ফ্যাশনে সাবেকি ধারা

গ্র্যান্ড ফিনালের শো–স্টপার কারিনা কাপুর পরেছিলেন গাউন। ছবি: সংগৃহীত
গ্র্যান্ড ফিনালের শো–স্টপার কারিনা কাপুর পরেছিলেন গাউন। ছবি: সংগৃহীত

শীত এখনো দূরে। তবে উৎসবের আমেজ শুরু হয়ে গেছে। ঈদের পর একের পর এক উৎসবে মেতে উঠবে এই উপমহাদেশের মানুষেরা। শীতকাল তো ফ্যাশনপ্রেমীদের জন্য উৎসবের মতোই। কেননা, নানা রকম ফ্যাশনেবল পোশাক পরার জন্য শীত বেশ আদর্শ এক ঋতু।

এবারের শীতে পোশাকের ধারা কেমন হবে? শীতের সান্ধ্য আয়োজনে কী পরবেন? উৎসবে কোন পোশাক পরে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবেন? এই সবকিছুর খোঁজ মিলল ‘ল্যাকমে ফ্যাশন উইক উইন্টার-ফেস্টিভ’ আয়োজনে। মুম্বাইয়ের একটি পাঁচ তারা হোটেলে ২২ থেকে ২৬ আগস্ট হয়ে গেল ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের এই মৌসুমের আয়োজন। শুধু আয়োজন নয়, এ যেন ফ্যাশনের এক মহাসমুদ্র। এই সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে আসে ফ্যাশনের নিত্যনতুন ধারা। পরবর্তী সময়ে এই ধারাই বহন করেন অনেক ফ্যাশনপ্রেমী।

এবারের আয়োজনে ফিরে ফিরে এসেছে সনাতনী ফ্যাশন। পুরোনো ও আধুনিকতার সংমিশ্রণে ডিজাইনাররা নিয়ে এসেছেন ফ্যাশনের নতুন ধারা। রং নিয়েও খেলা করেছেন ডিজাইনাররা। কিছু পুরোনো, কিছু নতুন শিল্পকলা, নানা নকশা, নানা রঙের খেলা, তারকার দ্যুতিতে এবারও রীতিমতো জমজমাট ছিল ল্যাকমে ফ্যাশন উইক।

জমকালো ‘গ্র্যান্ড ফিনালে’ দিয়ে ২৬ আগস্ট রাতে শেষ হয় এই আয়োজন। শেষ রাতের ফ্যাশন শোতে শো–স্টপার ছিলেন বলিউড তারকা কারিনা কাপুর। ডিজাইনার মনীষা জয়সিংয়ের নকশা করা গাউন পরে তিনি হাঁটেন র‍্যাম্পে।

ফ্যাশনের নতুন ধারা দেখা গেল ‘নেক্সট জেন’ শোতে
ফ্যাশনের নতুন ধারা দেখা গেল ‘নেক্সট জেন’ শোতে

নতুনের জয়গান

আমরা নতুন যৌবনের দূত—ফ্যাশনের নতুন দূত হলেন ‘নেক্সট জেন’ ডিজাইনাররা। তাঁরাই আগামী দিনে নিয়ে আসবেন ফ্যাশনের নতুন ধারা। এনআইএফডি নেক্সট জেন শিরোনামে এই আয়োজনের মাধ্যমে পাঁচ নবীন ডিজাইনারের সঙ্গে পরিচয় হলো ফ্যাশনপ্রেমীদের। তাঁরা দেখিয়েছেন আগামী শীতের পোশাকের ধারা। ডিজাইনার অনুরাগ গুপ্তা দেখান ওয়েস্ট কোট, লং কোট, চার লেয়ারের লং ফ্রক। অজয় কুমার সিংয়ের ‘অর’ লেবেলে ছিল সাদা আরামদায়ক খাদি ও হাত তাঁতে বোনা কাপড়ের লম্বা ফ্রক, পালাজ্জোর ওপর কাঁথাফোঁড় ও এমব্রয়ডারির কাজ। কণিকা সচদেবের ‘যাযাবর’ সম্ভারে ছিল ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য আরামদায়ক পোশাকের বৈচিত্র্য। শ্বেতা গুপ্তার সংগ্রহে দেখা গেছে সিল্ক ও সুতির ওপর হাতের নকশা করা চান্দেরি পোশাক। ইয়াদভি আগরওয়ালের ‘ইয়েভি’ সম্ভারে ছিল জমকালো সিল্কের ওপর হাতে আকা লং স্কার্ট, শাড়ি, শাড়ির ওপর লম জ্যাকেটের বৈচিত্র্য।

