বিষণ্নতা ও মুগ্ধতার পম্পেই নগরী

পম্পেইয়ে টিকে থাকা স্মৃতিস্তম্ভ
পম্পেইয়ে টিকে থাকা স্মৃতিস্তম্ভ
>পম্পেই ছিল প্রাচীন রোমান নগরী। পরিকল্পিত নগরীটি চাপা পড়েছিল পাশের ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে সৃষ্ট জ্বলন্ত লাভার নিচে। বর্তমান ইতালির কাম্পানিয়া অঞ্চলের সেই পম্পেই নগরী ঘুরতে গিয়ে বিষণ্নতা আর মুগ্ধতার অনুভূতি হয় একই সঙ্গে।

আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকে যাদের কৈশোর কেটেছে, তাদের কাছে পম্পেই মানে সেবা প্রকাশনীর বই দ্য লাস্ট ডেজ অব পম্পেই আর বাংলাদেশ টেলিভিশনে মুভি অব দ্য উইকে দেখা ধূসর বিষণ্নতার স্মৃতি। তাই পম্পেইয়ের নাম শুনলেই মনটা কেমন যেন করে ওঠে। কল্পনায় ভেসে ওঠে ভিসুভিয়াসের ফুটন্ত লাভার নিচে ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটা জলজ্যান্ত শহরের চিত্র।

এই প্রাচীন শহর দেখার বাসনা নিয়েই ইতালির নেপলসে পা রাখি। জানা ছিল, নেপলস থেকে পম্পেইয়ের দূরত্ব বেশি নয়। রাতটা হোটেলে কাটিয়ে, সকাল ৮টায় বেরিয়ে পড়ি প্রাচীন শহরের উদ্দেশে। ট্রেনে ৪০ মিনিটেই পৌঁছে যাই। স্টেশন লাগোয়া পম্পেইয়ের প্রবেশপথ। পর্যটকদের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো।

অ্যাম্পিথিয়েটার ক্যাভেয়া
অ্যাম্পিথিয়েটার ক্যাভেয়া

স্বপ্ন স্মৃতির শহরে

সারি ধরে টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম স্বপ্ন স্মৃতির শহরে। পোর্টা মারিনা প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ল ভঙ্গুর দাঁড়িয়ে থাকা দেয়ালগুলো; এখনো টিকে থাকা ছাদগুলো। ভিসুভিয়াসের ছায়ায় ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন। এখানে দাঁড়িয়ে দুই ধরনের বোধ হলো—একটি বিষণ্নতার, অন্যটি মুগ্ধতার।

দুই ধরনের অনুভূতি নিয়েই রাস্তা ধরে এগিয়ে যাই। চোখে পড়ল বাসিলিয়া। এটি ছিল নগরের আদালত প্রাঙ্গণ এবং মূল ব্যবসায়িক কেন্দ্র। এর ২৮টি কলাম এখনো জেগে আছে। এই প্রাঙ্গণ মুখরিত থাকত ব্যবসায়ী আর ব্যাংকারদের পদচারণে।

আরও কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর বেশ বিস্তৃত খোলা জায়গায় পৌঁছালাম। পম্পেই শহরের কেন্দ্রবিন্দু। এটার নাম ফোরাম। এখানেই নগরের সব বড় বড় অনুষ্ঠান হতো। ফোরামের চারদিকে বিভিন্ন ধরনের ভবন। অনেকগুলো স্মৃতিস্তম্ভও দেখা গেল ফোরাম স্কয়ারে। ফোরাম কিন্তু এখনো তার প্রাচীন কাঠামোর নিদর্শন ধরে রেখেছে। উত্তর-দক্ষিণমুখী মূল চতুষ্কোণা কাঠামোটি দৈর্ঘ্যে ৪৮২ ফুট আর প্রস্থে ১২৪ ফুট। স্কয়ারের দক্ষিণ দিকের দেয়ালের সঙ্গে রয়েছে মার্বেল-খচিত তিনটা বড় হল। এখানে বসতেন নগরের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। পশ্চিম দিকে ছিল শাকসবজি, ফলমূল আর বিভিন্ন খাবারের বাজার। এরই নিচের দিকে জুপিটারের মন্দির। ধারণা করা হয়, এই মন্দির খ্রিষ্টপূর্ব দুই শতকে নির্মিত।

আরও এগিয়ে যাওয়ার পর আমরা ঢুকি একটি ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে। সেখানে দেখা মেলে ফোরাম বাথের। অর্থাৎ গণ-গোসলখানা। যেখানে ছিল নারী-পুরুষের জন্য গোসলের আলাদা ব্যবস্থা। ঠান্ডা এবং গরম পানির সরবরাহও ছিল।

পম্পেইয়ের প্রধান রাস্তা
পম্পেইয়ের প্রধান রাস্তা

রোমান ধনীদের জীবনযাপন

ফোরাম বাথের পর আমরা গেলাম ‘হাউস অব স্যালাস্ট’ নামে এক বাসায়। শহরের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এই বাসা থেকে বোঝা যায় কেমন ছিল রোমান ধনীদের জীবনযাপন। ছোট্ট একটা করিডর দিয়ে ভেতরে ঢুকেই বড় খোলামেলা একটি কামরা, যার নাম এট্রিয়াম। ঘরে আছে প্রচুর আলো-বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা। ছাদের মধ্যের একটি অংশ খোলা রাখা হয়েছে। সেখান থেকে বৃষ্টির পানি পড়ে মেঝেতে রাখা এম্পুভিয়া নামের একটি পুলে। এই সংগৃহীত পানি পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ করা হতো গৃহস্থালির কাজে ব্যবহারের জন্য। অতিথি ও পরিবারের সদস্যদের জন্য আলাদা ঘর আছে। এরপর আরেকটি ছোট করিডর পেরিয়ে দেখা মেলে বাসার ভেতরেই থাকা বাগানের। ‘হাউস অব স্যালাস্ট’ কিন্তু বিভিন্ন সময়ের স্মৃতি বহন করছে। বাড়ির মালিক সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির স্টাইলে পরিবর্তন এনেছিল, আর আমরা জানতে পারছি রোমান সভ্যতার বিভিন্ন সময়কে।

