বন্ধুর সাফল্যে ঈর্ষা

বন্ধুর ভালো সময়ে খুশি হওয়াটা প্রকৃত বন্ধুত্বের লক্ষণ। মডেল: শাহরিয়ার, আয়মান ও সজল। ছবি: সুমন ইউসুফ
বন্ধুর ভালো সময়ে খুশি হওয়াটা প্রকৃত বন্ধুত্বের লক্ষণ। মডেল: শাহরিয়ার, আয়মান ও সজল। ছবি: সুমন ইউসুফ

‘বিপদে বন্ধু চেনা’ বা ‘দুঃসময়ে বন্ধুকে কাছে পাওয়া’—কথাগুলো সবারই পরিচিত। বন্ধুই পারেন বন্ধুর কষ্ট নিজের বলে ধারণ করতে এবং পাশে এসে দাঁড়াতে। কিন্তু বন্ধুর ভালো থাকা বা সুখের সময় কি সব সময় আমরা নিজের মতো করে ধারণ করতে পারি? অর্থাৎ বন্ধুর সুখে কি আমরা সব সময় সুখী হই বা তাঁর সাফল্য নিজের মতো মনে করি? এমন তো হয়, যখন বন্ধুর সাফল্য, ভালো থাকা, জনপ্রিয়তা, সুন্দর দাম্পত্য জীবন আমাদের মধ্যে ভালো লাগার পরিবর্তে ঈর্ষা বা দূরত্ব তৈরি করতে পারে—মন খারাপের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
প্রশ্ন আসে, যাঁদের এ ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়, তাঁরা কি প্রকৃত অর্থে বন্ধু? অথবা যে মানুষটি বিপদে এত কাছের হয়ে ওঠেন, বন্ধুর সাফল্যে তিনি কেন মন খারাপ করেন বা ঈর্ষান্বিত হন?

কেন এমন হয়?
বন্ধুত্বের সম্পর্কও এক ‘দীর্ঘ ভ্রমণের’ মতো। এ পথ চলা সব সময় একভাবে থাকে না। আমাদের ভেতরের নানা দ্বন্দ্ব, জটিলতা সম্পর্কের নানা টানাপোড়েন তৈরি করতে পারে। প্রত্যাশিত নয় এমন কিছুও ঘটতে পারে বন্ধুত্বের সম্পর্কে।

সম্পর্কের অনিরাপত্তাবোধ
বন্ধুত্ব দাবি করে অন্যের কাছে নিজের গুরুত্ব। বন্ধুর উন্নতি, জনপ্রিয়তা, অন্যের কাছে নিজের অবস্থান নিয়ে একরকম অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে। ‘আমি আগের মতোই গুরুত্বপূর্ণ থাকব কি না, আমাকে আগের মতো সময় দেবে কি না’ ইত্যাদি নানা উদ্বিগ্নতা বা অনিরাপত্তাবোধ থেকেও অন্যের ভালো থাকাকে ইতিবাচক হিসেবে না–ও নিতে পারে।
হীনম্মন্যতাবোধ
বন্ধুত্বে মানুষ সম্পর্কিত হয় অনেক কিছুর মিল বা মোটামুটি দুজনের সমান সমান অবস্থানের ভিত্তিতে। কোনো কারণে একজন যদি এগিয়ে যায়, তাহলে অনেক সময় অন্যের তুলনায় পিছিয়ে পড়া অথবা কম যোগ্যতাসম্পন্ন মনে হতে পারে। এ ছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্যের সাফল্য নিজের ব্যর্থতা বা অসফলতা প্রকটভাবে সামনে নিয়ে আসে।

প্রতিযোগী মনোভাব
ছোটবেলা থেকেই অনেকেই একরকম ‘প্রতিযোগী’ মনোভাব নিয়ে বড় হন। সবকিছুতেই এগিয়ে থাকতেই হবে, সবকিছুতেই অন্যের চেয়ে ভালো হতে হবে বা প্রাধান্য পেতে হবে ইত্যাদি। কাজেই যখন বন্ধু সামনে এগিয়ে যান বা পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ভালো থাকে, সেটা অনেকে মেনে নিতে পারে না।
আবার প্রতিযোগী মনোভাবের কারণে কেউ কেউ নিজের সাফল্য, নিজের ভালো থাকা এমনভাবে বন্ধুর কাছে তুলে ধরে যা অন্যের সীমাবদ্ধতাকে সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে বা ছোট করে। যেমন পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ করা বন্ধুকে কেউ তার ভালো রেজাল্ট এর গল্প বলল। এ ধরনের আচরণেও কেউ ঈর্ষাবোধ করতে পারে।

গুরুত্ব কমে যাওয়া
বন্ধুত্ব যেহেতু একটি গতিশীল সম্পর্ক, তাই নানা কারণেই দুজন ব্যক্তির পারস্পরিক আগ্রহ, গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কম-বেশি হতে পারে। সুতরাং কোনো কারণে আগ্রহ কমে গেলে সেটা অনেক ক্ষেত্রে মেনে নেওয়া সহজ হয় না। এ ক্ষেত্রে বন্ধুর ভালো থাকা, নতুন সম্পর্ক ইত্যাদি কারণ বলে মনে হলে সেটার প্রতি ভালো লাগার পরিবর্তে খারাপ লাগা তৈরি হতে পারে।

কী করবেন?
বন্ধুর সাফল্যে খারাপ বোধ করলে
ভালো লাগার পরিবর্তে খারাপ লাগলে নিজের সীমাবদ্ধতার দিকে মনোযোগী হোন।
আপনার মন খারাপ, ঈর্ষা ইত্যাদি যেকোনো প্রকাশ থেকে বিরত রাখুন।
বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা ও সামাজিক যোগাযোগ বাড়ান। নানা ধরনের সম্পর্ক আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়াবে, কারও প্রতি অতিরিক্ত প্রত্যাশা কমাবে এবং নিজের ইতিবাচক বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগী করবে।
কোনো মানুষই জীবনের সব ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ সফল বা ব্যর্থ নন। আপনি আপনার নিজের ইতিবাচক বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগী হন। দেখবেন, পেশাগত জীবনে হয়তো আপনি তেমন সফল নন, কিন্তু পারিবারিক বা সামাজিক জীবনে আপনার অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে অথবা শারীরিকভাবে আপনি অনেক সুস্থ ইত্যাদি।

আপনার সাফল্যে বন্ধু যখন ঈর্ষান্বিত
বন্ধুত্ব আমাদের জীবনে অন্যতম সম্পদ, যার সব সময় যত্ন আর পরিচর্চা প্রয়োজন। পথ চলতে গিয়ে আমাদের যেমন সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় না, তেমনি আস্থার সম্পর্ক কয়েক দিনে তৈরি হয় না। কাজেই সাফল্যে কারও অনাকাঙ্ক্ষিত ঈর্ষায় বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যায় না বা প্রশ্নবিদ্ধ হয় না বরং এ ক্ষেত্রে তাঁর সাহায্যের হাত প্রয়োজন।
কিছু ক্ষেত্রে আপনার ভালো থাকা বন্ধুকে কষ্ট দিলে সে সাফল্যে অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস নিয়ে কথা না বলা ভালো।
বন্ধুর ভালো দিকগুলো গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরুন। আপনার কাছে তাঁর গুরুত্বের কথা তুলে ধরুন।
সমস্যাটা বাইরে থেকে না দেখে তাঁর ভেতরের সমস্যা বোঝার চেষ্টা করুন এবং তাঁকে সাহায্য করুন।

মেখলা সরকার : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা