প্রশিক্ষণের উদ্যোগ আইরিনের

তখন ২০০৫ সাল। লক্ষ্মীপুরের বাঞ্ছানগরের আইরিন সুলতানা এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেছেন সবে। সামনে অখণ্ড অবসর। সময়টা কাজে লাগাতে স্থানীয় একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্রে যাওয়া-আসা শুরু করেন। সেখানে গিয়ে দেখেন ছেলেদের জন্য হাতে-কলমে শেখার যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও মেয়েদের জন্য নেই একেবারেই। তখন থেকেই মনে একটি স্বপ্ন পুষে রাখেন—একদিন নিজেই প্রতিষ্ঠা করবেন এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে নারীরা পাবেন সর্বোচ্চ সুযোগ।

আইরিনের সেই স্বপ্ন বাস্তব রূপ পেল ৭ বছর পরে, ২০১২ সালে। নিজের নামে খোলেন কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্র। তাঁর প্রতিষ্ঠানের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে ‘আইরিন টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’ নামের এ প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পায় বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের। আইরিন এখন নিজেই নারীদের হাতে-কলমে শেখান কম্পিউটার। আর এই উদ্যোগে তাঁর পাশে ছায়ার মতো আছেন স্বামী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান।

শূন্য থেকে শুরু

২০০০ সালে বাবা আলী আকবরের মৃত্যুর পর খুব অর্থকষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয় আইরিন ও তাঁর চার ভাইবোনকে। তাই অসচ্ছলতার মধ্যেও পড়ালেখা চালিয়ে যান। কখনো সেলাই, কখনো পোশাকে নকশা করা—চলতে থাকে আইরিনের সংগ্রাম। এসএসসি পাসের পর বেশ কিছুদিন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন আইরিন। ২০১০ সালে শ্যামলী আইডিয়াল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে কম্পিউটার প্রকৌশল বিষয়ে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। এরপর ঋণ নিয়ে একটি কম্পিউটার কিনে নিজের বাসায় মেয়েদের শেখাতে শুরু করেন। ২০১১ সালে বিয়ে করেন মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানকে। স্বামীও তাঁর স্বপ্নপূরণে এগিয়ে আসেন। ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর লক্ষ্মীপুরের মজু মার্কেটে চালু করেন আইরিন কম্পিউটার অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার। পরে এটির নাম বদলে হয়ে যায় আইরিন টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট।

প্রশিক্ষণ নিয়েছেন হাজারের বেশি

তিনটি কম্পিউটার দিয়ে মেয়েদের বিনা মূল্যে শেখানোর ব্যবস্থা করেন আইরিন। ছেলেদেরও শেখানো হয়। প্রতিষ্ঠানের নামডাক বাড়তে থাকে। কারিগরি বোর্ডের অনুমোদনের পর বর্তমানে অফিস অ্যাপ্লিকেশন, গ্রাফিকস ডিজাইন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া, হার্ডওয়্যার অ্যান্ড নেটওয়ার্কিং—এ তিন বিষয়ে তিন থেকে ছয় মাসের কোর্স চালু আছে প্রতিষ্ঠানটিতে। বছরে তিন মাসের চারটি এবং ছয় মাস মেয়াদি একটি কোর্সে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

নিজের প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন আইরিন সুলতানা। ছবি: প্রথম আলো
নিজের প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন আইরিন সুলতানা। ছবি: প্রথম আলো

২০১২ সাল থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত আইরিনের প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ১ হাজার ২৭৯ জন। তাঁদের মধ্যে ২০১২ সালে ৫০, ২০১৩ সালে ৮০, ২০১৪ সালে ১৮২, ২০১৫ সালে ২২৭, ২০১৬ সালে ২৯০, ২০১৭ সালে ২৫০ এবং এ বছরের জুন মাস পর্যন্ত প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ২০০ জন। তাঁদের প্রায় অর্ধেকই নারী। তিনটি কম্পিউটার দিয়ে শুরু হওয়া এ প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ল্যাপটপ কম্পিউটারই আছে ২৫টি। মেয়েদের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণ তো আছেই।

এখন সুসময়

দুই বছরের এক পুত্রসন্তানের মা আইরিনের জীবন থেকে কষ্টের সময় দূর হয়েছে। জানালেন, মাসিক আয় ৪০ হাজার টাকার মতো। এতে সচ্ছলতা এসেছে তাঁর সংসারে। নিজের পায়ের তলা খুঁজে পাওয়ার পর আইরিন ভুলে যাননি অতীত। ২০১৫ সালে তিনি ৩০ জন প্রতিবন্ধী, এতিম ও অর্থহীনকে বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ দেন। এ ছাড়া রক্তদানসহ নানা সামাজিক কাজে জড়িয়ে রেখেছেন নিজেকে।

২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বিভাগের শিক্ষা ও চাকরিক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারীদের মধ্যে সেরা হয়েছেন আইরিন সুলতানা। এ জন্য চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয় থেকে তাঁকে পুরস্কার ও সনদ দেওয়া হয়। আইরিন সুলতানা বলেন, ‘জীবনে যেকোনো পরিস্থিতিতে বিচলিত না হয়ে ধৈর্য ধরে কাজ করলে সফলতা আসবেই। আমাকে নিয়ে এখন সবাই গর্ব করে। কিন্তু এ পর্যায়ে আসার দীর্ঘ পথটা একদম সহজ ছিল না।’

আইরিনের প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে লক্ষ্মীপুর জেলাসহ বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন অনেকেই। বললেন, ‘এটা আমার কাছে গর্বের বিষয়। আমি এখন স্বপ্ন দেখি সুবিধাবঞ্চিত নারীদের পাশে দাঁড়াতে।’