প্রশংসা করি মন খুলে

যার যা ভালো তা মন খুলে বলে দিন। প্রশংসা করতে কার্পণ্য করবেন না। মডেল: অপূর্ব ও খুশবু। ছবি : কবির হোসেন
যার যা ভালো তা মন খুলে বলে দিন। প্রশংসা করতে কার্পণ্য করবেন না। মডেল: অপূর্ব ও খুশবু। ছবি : কবির হোসেন

বাঙালি মন খুলে কারও প্রশংসা করতে পারে না। করলে খুব বাড়াবাড়ি করে ফেলে কিংবা অদ্ভুতভাবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে একেবারে প্রশংসাই করে না। অনেকের প্রশংসা শুনে অনেক সময় মনে হয়, ‘যাক, বাবা বাঁচা গেল, একটু প্রশংসা তো করেছে।’ পরমুহূর্তেই তার মুখ থেকে বাংলা ভাষার সেই অমোঘ উচ্চারণ ‘কিন্তু’ লাগিয়ে এমন সব কথা বেরিয়ে এল যে শুনে প্রশংসা করে বলে, ‘আমি তবে পালিয়ে বাঁচি।’

বাঙালি জীবনে এই ‘কিন্তু’ শব্দের ক্ষমতা এবং দৌরাত্ম্য, দুই-ই অপরিসীম এবং সুদূরপ্রসারী। চিরকপট বাঙালির সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্রই যেন হচ্ছে ‘কিন্তু’। ঠিক সময়মতো আস্তিনের তলা থেকে বেরিয়ে আসে। যেকোনো বাক্যে কিন্তুর আগের অংশের প্রশংসার সঙ্গে কিন্তুর পরের অংশের নিন্দার কোনো মিলই খুঁজে পাওয়া যাবে না। মনে হবে এ যেন বিপরীত চিন্তাভাবনার দুজন মানুষের আলাদা বক্তব্য। বাক্যের কিন্তুর আগের প্রশংসার অংশটুকু যেন এক বিশাল ফাঁদ, ওই ফাঁদে যেই না পা দিয়েছেন, অমনি কিন্তুর খড়্গ আপনার ওপর পড়ল বলে। বাঙালির এই স্ববিরোধী আচরণের একটা মিষ্টি নাম আছে—‘নিরপেক্ষতা’। কারও প্রশংসা করলে তার সমপরিমাণ নিন্দাও করতে হবে, নইলে নিরপেক্ষতার কী হবে!

কারও পক্ষ নেওয়া যেন ‘পাপ’। আত্মনিষ্ঠতাকে একটু এক পাশে সরিয়ে রেখে বস্তুনিষ্ঠভাবেও যে কারও শুধু প্রশংসা করা যেতে পারে, এটা আমরা মানতেই নারাজ। কারণ, আমাদের কাছে আত্মনিষ্ঠতা বস্তুনিষ্ঠতার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি ও মহান। গ্রামের সেই বুড়ির গল্পের মতো। বুড়ি ভীষণ ভালো রান্না করে এবং আর যে যত ভালোই রান্না করুক না কেন, সে তাতে একটা খুঁত বের করবেই। সবাই মিলে পরিকল্পনা করে একদিন এমন ভালো করে তরকারি রান্না করল যেন বুড়ি কোনো খুঁতই ধরতে না পারে। তারপর বুড়ির সামনে আনা হলো সেই তরকারি। বুড়ি খেয়ে, অনেকক্ষণ ধরে ভেবে, শেষ পর্যন্ত বলল, ‘ভালোই হইছে, তবে বেশি ভালো কিন্তু ভালো না।’

অনেক সময় কারও সামনে অনেক প্রশংসা করার পর সে চলে গেলেই শুরু হয় তার নিন্দা। বাঙালি মুসলমানকে গিবতের ব্যাপারে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সতর্ক করা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে খুব একটা কিছু করা যায়নি। আমি অনেককেই এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে দেখেছি, তারা বলে, গিবত কিংবা অন্যের নিন্দা করার মধ্যে নাকি একটা অদ্ভুত সুখ আছে। সুতরাং গিবত খুব তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যাবে, তা মনে হয় না।

তবে আজকাল একদম নতুন প্রজন্মের মধ্যে একধরনের পরিবর্তন লক্ষ করছি। নতুন এই ছোট ছোট মানুষ অনেক বেশি আধুনিক, বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত ও উদার। তাই বস্তুনিষ্ঠভাবে মানুষের প্রশংসা করা তার জন্য অনেক সহজ। এই মানুষেরা সংখ্যায় যত বাড়তে থাকবে, ততই আমার এই লেখার অসারতা প্রমাণিত হবে।

