ভাইবোন তো ভাইবোনই

বোন বিপদে পড়লে ভাই হাত বাড়িয়ে দেবেই। মডেল: অভয় ও আফরা, ছবি: সুমন ইউসুফ
বোন বিপদে পড়লে ভাই হাত বাড়িয়ে দেবেই। মডেল: অভয় ও আফরা, ছবি: সুমন ইউসুফ

বড় ভাই নীরুর জন্য অনীতা সেন ৫০ বছর অপেক্ষা করেছিল। যে ভাইয়ের সঙ্গে একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে, সেই ভাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোথায় যেন হারিয়ে গেল। মেডিকেল কলেজের ছাত্র নীরু মারা গিয়েছিল আন্দোলন করতে গিয়ে। সে কথা অনীতা সেন জীবদ্দশায় জানতে পারেনি। প্রায়ই বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার মনে হতো, ভাই বুঝি এই এল। অপেক্ষা নিরন্তর, ভালোবাসাও। অনীতা সেন ও নীরু—দুই ভাইবোনের গল্পের প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে শাহীন আখতারের অসুখী দিন উপন্যাসে।

এই বই পড়তে গিয়ে চোখের কোণে পানি জমে গিয়েছিল। অবচেতন মনের পর্দায় কি নিজের ছোট ভাইয়ের মুখ ভেসে উঠেছিল? কারণ, শুধু গল্প-উপন্যাসে নয়, বাস্তব জগতের ভাইবোনেরাও এমন। ভাইবোনের সম্পর্কের শক্তি এখানেই। ভাইবোন একই বাড়িতে থাকে, সারা দিনে এক-দুইটা বাক্যও বিনিময় হয় না কখনো কখনো। কিন্তু বোন একটু পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে ভাই তার ভালোবাসার হাত, নির্ভরতার হাত বাড়িয়ে দেয় বোনের দিকে। বড় বা ছোট যাই হোক, বোনকে নিয়ে কেউ কোনো নেতিবাচক কথা বলল, অমনি ভাই হয়ে ওঠে প্রতিরক্ষার ঢাল। কোনো খারাপ কিছু বোনকে ছুঁতে দেবে না। একই রকম বোনের ক্ষেত্রেও। ভাইয়ের জ্বর সারা রাত মাথার কাছে বসে থাকে বোন। ভাইয়ের কৃত্রিম রাগ—আহা, যাও তো। বসে থাকা লাগবে না। তেমন কিছু হয়নি। মুখে যাই বলুক, ভাই ঠিকই বোনের মমতা মাখানো ভালোবাসায় দ্রবীভূত হয়। ভাইয়ের বিপদে বোন বসে থাকতে পারে না। ছুটে আসে ভাইকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে।

ছোটবেলায় একধরনের খুনসুটি চলে। বড় হলেও কখনো তা থাকে, কখনো থাকে না। বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন নিতু। তাঁর কাজ মূলত দেশের বাইরে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, প্রায়ই দেশের বাইরে যেতে হয়। প্রথম যখন দেশের বাইরে গিয়েছিল ছোট ভাইয়ের সে কী দুশ্চিন্তা। বাড়িতে থাকতে কখনো একবেলা ঠিকঠাক কথা হয়েছে কি না, মনে করতে পারে না। কিন্তু দেশের বাইরে গিয়ে প্রতি বেলায় বোনের সঙ্গে ভিডিও কলে খোঁজখবর নিত ভাই। সেবারই নিতু প্রথম টের পায় ছোট ভাইটি দায়িত্বশীল, ঠিকই কাজের সময় কাজ করতে পারে। এরপর থেকে দেশের বাইরে গেলেও বাড়ি আর মা-বাবাকে নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তা হয় না। ছোট ভাই তাঁকে বোনকে দিয়েছে সেই নির্ভরতা।

সুজন মাঝিরে ভাইরে কইয়ো গিয়া

না আসিলে স্বপনেতে দেখা দিত বইলা

তোরা কে যাস কে যাস

...কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া

আমার ভাই ধন রে কইয়ো, নাইওর নিতো বইলা...

শচীন দেববর্মণের গাওয়া কালজয়ী এই গানের মাধ্যমে বোঝা যায় ভাইয়ের প্রতি বোনের টান। বিদ্যুৎ চলে গেলে বাড়ির ছাদে ভাইবোন মিলে গানের লড়াই খেলা, মফস্বলের বেশির ভাগ বাড়িতে হারিকেন জ্বালিয়ে লুডু খেলা হতো একটা সময়ে, এখন যাঁরা মনোপলি খেলেন তাঁরা হয়তো সেই আবেদনটা বুঝতে পারবেন না। কিন্তু এভাবেই একটা সময়ে বাড়িতে বেড়ে উঠত ভাইবোনেরা। প্রযুক্তির যুগে তাঁরা এখনো কে আগে পড়বে? হ্যারি পটার সিরিজের বই, তা নিয়ে নিয়ে কাড়াকাড়ি হয়। মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভাইবোনের সম্পর্ক দৃঢ় করতে মা-বাবার জোরালো ভূমিকা থাকতে হবে। তাঁরা যদি বাড়ির ছেলেমেয়ের মধ্যে কোনো বৈষম্য না দেখান, পার্থক্য না করেন, তাহলে তাঁরা মানবিক গুণাবলি নিয়ে বড় হবে। পরিণত বয়সে এটি কাজে দেবে।

চেনা একটি পরিবার আছে। সেই পরিবারের ভাইবোনেরা দেশ-বিদেশে থাকেন। বছরে একবার তাঁরা দেশে-বিদেশে হলেও দেখা করেন। বার্ধক্যে পৌঁছানোর পরও এই ভাইবোন ভালোবাসার আত্মিক বন্ধনে আটকে আছেন। ফেসবুকে তাঁদের ছবি দেখলে মনে হয়, এমন সুন্দর সম্পর্ক পৃথিবীতে ভালোবাসা নামিয়ে আনে।