কিছু ক্ষেত্রে কেমোর কষ্ট ছাড়াই ক্যানসারের চিকিৎসা

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

মেয়েটির নাম ফিলিস লাচেত্তি। ২০০৭ সালে ভয়ংকর এক তথ্য জেনেছিলেন ফিলিস। ডান দিকের স্তনে অস্বাভাবিক লাম্প (একধরনের চাকা) ধরা পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের মন্টেফিওর মেডিকেল সেন্টারে নার্স হিসেবে কাজ করতেন লাচেত্তি। চিকিৎসকেরা প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। কপালে দুঃখ ছিল। ক্যানসারের সংক্রমণ ধরা পড়ল। লাচেত্তি সিদ্ধান্ত নিলেন, ম্যাসটেকটমি করবেন। অর্থাৎ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শরীরের এই অংশ তাঁকে ফেলে দিতে হবে।

লাচেত্তির চিকিৎসক জানালেন, ক্যানসারের সংক্রমণ রোধে তাঁকে কেমোথেরাপি নিতে হবে। পারিবারিক ইতিহাসের কারণেও ক্যানসারের ঝুঁকিতে ছিলেন লাচেত্তি। তাঁর বোন ও বাবা মারা যান লিউকেমিয়ায়। ভাই মারা যান থাইরয়েড ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে। চিকিৎসক পরামর্শ দেন, ক্যানসার ঠেকাতে কেমোথেরাপিই তাঁর জন্য সবচেয়ে ভালো উপায়।

এ কথা শুনে পিলে চমকে যায় লাচেত্তির। ভাই ও বোনের কেমো নেওয়ার যন্ত্রণা দেখেছেন তিনি। সেই যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে তাঁকেও যেতে হবে? এ ছাড়া কি আর কোনো উপায় নেই?

টাইম সাময়িকীতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, কিছু ক্ষেত্রে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসার নতুন খবর। যখন হতাশায় ডুবে যাচ্ছিলেন লাচেত্তি, তখনই আশার আলো জ্বালালেন, চিকিৎসক জোসেফ স্পারানো, আলবার্ট আইনস্টাইন কলেজ অব মেডিসিনের চিকিৎসা এবং স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের অধ্যাপক এবং মন্টেফিওরের চিকিৎসাসংক্রান্ত গবেষণার সহযোগী পরিচালক। ক্ষেত্রবিশেষে ক্যানসার রোগীরা কেমোথেরাপি এড়িয়ে কীভাবে সুস্থ থাকতে পারেন, তা নিয়ে কাজ করছেন স্পারানো। ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর লাচেত্তির মতো যাদের অস্ত্রোপচার করা হয়েছে বা রেডিয়েশন দেওয়া হয়েছে, তাঁদের নিয়ে কাজ করেন তিনি। অস্ত্রোপচার বা রেডিয়েশনের পরে ক্ষেত্রবিশেষে কেমোর বদলে রোগীদের হরমোনথেরাপি দেন। এই থেরাপিতে ইস্ট্রোজেনের মতো হরমোনগুলোকে নিয়ন্ত্রিত করে দেওয়া হয়। চিকিৎসা নিতে এসে লাচেত্তি ব্যাপারটিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনিও যোগ দেন সমীক্ষায়।

১০ বছর কাটে। এখন লাচেত্তি সেদিনের ওই সিদ্ধান্তের জন্য নিজেকে ধন্যবাদ দেন। তিনি কেবল হরমোনথেরাপিই নিয়েছেন। একবারও কেমো নেননি। লাচেত্তি ও বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ১০ হাজারেরও বেশি নারী ওই সমীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। দেখা গেছে, ক্ষেত্রবিশেষে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা কেবল কেমোথেরাপির ওপর নির্ভর করে না। লাচেত্তি বলেন, শুরু থেকে এই সমীক্ষায় যুক্ত থাকায় তিনি এখন নিশ্চিত যে, সব রোগীরই কেমো নেওয়া জরুরি নয়।

যুক্তরাষ্ট্রে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত ২ লাখ ৬০ হাজার নারীকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। দেখা যায়, হরমোনথেরাপি নেওয়ার পর তাঁদের ক্যানসার ছড়ায়নি। অ্যান্টিইস্ট্রোজেন হরমোনথেরাপি দিলে ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে থাকে।

