বৃষ্টির হাওরে

এমনই সুন্দর টাঙ্গুয়ার হাওর। ছবি: তারেকুল ইসলাম
এমনই সুন্দর টাঙ্গুয়ার হাওর। ছবি: তারেকুল ইসলাম

প্রথম যেবার হাওরে গিয়েছিলাম, থাকা, খাওয়া, ঘুম—কোনো কিছুর ঠিক ছিল না। ভাটি অঞ্চলের বাউলদের দরাজ গলার গান আর সংগত, প্রকৃতির রূপসুধা—একদম ঘোর লাগা স্বপ্নের মতো কেটেছিল সময়। স্থানীয় লোকজনের চলাচলের জন্য ব্যবহার করে বজরার মতো কিছু নৌকা। নৌকার ছই মজবুত। ছইয়ের ওপর বসে দিনমান হাওরের পানি, আকাশ, মেঘ দেখে সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। হঠাৎ হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টিতে অবগাহনও করা যায়। কিন্তু রাতে থাকা বা গোসল-বাথরুমের জন্য খুব অসুবিধে। টাঙ্গুয়ার হাওরের রূপে আমরা এতটাই মোহিত ছিলাম, এসব অসুবিধা খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি।

এই বছর বর্ষায় আবার গেলাম সেই হাওরে। এবার ব্যবস্থা খুব পাকা। ছুটি ডট কম আর সিলভার ওয়েভ নামের দুটো পর্যটন প্রতিষ্ঠান বড়সড় নৌযান ভাসিয়েছে হাওরের জলে। কেবিন, বাথরুম, খাবার—সব ব্যবস্থাই রয়েছে। রাতভর বাসে চড়ে ভোরের দিকে সুনামগঞ্জে পৌঁছে হাসন রাজার ঘাট থেকে ‘এমভি কোকিলমণি’ নৌযানে উঠলাম। সতেজ হয়ে নাশতা সেরে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ডেকে গেলাম। গিয়ে দেখি আঁকাবাঁকা সুরমা নদীর বুক চিরে এগিয়ে চলছে যান্ত্রিক জলযান।

নদীর দুপাশজুড়ে রয়েছে সবুজ ধানখেত, লোকালয় অথবা ছোট ও মাঝারি হাওর। বহুদূরে মেঘের তটরেখার সঙ্গে আবছা আবছা চোখে পড়ে মেঘালয়ের নীল-সবুজ পাহাড়। আমাদের জলযানের চারদিকে কেবল পানি। সে এক আশ্চর্য জলরাশি। কখনো মেঘ, কখনো মুষলধারে বৃষ্টি, কখনো চনমনে রোদ। এখানে-ওখানে জলের বুক থেকে মাথা তুলেছে হিজল, করচ, নলখাগড়া আর হেলেঞ্চার ঝোপ। কোথাও কোমরপানি, কোথাও গাঢ় সবুজের তল না দেখা অতল জল।

এই জলযানেই ঘোরা হলো হাওরে
এই জলযানেই ঘোরা হলো হাওরে

শীত মৌসুমে হাওরের সৌন্দর্য অজস্র-সহস্র অতিথি পাখির মেলা। বর্ষাতেও থাকে স্থানীয় নানা জাতের পাখির সমাবেশ—পাতিহাঁস, পানকৌড়ি, শকুন, ডাহুক, বালিহাঁস কত কী। এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ আর মেঘ এবং হাওরের বিপুল জলরাশিতে তার প্রতিফলন, যেন বিশাল এক আয়না। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ব্রাক্ষণবাড়িয়া আর নেত্রকোনা জেলায় রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় হাওর। আমাদের গন্তব্য টাঙ্গুয়ার হাওর। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলাজুড়ে এ হাওর। হাওর দীঘি নয়, খাল নয়, বিলও নয়। আশ্চর্য জলরাশি। যেন সাগরের ছোট সংস্করণ। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ৩০টা ঝরনার পানি নেমে এসে বর্ষা মৌসুমে ভরে ওঠে এসব হাওর। এলাকার মানুষ নৌকায় চড়ে মাছ ধরে, গান গেয়ে, গান বেঁধে কাটিয়ে দেয় পুরো বর্ষাকাল। শীতে হাওর শুকিয়ে গেলে বিস্তীর্ণ এলাকায় ধান চাষ হয়।

