সড়কে আতঙ্ক

হঠাৎ খেয়াল হলো আপনি বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছেন। রাস্তায় নামলেই মনে হচ্ছে, কেউ বুঝি কেউ ব্যাগ ধরে টান দিল। অপরিচিত কেউ পেছনে কয়েক পা হাঁটলেই মনে হয়, ‘এটা বোধ হয় ছিনতাইকারী।’ কখনো মনে হয় রিকশাকে একটা ট্রাক এক্ষুনি ধাক্কা দিয়ে দেবে। এসব চিন্তায় রাস্তায় বেরোনো মাত্র ভয়ে সিঁটিয়ে থাকেন আপনি। ঘামতে থাকেন, যতক্ষণ না ঘরে বা অফিসে পৌঁছাচ্ছেন ততক্ষণ যেন প্রাণ হাতে নিয়ে ঘোরেন।

অনেকেই আছেন, বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে রাস্তায় বা নতুন কোনো জায়গায় অহেতুক আতঙ্কে থাকেন। এমনকি যেখানে কোনো ঝুঁকি নেই, আতঙ্কের কোনো কারণ নেই—সেসব অতি নিরাপদ জায়গায়ও তাদের মনে বিভিন্ন ভয় দানা বাঁধে। এমন অনেকে আছেন, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ভাবেন ‘বাস যদি এখন ব্রেক ফেল করে ফুটপাতে উঠে যায়, তখন কী হবে’। কেউবা সাততলা ভবনের ষষ্ঠ তলার অফিসে বসে ‘এই বুঝি ভূমিকম্প হলো’ বা ‘এই বুঝি বিল্ডিংয়ে আগুন লাগল’—এসব ভাবতে ভাবতে নিজের কাজগুলোই ঠিকমতো করতে পারেন না। এই ধরনের অহেতুক আতঙ্ক বা হঠাৎ ভীতি নানা কারণে হতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে কারণে হয়, তা হচ্ছে প্যানিক ডিসঅর্ডার (অহেতুক আতঙ্ক রোগ)। এ ছাড়া অতি উদ্বেগ (জেনারেলাইজড অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার), শুচিবাই (অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার), ফোবিক অহেতুক ভীতি (ফোবিক ডিসঅর্ডার), ব্যক্তিত্বের সমস্যা (পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার) এবং সিজোফ্রেনিয়া (প্যারানয়েড টাইপ) রোগে এমনটা দেখা যায়। যার এ ধরনের কোনো রোগ নেই বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হলেও অহেতুক আতঙ্ক বা অযৌক্তিক ভয় যখন হয়, সেই সময়টাতে ব্যক্তির প্যানিক অ্যাটাক হয়ে থাকে। তাই কারও মধ্যে নির্ণীত কোনো রোগ না থাকলেও এই ধরনের ভয় পাওয়া, অহেতুক আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়া বা রাস্তায় নামলেই হাজারো নেতিবাচক চিন্তা করাটাকে হেসে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না, বিষয়টিকে মোটেই হালকা করে দেখা চলবে না। কারণ এটি তার ধারণা, চিন্তা, আবেগ বা আচরণের সমস্যা। এই সমস্যাগুলো থাকলে ব্যক্তির যাপিত জীবন ব্যাহত হয়। জীবনের মান কমে যায়, উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায় এবং পারস্পরিক সম্পর্কগুলো বাধাগ্রস্ত হতে থাকে।

অহেতুক ভয়, আতঙ্ক, নেতিবাচক চিন্তা বা মৃত্যুভীতি; পরিস্থিতি ভেদে ভিন্নধর্মী হতে পারে। কখনো দেখা যায়, মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে এমন বস্তু, স্থান বা পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেই এমন ভীতি তৈরি হচ্ছে, কখনোবা এই ধরনের কোনো বস্তু, স্থান বা পরিস্থিতি ছাড়াই মনের ভেতর থেকে এই আতঙ্কবোধ তৈরি হচ্ছে। ব্যক্তি এই আতঙ্ক বা নেতিবাচক চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে চায়, তিনি নিজেও বুঝতে পারেন তার এই ভীতি সম্পূর্ণ অমূলক, ভিত্তিহীন তবুও হাজার চেষ্টা করেও এই ভীতি থেকে বের হতে পারেন না। আবার বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন সিজোফ্রেনিয়া হলে আক্রান্ত ব্যক্তি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, সত্যিই তার সঙ্গে খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে, আশপাশের মানুষজন তার ক্ষতি করতে যাচ্ছে। একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে কখনো হার্টের রোগ, থাইরয়েডের সমস্যা, রক্তে শর্করা একদম কমে যাওয়া বা কোনো ধরনের মাদক (বিশেষ করে গাঁজা, ইয়াবা) সেবনের কারণেও এমন হঠাৎ আতঙ্কিত হওয়ার লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তাই অহেতুক আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার লক্ষণ কারও মধ্যে দেখা দিলে কেন তা হচ্ছে, তা নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া দরকার—চিকিৎসকই নির্ণয় করবেন এটি মানসিক কারণে হচ্ছে না শারীরিক কারণে হচ্ছে। 

কী হয়
আতঙ্ক তৈরি করতে পারে এমন বস্তু, স্থান বা পরিস্থিতিকে বলা হয় স্ট্রেসর। স্ট্রেসর এর মুখোমুখি হলে বা কখনো স্ট্রেসর ছাড়াই অহেতুক আতঙ্ক বা ভীতির উদ্ভব হতে পারে। যেমন: বাসে উঠলে কেউ সারাক্ষণ ভাবতে থাকেন এই বুঝি বাস উল্টে গেল, রিকশায় বসে আতঙ্কিত হন যে যখন-তখন একটি ট্রাক রিকশাটাকে চাপা দিয়ে দেবে, ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে ছিনতাইকারীর ভয়ে সর্বদা তটস্থ হয়ে থাকেন। মনে রাখতে হবে যে এই অহেতুক আতঙ্ক বা ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা স্বাভাবিক সতর্কতার চেয়ে বেশি। রাস্তাঘাটে সবাই সতর্ক থাকবেন—এটাই প্রত্যাশা। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে সচেতন থাকবেন—এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু এই সাধারণ সতর্কতা বা সচেতনতাকে ছাপিয়ে যখন অযৌক্তিক উদ্বেগ আর উদ্বিগ্নতা কোনো ব্যক্তির সাধারণ চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে তার চলাফেরা, কাজকর্মকে বাধাগ্রস্ত করে তখন সেটা চিকিৎসাযোগ্য। এসব ক্ষেত্রে নেতিবাচক আর আতঙ্কবোধের সঙ্গে সঙ্গে যে লক্ষণগুলো বেশি দেখা দেয় তা হচ্ছে:

নিশ্বাস ঘন ঘন হওয়া, নিশ্বাস আটকে যাওয়ার অনুভূতি হওয়া

মুখ, গলা শুকিয়ে আসা

বুক ধড়ফড় করা, বুকে ব্যথা অনুভব করা

ঘাম হওয়া

মরে যাব এমন একটা অনুভূতি হওয়া

হাত পা-ঠান্ডা হয়ে যাওয়া

নড়াচড়া করতে না পারা—অসাড়তাবোধ

পেটের ভেতরটা শূন্য লাগা

মাথা ঘোরা—মাথাটা শূন্য বোধকরা

হাত-পায়ের হালকা কাঁপুনি 

কী করবেন
বিনা কারণে ভয় পাওয়া, অহেতুক নেতিবাচক বিষয় মনে চলে আসা, খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে এমনটা মনে করা—মানসিক বা শারীরিক রোগের কারণে হয়ে থাকে। ব্যক্তিত্বের গড়নও এর জন্য দায়ী। কারও মধ্যে এ ধরনের অহেতুক আতঙ্ক বারবার হতে থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাহায্য নিতে হবে—যদি বিষয়টি মানসিক কারণে বা মাদকের কারণে হয়, তবে সাইকিয়াট্রিস্টের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি এই ভীতি দূর করতে সাহায্য করবে। আর যদি কোনো শারীরিক সমস্যার কারণে অহেতুক ভীতিবোধ তৈরি হয়, তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে কেবল মানসিক কারণের পাশাপাশি বেশ কিছু শারীরিক সমস্যায় অহেতুক ভীতিবোধ হতে পারে। এ ধরনের সমস্যা হয় এমন ব্যক্তি নিজেও নিজেকে খানিকটা সাহায্য করতে পারেন। এ জন্য যা যা করণীয় তা হচ্ছে:

বিষয়টি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞের মতামত জানা জরুরি। সমস্যার ব্যাখ্যাটিকে গ্রহণ করে মেনে নিতে হবে যে এটি কোনো কোনো রোগের কারণে হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ভয় পাওয়ার কিছু নেই—সংশ্লিষ্ট রোগের (মানসিক বা শারীরিক) চিকিৎসা করা প্রয়োজন। বিষয়টি মেনে নিতে পারলে অহেতুক ভয় বহুলাংশে কমে যাবে।

ধূমপানসহ যেকোনো ধরনের মাদক গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এমনকি অহেতুক আতঙ্কিত হওয়ার প্রবণতা যাদের আছে তাদের ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় (চা, কফি ইত্যাদি) বর্জন করতে হবে।

শ্বাস-প্রশ্বাসের কিছু ব্যায়াম—যেমন বুকভরে বড় বড় শ্বাস নেওয়া, শ্বাস ধরে রেখে আস্তে আস্তে শ্বাস ছাড়াৎ ইত্যাদি চর্চা করা।

রিলাক্সেশন (শিথিলায়ন), মেডিটেশন, মাইন্ডফুলনেস, ইয়োগা ইত্যাদির সাহায্য নেওয়া। তবে মনে রাখা দরকার যে বিজ্ঞানসম্মতভাবে এগুলোর চর্চা করতে হবে। অবৈজ্ঞানিক উপায়ে বা বিশেষজ্ঞের সাহায্য ছাড়া এগুলো করলে কোনো লাভ হবে না।

পরিবারের সদস্য, বন্ধু ও স্বজনদের সঙ্গে নিয়মিত গুণগত সময় কাটানো। সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ। একা একা সময় কাটানোর অভ্যাস পরিত্যাগ করা।

নিয়মিত ব্যায়াম করা, খেলাধুলা করা, সাঁতার কাটা বা হাঁটা।

পরিমাণমতো ঘুমানো। রাতের বেলা জেগে না থাকা এবং দিনব্যাপী না ঘুমানো। ঘুমের চক্রটিকে স্বাভাবিক রাখা, অর্থাৎ রাতে পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে পাশাপাশি দিনে দুপুর পর্যন্ত ঘুম পরিহার করতে হবে।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়ে প্রয়োজনে উৎকণ্ঠাবিরোধী ওষুধ (এংজিয়োলাইটিক) সেবন করা। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ না খাওয়া, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বন্ধ না করা।

অভিজ্ঞ কাউন্সিলরের তত্ত্বাবধানে সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং সেবা গ্রহণ করা।

পরিবারের সদস্য বা বন্ধু-স্বজনের মধ্যে এ ধরনের সমস্যা দেখা দিলে তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ, উপহাস ও ঠাট্টা না করে তাকে চিকিৎসার জন্য উদ্বুদ্ধ করা।

সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।