দক্ষিণি অভিনেত্রী সাবিত্রীর পোশাকের অনুপ্রেরণায় তৈরি গৌরাঙ্গর শাড়ি
দক্ষিণি অভিনেত্রী সাবিত্রীর পোশাকের অনুপ্রেরণায় তৈরি গৌরাঙ্গর শাড়ি

ফ্যাশনে পুরানো ধারা

ফ্যাশন উইকের অন্যতম আকর্ষণ ডিজাইনার গৌরাঙ্গ। প্রতিবারই তাঁর ফ্যাশন শোতে থাকে নতুন চমক। না, কোনো বলিউড তারকাকে নিয়ে এসে তিনি চমকে দেন না। বরং গৌরাঙ্গের পোশাক আর পরিবেশনাই তাঁর এক অন্য পরিচিতি দিয়েছে। গৌরাঙ্গ এবার ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের মঞ্চে ফিরিয়ে আনেন সনাতনী ফ্যাশন। শুধু ফ্যাশনই নয়, পুরোনো আমলের সংগীতকেও গৌরাঙ্গ নিয়ে এসেছেন এই মঞ্চে। দক্ষিণি অভিনেত্রী সাবিত্রীর পোশাক অনুপ্রাণিত করেছে খ্যাতনামা এই ডিজাইনারকে। সাবিত্রীকে নিয়ে তৈরি করা চলচ্চিত্র মাহানতির পোশাক ডিজাইন করেছিলেন গৌরাঙ্গ। ১০০ জন শিল্পী ১৮ মাস নিরলস পরিশ্রমের পর এই ছবির পোশাক বানান। ল্যাকমের মঞ্চে গৌরাঙ্গ ফিরিয়ে এনেছিলেন হারিয়ে যাওয়া শিফন। হাতে তৈরি শিফনের ওপর সোনালি ও রুপালি জরির কাজ করা বেনারসি দিয়ে তৈরি আনারকলি, ফুল ফ্লেয়ার্ড কুর্তা, ফ্লোয়িং সারারা, শাড়ি পরে র‍্যাম্পে হাঁটেন মডেলরা।

রাজেশের পোশাকে মঞ্চে হাঁটেন রাজকুমার রাও
রাজেশের পোশাকে মঞ্চে হাঁটেন রাজকুমার রাও

সঙ্গীসাথি পশুপাখি

রাজেশ প্রতাপ সিংয়ের ‘ওয়েলকাম টু জঙ্গল’ সংগ্রহে ছিল প্রকৃতি ও পশুপাখির মোটিফ। ডিজাইনার উইলিয়াম মরসিসে অনুপ্রাণিত রাজেশ। পুরুষ ও নারীর পোশাক ছিল রাজেশের এই আয়োজনে। লম্বা ল্যাপেল জ্যাকেট, কুর্তা, ধুতি প্যান্ট, স্যুটের ওপর দেখা গেছে জংলা ছাপ ও পশুপাখির ছবি। মেয়েদের আয়োজনও ছিল অভিনব। রাজেশের নকশা করা সিল্ক, সুতি ও উলের জ্যাকেট, কিমানো ধাঁচের প্লিটেড কুর্তা, ফুল ফ্লেয়ার্ড স্কার্ট, কাঁধখোলা জাম্প স্যুট এবং চান্দেরি ব্লাউজ পরে র‍্যাম্পে হাঁটেন মডেলরা। মেয়েদের ফ্যাশনের ক্ষেত্রে আরও নতুন জানালা খুলে দেন রাজেশ। তাঁর প্রদর্শনীতে মেয়েদের জন্য ছিল লুঙ্গি, ধুতি প্যান্ট, শেরওয়ানি, ওয়েস্ট কোট। রাজেশের ডিজাইন করা সাদা কোট এবং সাদা প্যান্ট পরে মঞ্চে দেখা যায় বলিউড অভিনেতা রাজকুমার রাওকে।