বিকেলের দিকে আমরা যখন টাঙ্গুয়ার উপকণ্ঠে, তখন কেউ কেউ নেমে গেলেন পানিতে সাঁতার কাটতে। একদল গেলেন ওয়াচ টাওয়ারে, সেখান থেকে দেখা যায় পুরো দিগন্ত আর টাঙ্গুয়ার বিপুল বিস্তৃতি। একটু চুপ করে থাকা গেলে, সেখান থেকে একধরনের গাঢ় নীরবতা-নিস্তব্ধতা অনুভব করা যায়। দিগন্তের প্রান্তে মেঘালয়ের পাহাড়গুলোর চূড়ায় ছেঁড়া তুলার মতো ঝুলে আছে মেঘ, দৃশ্যটাই বড় অপার্থিব।

সন্ধ্যার আগে টেকেরঘাটে জাহাজ নোঙর ফেলল। ফানুস ওড়ানো হলো, শুরু হলো হাসন রাজা আর শাহ আবদুল করিমের গান। রাতে বারবিকিউ করে জম্পেশ খাওয়া-দাওয়ার পরেও তার রেশ থেকে গেল।

পরদিন ভোর পাঁচটায় ওঠা। টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যেই রওনা হলাম নীলাদ্রী লেক, জাদুকাটা নদী আর বারেকের টিলার দিকে। কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ স্থানীয় মোটরসাইকেলে। জায়গাগুলো এত সুন্দর, এত সবুজ, এত মনোহর, কাউকে ঠেলা-ধাক্কা দিয়েও নড়ানো যায় না। ছবির পর ছবি। সেলফির পর সেলফি। সবুজ পাহাড়-ঘেরা নীলাদ্রী লেকের পানি একদম নীল। যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা। এরপর বারেকের টিলা। সেখান থেকে অনেক নিচে দেখা যায় জাদুকাটা নদী। মাইলের পর মাইল ঝিরিঝিরি স্রোত আর পাথরের স্তূপ। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত একদম কাছে। মাঝেমধ্যে সীমান্ত খুঁটি।

ফেরার সময় পথে পড়ল রাজাই ঝরনা। সেখানে সবাই এক দফা গোসল করে নিল। বৃষ্টি বাড়লে সেই ঝরনা হয়ে ওঠে রীতিমতো প্রমত্তা। আশপাশে তাকিয়ে পাথর তোলার বিপুল মহাযজ্ঞ চোখে পড়ল। দূরদূরান্ত থেকে কার্গো জাহাজ এসে বসে আছে সেই পাথর নেবার জন্য। এসব পাথর দিয়ে তৈরি হবে দেশের বিভিন্ন অবকাঠামো।

জাহাজে উঠতেই জাহাজ ছেড়ে দিল। নাশতা, গোসল সেরে আবার আড্ডা আর বাউল গান। সঙ্গে উথালপাতাল বৃষ্টি। বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টি যেখানে হয়, সেই চেরাপুঞ্জি অবশ্য বেশি দূরে নয়। ফলে হাওরে বৃষ্টিও নামে ঘন ঘন। বৃষ্টির ফোঁটাগুলোও তীক্ষ্ণ আর ভারী। পথে আরেকবার লাইফ জ্যাকেট পরে পানিতে দাপাদাপি করে, সন্ধ্যা নাগাদ জলযান ভিড়ল সুনামগঞ্জ ঘাটে। রাতের খাওয়া শেষ করে জাহাজ থেকে নেমে আবার সেই ঢাকার পথ ধরা। হাওরের রূপ তো একবার-দুইবার দেখে শেষ করার নয়, বারবার তাই ফিরে ফিরে আসতেই হয়। আবার আসব হয়তো, অচিরেই।