ফাস্ট ফুডের দোকান

পম্পেই নগরীতে ছিল বেশ কয়েকটা বেকারির কারখানা। সেগুলো ঘুরে দেখা গেল বিভিন্ন ধরনের চুলা, নানা ধরনের রুটি আর খাবার তৈরির কারিগরি ব্যবস্থা। রাস্তার ধারেই টিকে আছে অনেকগুলো দোকান। এক গাইড দেখি একদল পর্যটককে বোঝানোর চেষ্টা করছে, এগুলো ছিল সেই সময়কার ফাস্ট ফুডের দোকান। নগরীজুড়ে নাকি ১২০টির মতো ফাস্ট ফুডের দোকান ছিল। দোকানগুলোতে ভিসুভিয়াসের কোলজুড়ে উৎপাদিত আঙুর থেকে তৈরি ওয়াইন বিক্রি হতো। জনপ্রিয় এই ওয়াইন কিনতে দূরদূরান্তের মানুষ আসত এই শহরে।

ফোরাম স্কয়ারে পর্যটকদের আনাগোনা। ছবি: লেখক
ফোরাম স্কয়ারে পর্যটকদের আনাগোনা। ছবি: লেখক

বারবনিতাদের ভবন ‘দ্য লুপানার’

এরপর দেখা মিলল পতিতালয়ের। পুরো নগরে প্রায় ২৫টি পতিতালয় চিহ্নিত করা গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়টি একটা দোতলা ভবন যার নাম ‘দ্য লুপানার’। এর নিচতলায় পাঁচটা আর ওপর তলায় আরও পাঁচটা কক্ষ। ওপর তলায় একটা বড় কামরাও রয়েছে, সেটি বোধ হয় পার্টি করার জন্য। ছোট আকারের কক্ষগুলোতে একটি করে পাথরের ডিভান দেখা যায়। অন্য সব পতিতালয়ের মতো এখানেও রয়েছে শোষণ আর বঞ্চনার গল্প। এখানকার মেয়েদের ধরে আনা হতো উত্তর আফ্রিকা, এশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের দখলকৃত এলাকা থেকে। পম্পেইয়ের যৌনজীবন নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা চলছে। এসব লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখা হয়েছিল ২০০৫ সাল পর্যন্ত।

ঐতিহ্যের থিয়েটার

নগরে দুটো থিয়েটারের সন্ধান পাওয়া গেছে। একটি আকারে ছোট। সেখানে কবিতাপাঠ, ছোট সংগীতায়োজন ও অভিনয় চলত। বড়টি উন্মুক্ত ছিল প্রায় ৫ হাজার দর্শকের জন্য। সেখানে আয়োজন করা হতো নাটক এবং বড় ধরনের সংগীত পরিবেশনার।

মূল শহর পেরিয়ে একটু বাইরে টিকে আছে রোমান সময়ের সবচেয়ে পুরোনো অ্যাম্পিথিয়েটারটি। খ্রিষ্টপূর্ব ৭০-৮০ শতকে এটি নির্মিত হয়। এর নাম ক্যাভেয়া। এতে প্রায় ২০ হাজার মানুষের বসার ব্যবস্থা ছিল। এখানে গ্লায়াডিয়েটররা নিয়মিত লড়ত ভয়ানক সব প্রাণীর বিপক্ষে। ৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাভেয়াতে নাকি পম্পেই আর নুসেরিয়া শহরের মধ্যে খেলাধুলা নিয়ে রীতিমতো দাঙ্গা লেগে যায়। এরপর নাকি অনেক দিন এখানে খেলাধুলা নিষিদ্ধ ছিল।

প্রায় টানা সাড়ে তিন ঘণ্টার পরিভ্রমণ সেরে যখন আমরা বের হচ্ছি তখন মনে হলো ২০ হাজার মানুষের নানা প্রয়োজন মাথায় রেখে আজ থেকে ১৯৩৯ বছর আগে কত গোছানোভাবে তৈরি হয়েছিল পম্পেই নগরী। সেই নগরীর পরিকল্পনায় রাখা হয়েছিল পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বৃষ্টির পানি ধরে রেখে তা সরবরাহের ব্যবস্থা, সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের জন্য খোলা জায়গার ব্যবস্থা, সবুজের জন্য বাগান এবং মূল শহরের বাইরে অ্যাম্পিথিয়েটার। প্রাচীন নগরীর পরিকল্পনাবিদেরা যে চিন্তা–চেতনায় আধুনিক ছিল তা বলাই যায়। বিষণ্নতা আর ভালো লাগা—এই দুই অনুভূতি নিয়েই আমরা বিদায় নিলাম ভিসুভিয়াসের ছায়ায় থাকা পম্পেই নগরী থেকে।