‘একা’ সংগ্রহের পোশাক
‘একা’ সংগ্রহের পোশাক

পুরোনো কিছু নকশা

ডিজাইনার রীনা সিংয়ের ‘একা’ সংগ্রহ যেন ল্যাকমের মঞ্চে ফিরিয়ে আনে ভারতের কিছু সাবেক নকশা। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার শান্তিপুরের মাকুর কাজও উঠে এল তাঁর প্রদর্শনীতে। কাশ্মীরের ‘সুজনি’ নকশাও রীনা আবার ফিরিয়ে এনেছেন। উল, লিনেন ও খাদির লম্বা জ্যাকেট, বিয়ের কনের ম্যাক্সি, টিউনিক, ফুলহাতা শার্টের ওপর অসাধারণ সুজনির কাজ দেখিয়েছেন রীনা। তাঁর এই আয়োজনে সনাতনের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধনে এক নতুন ফ্যাশনধারার জন্ম দেয়।

শ্বেতা কাপুরের ডিজাইনে বিমানবন্দরের উপযোগী পোশাক
শ্বেতা কাপুরের ডিজাইনে বিমানবন্দরের উপযোগী পোশাক

বিমানবন্দরের ফ্যাশন

ফ্যাশন শুধু পার্টি বা উৎসবে সীমাবদ্ধ নেই। ‘এয়ারপোর্ট লুক’ নিয়েও এখন সবাই চিন্তাভাবনা করেন। বিমান সফরের সময় আরামদায়ক অথচ হাল ধারার পোশাকের সন্ধানে থাকেন ফ্যাশনপ্রেমীরা। এই সব ফ্যাশন অনুরাগীর কথা ভেবে ‘কালেকশন এয়ারপোর্ট টুয়েলভ’ নামে এক অন্য ধারার শোর আয়োজন করেন শ্বেতা কাপুর। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিমানবন্দরে কী পরে নামবেন, তা-ই এই এয়ারপোর্ট ফ্যাশন ট্রেন্ড তিনি ল্যাকমের মঞ্চে নিয়ে আসেন। শ্বেতার ডিজাইন করা স্মার্ট রারা স্কার্ট, কিম স্কার্ট, নিমো জ্যাকেট, নট টপ, সানডে স্কার্ট পরে র‍্যাম্পে হাঁটেন মডেলরা।

সুনীতা শঙ্করের নকশায় দক্ষিণের কাঞ্জিভরম শাড়িতে সুস্মিতা সেন
সুনীতা শঙ্করের নকশায় দক্ষিণের কাঞ্জিভরম শাড়িতে সুস্মিতা সেন

দক্ষিণি শাড়ির ঝলক

সুনীতা শঙ্করের আয়োজনে ছিল অসাধারণ দক্ষিণি শাড়ি। তরুণ এই ডিজাইনারের নকশায় অবলীলায় চলে এসেছে প্রকৃতি, শিল্প ও স্থাপত্যের মোটিফ। দক্ষিণি শাড়ির মধ্যে তাঁর অসাধারণ কাজ করা কাঞ্জিভরম শাড়ির প্রদর্শনী সবার নজর কাড়ে। শুধু নকশায় নয়, শাড়ি পরার ক্ষেত্রেও সুনীতা বিপ্লব এনেছেন মঞ্চে। নতুনভাবে শাড়ি পরতে শেখান ফ্যাশনপ্রেমীদের। সুনীতার নকশা করা জমকালো অথচ আরামদায়ক কাঞ্জিভরম শাড়ি পরে মঞ্চ আলো করে হাঁটেন সাবেক বিশ্বসুন্দরী সুস্মিতা সেন।