এখন কথা হচ্ছে, প্রশংসা নিয়ে হঠাৎ এত আলোচনা কেন? এমন একটা ছোট্ট দেশে এত বড় জনগোষ্ঠী এবং এত বড় তরুণ জনগোষ্ঠী যখন গায়ে গা লাগিয়ে আগামীর দিকে এক পা দুই পা করে এগিয়ে যাবে, তখন তাদের সবচেয়ে বড় পাথেয় হবে পরস্পরের সহযোগিতা। আর সেই সহযোগিতা যত না শারীরিক, তার চেয়ে অনেক বেশি মানসিক। একে অপরের ভালো কাজের প্রশংসা করা, একে অপরকে উৎসাহিত করা। এই পিঠ চাপড়ানো, প্রশংসা কিংবা উৎসাহই কিন্তু হাজারো রাত জাগা, হাজার মাইল হাঁটার কষ্টকে ভুলিয়ে দিতে পারে আর তৈরি করতে পারে একটা অগ্রসরমাণ বাংলাদেশ।

লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, গ্রে অ্যাডভার্টাইজিং বাংলাদেশ

>প্রশংসা নিয়ে বলেন গুণীজন

● আমরা সাধারণত অন্যদের প্রশংসা করি না, অথচ নিজে প্রশংসিত হতে চাই।
ফ্রাঙ্কোস দ্য লা রচফোকাল্ড (১৬১৩-১৬৮০), ফরাসি লেখক

● অন্যের তারিফ করা দারুণ একটি বিষয়। তারিফের মাধ্যমে অন্যের মধ্যকার শ্রেষ্ট বিষয়টিকে নিজের করে তোলা যায়।
ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮), ফরাসি লেখক

 ● প্রত্যেকেই আমরা সমস্যাবহুল একটি পৃথিবীতে সাঁতরে বেড়াচ্ছি, যা কেউই জানে না। অথচ একটুখানি প্রশংসা বা উৎসাহ আমাদের লক্ষ্য পূরণে দারুণ সহায়তা করতে পারে।
রবার্ট কুলিয়ার (১৮৮৫-১৯৫০), মার্কিন লেখক

 ● প্রশংসা সব সময়ই উষ্ণ ও প্রত্যাশিত। কিন্তু তা অর্জন করে নিতে হয়, যেমনটা শিশুর কাছ থেকে আলিঙ্গন পেয়ে থাকি আমরা।
ফিলিস ম্যাকগিনলে (১৯০৫-১৯৭৮), মার্কিন লেখক

● আপনি যত প্রশংসা করবেন, নিজের জীবনকে ততই উপভোগ করবেন এবং জীবনে উপভোগের বিষয় খুঁজে পাবেন।
অপরাহ উইনফ্রে, মার্কিন টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব (১৯৫৪-)

● যিনি প্রশংসার যোগ্য, তাঁকে প্রশংসা করা উচিত বলে আমি বিশ্বাস করি।
ডিন স্মিথ, মার্কিন ক্রীড়াবিদ (১৯৩১-২০১৫)

● আমি সব সময়ই একটি বিষয় বিশ্বাস করি, কেউ যদি অন্যের জন্য ভালো কিছু করতে সক্ষম হয়, তাহলে তার অবশ্যই প্রশংসা করা উচিত।
রবিশংকর (১৯২০-২০১২), ভারতীয় সংগীতজ্ঞ

● বেশির ভাগ সময়ই আমরা স্পর্শের জোর, হাসি, ভালো কথা, সত্যিকারের প্রশংসার শক্তিকে গুরুত্ব দিই না। এসবই জীবন বদলে দিতে পারে।
লিও বাসক্যাগলিয়া (১৯২৪-১৯৯৮), মার্কিন লেখক

● সবাই প্রশংসা পছন্দ করে।
আব্রাহাম লিংকন, সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি (১৮০৯-১৮৬৫)

● প্রতিদিন আমাদের তিনজন মানুষের প্রশংসা করা উচিত।
এইচ জ্যাকসন ব্রাউন (১৯৪০-), মার্কিন লেখক

● অন্যকে উৎসাহ দেওয়া অমূল্য উপহারই বটে।
জয়েস মেয়ার (১৯৪৩-), মার্কিন লেখক 

● যেকোনো সম্পর্ক সফল হতে তিনটি বিষয় প্রয়োজন হয়—পারস্পরিক যোগাযোগ, প্রশংসা ও পারস্পরিক বোঝাপড়া।
মিরান্ডা কের (১৯৮৩-), মার্কিন মডেল

● সব মহত্বের শিকড় লুকিয়ে আছে ভালোত্বের তারিফের মধ্যে।
১৪তম দালাইলামা (১৯৩৫–), শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী, ধর্মীয় গুরু

সূত্র: ব্রেইনি কোট ডটকম