কেমোতে ভয় পান—এমন নারীদের জন্য স্পারানোর টেইলরএক্স (TAILORx) প্রক্রিয়াকে প্রায় যুগান্তকারী বলা যেতে পারে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ সুপারিশ করেছে, স্তন ক্যানসার শনাক্ত হয়েছে—এমন নারীদের অস্ত্রোপচার অথবা রেডিয়েশন দেওয়া হয়। তবে বাড়তি সুরক্ষার জন্য তাঁদের কেমোথেরাপিও দেওয়া হয়। আরও কোনো কোষ যাতে ক্যানসার আক্রান্ত না হতে পারে, সে জন্যই এমনটা করা হয়।

স্পারানোর হরমোনথেরাপিতে রোগীর অবস্থা অনুযায়ী কেমো ছাড়াই ক্যানসারের সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব। চিকিৎসকেরা বলেন, কেমোথেরাপির কারণে অনেকের বমি, ঘুমের সমস্যা, অবসাদ দেখা দেয়। যদিও সম্প্রতি কেমোর নতুন কিছু পদ্ধতির কারণে এ ধরনের প্রভাব অনেকটা কমে এসেছে। কিন্তু কিছু গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, কেমোর কারণে শরীরে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবও পড়তে পারে।

আমেরিকান সোসাইটি অব দ্য ক্লিনিক্যাল অঙ্কোলজির বার্ষিক সভায় বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে এটি প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখা যায়, ক্ষেত্রবিশেষে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত নারীদের কেমোর প্রয়োজন নাও হতে পারে। কেমোর প্রয়োজন আছে কি না, তা নিশ্চিত হতে নারীদের বিশেষ একধরনের জিনগত পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষার নাম অঙ্কোটাইপ ডিএক্স। এই পরীক্ষায় নারীদের আবার ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কতটা তা জানা যায়। যাঁদের এ ধরনের ঝুঁকি কম থাকে, সেই সঙ্গে বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের জন্য হরমোনথেরাপিই যথেষ্ট। সাধারণত, পাঁচ বছর ধরে নারীরা এই থেরাপি নেন। স্পারানো বলেন, এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, একই পর্যায়ের রোগীদের মধ্যে যাঁরা হরমোনথেরাপি ও কেমো নিয়েছেন, আর যাঁরা শুধু হরমোনথেরাপি নিয়েছেন, উভয় পক্ষের ৯৪ শতাংশই ক্যানসার থেকে রক্ষা পেয়েছেন।

স্পারানোর নতুন এই পদ্ধতির সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন লস অ্যাঞ্জেলেসের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ব্রেস্ট অঙ্কোলজি প্রোগ্রামের পরিচালক সারা হারভিৎজ। তিনি বলেন, ‘প্রায়ই মনে হয়, কেমো দিয়ে আমরা ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের বেশি বেশি চিকিৎসা দিচ্ছি।’

অঙ্কোটাইপ ডিএক্স পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যানসারে আবার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—এমন বেশ কয়েকটি জিন শনাক্ত করা সম্ভব। যাঁদের ঝুঁকি বেশি, তাঁদের কেমোথেরাপির প্রয়োজন। তবে অঙ্কোটাইপ ডিএক্স পরীক্ষার আগে কাদের আবার ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া কঠিন ছিল। নিউইয়র্কে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারের ব্রেস্ট ক্যানসার প্রোগ্রামের পরিচালক ডন হার্শম্যান বলেন, ‘রোগীদের আমি প্রায়ই বলি, কেমোথেরাপির উপকার নিয়ে আমরা নিশ্চিত নই।

প্রথমে টেইলোরএক্স পরীক্ষায় দেখা যায়, ক্যানসার আবার ফিরতে পারে—এমন ঝুঁকি যাঁদের কম, অর্থাৎ যাঁদের ঝুঁকি ১০ শতাংশেরও নিচে, তাঁদের কেমোর দরকার নেই। পরে ঝুঁকি ২৫ শতাংশের বেশি—এমন ৬০ হাজার নারীকেও এই সমীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মেমোরিয়াল স্লোন ক্যাটারিং ক্যানসার সেন্টারের এভিলিন এইচ লডার ব্রেস্ট সেন্টারের চিকিৎসাবিষয়ক পরিচালক ল্যারি নর্টন বলেন, এ ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে হরমোনথেরাপিতে ক্যানসারের কোষ ধ্বংস করা যায়। কেমোথেরাপিতে এর চেয়ে বেশি লাভ হয় না।

