবা কী ভীষণ চমকে যাবেন বলুন! কেঁদে দেবেন কি? কে জানে! না, তাঁর হিসাবের চোখে অনভ্যস্ত এসব দামি দামি উপহার পেয়ে নয় কারণ সন্তানদের বাদ িদয়ে নিজে ঈদের উপহার পেতে কোনো বাবাই স্বস্তি পাবেন না। তবে চোখে জল আনবে ভালোবাসা। ভালোবাসার চেয়ে বড় উপহার আর কী আছে বলুন!