হারিয়ে যাওয়া পোশাক

প্রখ্যাত ডিজাইনার নচিকেত ভারবে দেখান ২০ শতকের হারিয়ে যাওয়া পোশাক। কোচবিহারের মহারানি গায়ত্রী দেবীর ফ্যাশন ভাবনায় অনুপ্রাণিত তিনি। নচিকেতের ‘মিলেনিয়াল মহারানিস’ সংগ্রহে ছিল কোচবিহারের রাজঘরানার পোশাকের নকশা। সাবেকি নকশার সঙ্গে আধুনিক ধারার পোশাকের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন ঘটান এই ডিজাইনার। নচিকেতের ডিজাইন করা গাঢ় গোলাপি রঙের লেহেঙ্গা চোলি পরে ফ্যাশন মঞ্চ আলো করে হাঁটেন শ্রীদেবী-কন্যা জাহ্নবী কাপুর।

ট্রেসেমির শুভেচ্ছা দূত জ্যাকুলিন ফারনান্ডেজ র‍্যাম্পে হাটেন ডিজাইনার আশিষ এন সোনির পোশাক পরে
ট্রেসেমির শুভেচ্ছা দূত জ্যাকুলিন ফারনান্ডেজ র‍্যাম্পে হাটেন ডিজাইনার আশিষ এন সোনির পোশাক পরে

উৎসবের মাতাল হাওয়া

ডিজাইনার অনুশ্রী রেড্ডির আয়োজন মানেই উৎসবের আমেজ। উৎসবের নানা মেজাজের পোশাক ছিল তাঁর এবারের আয়োজনে। অনুশ্রীর সিতারায় ছিল পুরুষ ও নারীর উৎসবের পোশাক। এমব্রয়ডারি করা ঘাগরা চোলি, লেহেঙ্গা, প্লিটেড শাড়ি, শেরওয়ানি পরে র‍্যাম্পে হাঁটেন মডেলরা। পুরুষদের জন্য তিনি এনেছিলেন নানা ধারার শেরওয়ানি, কুর্তা, জ্যাকেট। অনুশ্রীর ডিজাইন করা ফ্লোরোসিন সবুজ রঙের ঘাগরা চোলির ওপর রুপালি জরির নকশা করা পোশাক পরে মঞ্চে ঝড় তোলেন বলিউড অভিনেত্রী মালাইকা অরোরা।

প্রথার বাইরে পুরুষের পোশাক

ডিজাইনার কুনাল রাওয়াল এবার পুরুষদের ফ্যাশনধারায় রীতিমতো বিপ্লব এনেছেন। গোলাপি রং যে শুধু মেয়েদের জন্য নয়, তা তিনি এই মঞ্চে প্রমাণ করলেন। শুধু তা-ই নয়, কাজল, নেলপলিশও যে পুরুষেরা ব্যবহার করতে পারবেন, সে বার্তাও তিনি দিলেন। তাই তাঁর শো-স্টপার বলিউড অভিনেতা বরুণ ধাওয়ানের চোখে কাজল এবং হাতে কালো রঙের নেলপলিশ দেখা গেল। পুরুষদের জন্য শেরওয়ানি, ওয়েস্ট কোট, প্রিন্স কোট, জ্যাকেট, চার লেয়ারের শেরওয়ানির অভিনব সংগ্রহ দেখান তিনি। তাঁর নকশা করা সাদা শেরওয়ানি পরে মঞ্চে হাঁটেন বরুণ ধাওয়ান।

ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের টাইটেল স্পনসর ইউনিলিভারের পণ্য ল্যাকমে। সহ পৃষ্ঠপোষক ছিল ইউনিভারের ট্রেসেমি, ইতিহাদ এয়ারওয়েজ, নকিয়া। প্রেজেন্টিং পার্টনার ছিল নেক্সা।