নতুন এই হরমোনথেরাপি মেনোপজ-পরবর্তী নারীদের, অর্থাৎ যাঁরা ৫০ বছর পার হয়েছেন, তাঁদের ওপর পরিচালিত হয়। এই বয়সে স্তনে টিউমার সৃষ্টিকারী ইস্ট্রোজেনের স্তর এমনিতেই নেমে যায়। কমবয়সী নারীদের ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি আবার ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমাতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে আগে মেনোপজ হওয়া এবং ইস্ট্রোজেন কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

হারভিৎজ বলেন, ক্যানসারের নতুন এই চিকিৎসাপদ্ধতিতে রোগীদের জীবনমান উন্নত হবে। ক্ষতিকর প্রভাবও দূর করা যাবে। এতে করে খরচাও কমে। অঙ্কোটাইপ ডিএক্স টেস্টে খরচ পড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার ডলার। আর কেমোথেরাপিতে ২০ হাজারেরও বেশি ডলার ব্যয় করতে হয়।

যুক্তরাজ্যের বাকিংহ্যাম্পশায়ার হেলথকেয়ার এনএইচএস ট্রাস্টের ব্রেস্ট অ্যান্ড অঙ্কোপ্লাস্টিক সার্জন ফরিদ আহমেদ বাংলাদেশে স্তন ক্যানসার চিকিৎসা নিয়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের গবেষণা বাংলাদেশের কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্যানসারের চিকিৎসায় কেমোথেরাপি অবশ্যই প্রয়োজনীয় এবং কার্যকর। তবে সব ক্যানসারের সব পর্যায়ে কেমোথেরাপির প্রয়োজন নেই। বয়স, শারীরিক অবস্থা, ঝুঁকির মাত্রা বিবেচনা করে অনেক রোগীর কেমোথেরাপি প্রয়োজন। আবার রোগীদের অবস্থা বিবেচনা করে অনেক ক্ষেত্রে হরমোনথেরাপিই যথেষ্ট। 

ফরিদ আহমেদ আরও জানান, প্রয়োজন না হলে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীকে কেমোথেরাপি দেওয়া বাদ দিতে হবে। সে জন্য চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ, রোগী ও তাঁর পরিবারের সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। একই সঙ্গে ম্যাসটেকটমি এড়াতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিত বলেও মত দেন তিনি।

কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়ে জানান কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সার্জন (অঙ্কোলজি) মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। বলেন, বিভিন্ন স্তরে কেমোর প্রভাব বিভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন: বমি বমি ভাব, ক্ষুধামান্দ্য, চুল পড়ে যাওয়া, চামড়া কালো হয়ে যাওয়া, ত্বকে জ্বালাপোড়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া। হরমোনথেরাপির বিষয়ে তিনি বলেন, ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের হরমোনথেরাপি দেওয়ার বিষয়টি হরমোনের প্রতি সংবেদনশীলতার ওপর অনেকটা নির্ভর করে। রোগীর অবস্থা বিবেচনা করেই হরমোনথেরাপি, রেডিয়েশন বা কেমো দেওয়া হয়।

ফেরা যাক মার্কিন নারী লাচেত্তির কথায়। কেমোর যন্ত্রণা ও ক্ষতিকর প্রভাব ছাড়াই ক্যানসারকে জয় করতে পেরেছেন তিনি। এখন শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে অনেকটাই ভালোবোধ করেন। বোনের দুরবস্থার কথা মনে করে মন খারাপ হয় ল্যাচেত্তির। কেমো নেওয়ার জন্য তাঁর বোনকে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়েছিল। ১১ মাসেরও বেশি সময় হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। কিন্তু লাচেত্তি চাকরি করেও চিকিৎসা চালিয়ে গেছেন। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। ক্যানসারের নতুন এই চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে সমীক্ষায় অংশ নিতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন লাচেত্তি।