বাধা সীমিত, সম্ভাবনা অফুরন্ত

অলংকরণ: শামীম আহমেদ
অলংকরণ: শামীম আহমেদ

শৈশবে দুচোখ হারানো জিল্লুর রহমানের কথা দিয়ে শুরু করি। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিল জিল্লুর। তার চেষ্টা আমাকে বিস্মিত করত। প্রতিদিন সে বাড়ি থেকে প্রথমে রিকশাযোগে, তারপর পাবলিক বাসে, তারপর ভার্সিটির বাসে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসত। জিল্লুর স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পাস করেছে। তার সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তার মানসিক শক্তি কতটা দৃঢ়। দুচোখ হারানো একজনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ সম্পন্ন করা সহজ কথা নয়।

আমরা দু-একজনের কষ্ট জানি। অধিকাংশের কথাই জানি না। একদিন এক ছাত্রী হলে একটি সিটের জন্য এসেছিল। কাঁদতে কাঁদতে বলছিল—‘হলে সিট না হলেও বারান্দায় থাকার অনুমতি দেন স্যার’। জানতে পারলাম—ছোটবেলায় সে বাবা-মাকে হারিয়েছে। দাদি ভিক্ষা করে তার পড়ার খরচ চালাতেন। অসুস্থতার কারণে আর ভিক্ষা করতে পারছেন না। সেই মেয়েটিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করেছে।

এসব দেখে ভাবি, এদের চেয়ে আমার কষ্ট অনেক কম ছিল। কিন্তু সেই কষ্টকেও অনেক বড় কষ্ট ভাবতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন আমার চিকিত্সক বাবা গত হন। আমাদের বড় পরিবারে তখনো কেউ উপার্জনক্ষম ছিলেন না। আমরা সাময়িকভাবে ভীষণ অর্থকষ্টে পড়ি। ওই দিনগুলোতে ক্যাম্পাসে কত দিন শুধু রুটি খেয়ে রাত্রি যাপন করেছি তার হিসাব নেই। আমার মতো অর্থকষ্টে থাকা বন্ধুসহ অনেক দিন হোটেলে একটি সবজি ভাগ করে দুজনে ভাত খেয়েছি। হোটেলে আমরা একটি ডিম দুজনে মিলে ভাগ করে খেয়েছি। আমরা কত দিন পরিকল্পনা করেছি একটি ওজন মেশিন কষ্ট করে কিনে পড়ালেখার পাশাপাশি ব্যবসা করার। বন্দুকের দোকানে গিয়েছিলাম বন্দুক কিনতে। রঙিন বেলুন বোর্ডে সেঁটে দিয়ে ‘বন্দুক দিয়ে বেলুন ফুটানো খেলা’ থেকে আয় করার জন্য। কোনো রকম একটি ব্যবসা দাঁড় করানো সম্ভব হলে আমাদের পড়ার খরচটা যদি চলে—এই আশায়। যদিও সেই বন্দুক কিংবা ওজন মেশিন কেনার দু-তিন হাজার টাকা আমরা একসঙ্গে সংগ্রহ করতে পারিনি। আমার সেই বন্ধুরা এখন বড় বড় চাকরি করছে।

আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিক জগতে এসবের হাজার হাজার দৃষ্টান্ত আছে। কাজী নজরুল ইসলাম, নিতুন কুণ্ডু, এস এম সুলতান সবাই চরম বাধাকে ঠেলে এগিয়ে গেছেন সামনে। আজ আমাদের সমাজে যত প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি আছেন, তাঁদের অধিকাংশের জীবনে খুঁজলে এমন অনেক বাধা পেরোনোর গল্পই পাওয়া যাবে।

বিশ্বব্যাপী আজ অযুত কাজের ক্ষেত্র। শুধু প্রচলিত তথাকথিত কয়েকটি চাকরি সাফল্য পরিমাপের সূচক নয়। চাকরির একেকটি পদের বিপরীতে হাজার হাজার প্রার্থী। সেই প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়ার মানে ব্যর্থতার কাছে বশ্যতা স্বীকার করা নয়। বরং জীবনের একটি সম্ভাবনার দরজা বন্ধ হলেও অসংখ্য সম্ভাবনা প্রতিনিয়ত হাত বাড়িয়ে ডাকতে থাকে। আমাদের উদ্যম হারিয়ে ফেলার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে—আমরা নিজেকে আবিষ্কার করতে পারি না। কার মধ্যে কোন কাজের প্রবণতা আছে, সেটি চিহ্নিত করা জরুরি।

এ প্লাস না পাওয়া মানে সব সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাওয়া নয়। মেডিকেল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলে ওপরে ওঠার সব সিঁড়ি বন্ধ হয়ে যায় না। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ার মানে জীবনের সব প্রদীপ নিভে যাওয়া নয়। তথাকথিত দু-একটি সম্ভাবনা যাদের নষ্ট হচ্ছে তাদের জন্য সুখবর হচ্ছে—এ রকম মানুষেরাই পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যায় নতুন যুগের দিকে। তারাই নতুন পৃথিবীর স্রষ্টা। আমাদের স্বপ্ন থাকবে। সে স্বপ্নে পৌঁছার জন্য চেষ্টাও থাকবে। শুধু শারীরিক শক্তি নয়, বেড়ে ওঠার জন্য আমাদের মানসিক শক্তিও থাকা চাই।

মানুষ অফুরন্ত সম্ভাবনাময়। বাধা আছে, থাকবে। সেই বাধা খুবই কম। কিন্তু আমাদের সম্ভাবনা অফুরন্ত। এ কথা যেন ভুলে না যাই।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর