৬০ সেকেন্ডে ১২৪ তলায়

১২৪ তলার ওপর থেকে দুবাই শহরের দৃশ্য। ছবি: লেখক
১২৪ তলার ওপর থেকে দুবাই শহরের দৃশ্য। ছবি: লেখক

চমক আর কাকে বলে! এক মিনিটেই শাঁই করে উঠে গেলাম ১২৪ তলায়। যেন লিফটে পা দিয়ে সোজা আসমানে। মিটারের মাপে যদি ধরি, তা হলো ৪৫৬ মিটার। দ্রুতগতির এই লিফট যেন পারলে আসমান ফুটো করে চলে যায়। বিস্ময়ের এই ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে আরেক চমক! দুবাই শহর পুরোটাই দৃষ্টির সীমানায়।

হলুদ, লাল, সবুজ—নানা রঙের বাতির আলোয় গোটা শহর ঝলমল। এই সৌন্দর্য আর প্রাচুর্য কেবলই চোখে দেখার, বর্ণনা করার নয়।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরের বুর্জ খলিফা ভবনের শিখরে উঠে চমকপ্রদ এই দৃশ্য উপভোগ করেন পর্যটকেরা। ১৬৩ তলার ভবনটিতে (৮২৮ মিটার বা ২ হাজার ৭১৪ ফুট) ওঠা যায় ১২৪ ও ১৪৮ তলায়। যে যার মতো ঘুরে বেড়ান পর্যবেক্ষণ ডেকে। আমাদের গন্তব্য ছিল ১২৪ তলা, তাদের ভাষায় ‘অ্যাট দ্য টপ’।

সময়টা ৪ অক্টোবর সন্ধ্যা। দেরা দুবাইয়ের আলমুতিনা স্কয়ারের হোটেল আইকন থেকে যাত্রা। সঙ্গী দুবাইয়ের সাংবাদিক শিবলী আল সাদিক। ব্যক্তিগত গাড়িতে ২০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বার দুবাইয়ের দুবাইমল। বিশাল এই বিপণিকেন্দ্রে রয়েছে বিশ্বের নামীদামি সব ব্র্যান্ডের দোকান। মূলত, বুর্জ খলিফা ভবনে ঢোকার পথ দুবাইমল দিয়ে। এই বিপণিকেন্দ্রের দ্বিতীয় তলায় মিলবে টাওয়ারে ওঠার টিকিট। অ্যাট দ্য টপে যেতে দুজনের খরচ পড়েছে ৩১০ দিরহাম। অবশ্য ১৪৮ তলার স্কাই লাউঞ্জে উঠতে গেলে খরচ আরও বাড়বে।

বুর্জ খলিফা ভবনে আলোর খেলা।
বুর্জ খলিফা ভবনে আলোর খেলা।

টিকিট নেওয়ার পর বুর্জ খলিফা টাওয়ারের পথে। দুবাইমলে দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে কীভাবে এগোবেন। কিংবা যে–কারও কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন। টাওয়ার ওঠার লম্বা লাইন। তবে পথটা বিরক্তির নয়। কারণ, কাচের দেয়ালে সাঁটানো ছবিতে পাবেন উঁচু এই ভবনটি গড়ে তোলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। দেখতে দেখতে পৌঁছে যাবেন লিফট পর্যন্ত। একবারে ৩০ জন ওঠা যায় এই লিফটে। ওঠার সময় বোঝার কোনো উপায় নেই এত ওপরে উঠছে। শুধু লিফটের ফ্লোর বাটনে দেখা যাচ্ছে দ্রুত সংখ্যা বাড়ছে। মাত্র ৬০ সেকেন্ডে গন্তব্যে।

১২৪ তলায় ওঠার পর এ এক অন্য রকম অনুভূতি। বিন্দু বিন্দু আলোয় পুরো দুবাই শহর। হরেক রকমের আলোয় চমৎকার দেখাচ্ছে শহরটিকে। স্বচ্ছ কাচের দেয়াল থেকে দৃষ্টি চলে যাচ্ছে দূরে, বহুদূরে। পর্যটকেরা ছবি তুলছেন, সেলফি নিচ্ছেন। কেউ কেউ ফেসবুকে লাইভও দিচ্ছেন। কিছু পর্যটক কাচের দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়েছেন মেঝেতে। নিজের মতো করে উপভোগ করছেন রাতের সৌন্দর্য। উল্লেখ্য, হলিউডের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘মিশন ইমপসিবল’ সিরিজের ২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘গোস্ট প্রটোকল’–এর শুটিং হয় এই বুর্জ খলিফা টাওয়ারে। এতে নায়ক টম ক্রুজের একটি স্ট্যান্ট বেশ আলোচিত হয়েছিল।

ভবনের নিচে দুবাই ফাউন্টেন লেকে পানির নাচন।
ভবনের নিচে দুবাই ফাউন্টেন লেকে পানির নাচন।

১২৪ তলায় গেলে সিঁড়ি বেয়ে ১২৫ তলা পর্যন্ত ওঠা যায়। দুটি ফ্লোরেই পর্যটকদের জন্য নানা ব্যবস্থা রয়েছে। কিনতে পারবেন বুর্জ খলিফা টাওয়ারের নানা স্যুভেনির। মুঠোফোন কিংবা নিজের ক্যামেরা ছবি মনঃপূত না হলে পেশাদার আলোকচিত্রী দিয়ে ছবি তোলার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে খরচ একটু বেশিই পড়ে। থাকা যায় যতক্ষণ ইচ্ছে। তবে ঘোরার জন্য সর্বোচ্চ এক ঘণ্টাই যথেষ্ট। এরপর নেমে পড়তে পারেন। লিফটে যথারীতি ৬০ সেকেন্ড। ভাবছেন এখানেই শেষ। না, আছে আরও অনেক কিছু।

আলোর খেলা, পানি নাচন
বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবনে ঘুরে আসার ঘোর কাটার আগেই আরেক বিস্ময়! ভবনের নিচে দুবাই ফাউন্টেইন লেকে পানির নাচন। ১৫ মিনিট অন্তর এটির প্রদর্শনী চলে। দুবাইমল ও বুর্জ খলিফা ভবনে আসা হাজারো মানুষ লেকের চারপাশে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য উপভোগ করেন। সেই ভিড়ে দাঁড়িয়ে গেলাম আমরাও। শুরুতেই আরবীয় সংগীতের সুর। আরব্য রজনীর সুরের সঙ্গে অনেকটা মিলে যায়। সেই সুরের তালে পানির নাচন মুগ্ধ করার মতো। কখনো সারিবদ্ধ হয়ে মানুষের দৈহিক ভঙ্গি, কখনো সাপের মতো এঁকেবেঁকে ওপরে উঠে যাচ্ছে পানি। আবার কখনো নিচ্ছে ফুলের অবয়ব। প্রায় ২০০ ফুট পর্যন্ত ওঠে পানির এই ধারা। প্রদর্শনীর ফাঁকেই মুঠোফোন সচল সবার। লাইভ, ভিডিও, ছবি তোলা সমানে চলছে। একটানা ১৫ মিনিট চলে প্রদর্শনীটি। এ ছাড়া লেকে ঘুরে বেড়ানোর জন্য কাঠের নৌকা। আরবীয়দের আদি ধাঁচে তৈরি করা নৌকা ভাড়া করে অনেক পর্যটকই ঘুরে বেড়ান লেকে। সন্ধ্যায়ও আলোর ঝলকানিতে লেকের পানিও যেন নানা রূপ নিচ্ছে।

ভবনে ওঠার দ্রুতগতির লিফট।
ভবনে ওঠার দ্রুতগতির লিফট।

পানির নাচনের পর শুরু হয় আলোর খেলা। এই খেলা চলে বুর্জ খলিফা ভবনের গায়ে। কখনো পাখি ওড়ে, কখনো পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ছে আলপনা। আবার নানা রং খেলা করে ভবনজুড়ে। এভাবে নানা আয়োজনে পর্যটকদের আকর্ষণ করছে বুর্জ খলিফা।

সবাইকে ছাড়িয়ে...
বুর্জ খলিফা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন। এ ছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির ও বেশি দূরত্বের লিফট রয়েছে ভবনটিতে। বেশি মানুষ ধারণক্ষমতায় এগিয়ে এই ভবন। ভবনের পর্যবেক্ষণ ডেকটিও (অ্যাট দ্য টপ ও স্কাই লাউঞ্জ) সবার সেরা। এই ভবনের নির্মাণকাজ ২০০৪ সালে শুরু হয়ে শেষ হয় ২০০৯ সালে। তবে উদ্বোধন করা হয় ২০১০ সালের জানুয়ারিতে। এটি তৈরিতে প্রায় ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হয়েছে। ভবনটিতে রয়েছে অ্যাপার্টমেন্ট, হোটেল, মসজিদ ও সুইমিংপুল। এসব তথ্য বুর্জ খলিফা ভবনের নিজস্ব ওয়েবসাইটের।

১২৪ তলার ওপর পর্যবেক্ষণ ডেকে এক পর্যটক।
১২৪ তলার ওপর পর্যবেক্ষণ ডেকে এক পর্যটক।