নিত্যই সে মিথ্যা বলে

>
অধ্যাপক মেহতাব খানম
অধ্যাপক মেহতাব খানম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন।—বি. স.

সমস্যা
চার বছর আগে আমার ছেলেকে বিয়ে করিয়েছি। শুরু থেকে পুত্রবধূ আমাদের সবার বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে। ছেলে তো বটেই, আমরা পুরো পরিবারই পুত্রবধূকে নিয়ে সমস্যায় আছি। আমাদের সঙ্গে কথা বলার সময় আপত্তিকর এবং অপমানসূচক শব্দ উচ্চারণ করে; নিত্যই সে মিথ্যা বলে। সে চায়, তার স্বামী সব সময় যেন শ্বশুরবাড়িতে বড় অঙ্কের টাকা দেয়। মনে হয় অর্থের জন্যই সে আমাদের পরিবারে বিয়ে করেছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পড়ালেখার যাবতীয় খরচ আমরা দিয়েছি। আবার, বিয়ের চার বছর পরও সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ নেই। এখন শুনতে পাচ্ছি, সন্তান ধারণে তার ক্ষমতা নেই বললেই চলে। সবদিক বিবেচনায় পরিবারে খুব অশান্তি বিরাজ করছে। ৬৫ বছর বয়সে এসব নিতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে ওদের বিচ্ছেদ ছাড়া আর কি কোনো বিকল্প আছে?

নাম ও ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ

আপনি লিখেছেন ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন। তবে এভাবেই আমরা সাধারণত বলে থাকি। আমরা যদি বলতাম, ছেলের বিয়ে হয়েছে; তাহলে পিতামাতার ভূমিকাটি ভিন্নভাবে প্রকাশিত হতো। বিয়ের পর দুই পরিবার থেকে আসা দুজন মানুষ একত্র হয়ে সুন্দর একটি সম্পর্ক তৈরি করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটি তাদের ওপরেই সম্পূর্ণ ন্যস্ত করলে ভালো হয়। যদি আমরা বলি, ওরা বিয়ে করেছে। তাহলে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হিসেবে এই নতুন সম্পর্কে খাপ খাইয়ে নেওয়ার দায়িত্বটি নিজেরাই নেবে, তা ধরে নেওয়া হয়। এটি তাদের জীবনের একটি বিশেষ অধ্যায়ের পথচলা। তারা যেন স্বাধীনভাবে নিজেদের সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে পারে, সেটির জন্য দুই পরিবারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও সহায়তা খুব প্রয়োজন।

এক জোড়া দম্পতি নিজেদের সমস্যাগুলো ভুলভ্রান্তির মাধ্যমে হলেও কিছুটা সমাধান যেন করতে পারে, সেই সুযোগটি তাদের করে দেওয়া প্রয়োজন। যদি তারা নিজেদের সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করে, তাহলে একটি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিষয়টি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করতে হবে। দুই পরিবারের সদস্যরা প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে অনেক সময় পরস্পরের ব্যাপারে কিছু বিরূপ মন্তব্য করে ফেলেন যেগুলো দম্পতিদের সমস্যাগুলো সমাধান না করে বরং আরও বেশি জটিলতার সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে এই মন্তব্যগুলো দম্পতিদের মধ্যে পারস্পরিক দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। সন্তানেরা একটি মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ হয়ে উপার্জনক্ষম হওয়ার পর, বাবা-মায়ের ভূমিকাটি পরোক্ষভাবে থাকলে ভালো হয়। তাতে করে তারা নিজেদের অভিযোজন ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।

আপনারা যে পুত্রবধূর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ বহন করেছেন সেটি অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তবে সেটি করার জন্য হয়তো কেউ আপনাদের বাধ্য করতে পারত না, যদি আপনারা খুশি হয়ে সেটি না করতেন। মেয়েটির সঙ্গে আপনাদের সম্পর্কের এতটা অবনতি কেন ঘটেছে, তা কি কখনো বোঝার চেষ্টা করেছেন? কখন থেকে এবং কীভাবে সে এতটা আপত্তিকর উক্তি করতে শুরু করেছে, সেই ধারাবাহিকতাটি বুঝতে চেষ্টা করলে ভালো হয়। সেখানে আপনারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোনো অবদান রেখেছেন কি না, তা খুব ভালোভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন।

 মেয়েটির নিজের পরিবারে তার স্বামী যদি অর্থনৈতিক সহায়তা করতে না চায়, তাহলে আপনার ছেলেকে নিজের অপারগতার কথা স্ত্রীকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতে হবে। তবে স্বামীকে সে এ ব্যাপারে বাধ্য করতে পারে না। এখন পুত্রবধূ সন্তান গ্রহণ করবে কি না, সেই সিদ্ধান্তটি সম্পূর্ণভাবে ছেলে ও পুত্রবধূর ওপর ছেড়ে দিলে ভালো হয়। 

প্রত্যেক বাবা-মা ইচ্ছে করেন তাঁদের উত্তরাধিকারদের দেখতে। তবে মেয়েটিকে যেহেতু সন্তান ধারণ করতে হবে, তাই তার স্বাধীন ইচ্ছেকেও শ্রদ্ধা করতে হবে। যদি আপনার ছেলে আন্তরিকভাবে সন্তান চায়, তাহলে সেটি নিয়ে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করতে পারে। মেয়েটির যদি সন্তান ধারণের ক্ষমতা না থাকে বা সেটি কম থাকে তাহলে তাকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে আমরা অনুরোধ করতে পারি মাত্র, এটি কোনোভাবে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। অনেকেরই বাবা-মা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় না এবং জীবনের এই অভিজ্ঞতাগুলোর মাধ্যমে আমরা অনেক সময় পরিবারের বাইরেও কিছু ভালো কাজ করার প্রণোদনা পাই। আপনাদের মানসিক প্রশান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য পুত্রবধূর সমালোচনা না করে, তার সব দোষগুলোকে এক পাশে রেখে তার প্রতি সদয় আচরণ করা যায় কি? হয়তো-বা তাতে করে সে আপনাদের শ্রদ্ধা করতে ও ভালোবাসতে কিছুটা হলেও সক্ষম হবে। তবে সমস্যাগুলো যাতে আরও তীব্র আকার ধারণ করতে না পারে, সে জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাইকোথেরাপিস্টের কাছে দম্পতি হিসেবে গিয়ে কাউন্সেলিং সেবা নিতে পারে।