আসল স্টেকের স্বাদ

বুনো পশ্চিমের আবহ পিট গ্রিলের অন্দরে। ছবি: খালেদ সরকার
বুনো পশ্চিমের আবহ পিট গ্রিলের অন্দরে। ছবি: খালেদ সরকার

যুক্তরাষ্ট্রে নানা দেশের কুড়িজনের মতো সাংবাদিকের কর্মশালা। দেশ ছাড়ার মাসখানেক আগেই আমাকে চমকে দিয়ে চলে এল একটি রেস্তোরাঁর বিস্তারিত মেন্যু। সবার সঙ্গে প্রথম আলাপ–পরিচয় নাকি হবে প্রশান্ত মহাসাগরের গা–ঘেঁষা সেই কুলীন রেস্তোরাঁয়, হাওয়াইতে। খাবারের সে এক বিরাট পঞ্জি। বিরাট জায়গা জুড়ে শুধু হরেক কিসিমের স্টেক। মহাসমুদ্রের দিগন্ত ছাপানো অবিশ্বাস্য জলপাইরঙা জলরাশির সামনে পেল্লাই আকারের রাশি রাশি গ্র্যানাইট পাথরের স্তূপের মাঝখানে সেই রেস্তোরাঁয় স্টেকের স্বাদ গ্রহণ হয়ে উঠেছিল জীবনের এক পরম অভিজ্ঞতা। (শেষ পর্বের চিজ-কেকটার কথাও ফিসফিস করে বলে রাখতে হবে।)
সেই যে এক মানদণ্ড দাঁড়িয়ে গেল, স্টেক খাওয়ার আনন্দটাই গেল চলে। পরে বিচিত্র জায়গায় স্টেক চেখেছি। কিন্তু, হায়! মাংসখণ্ডের স্বাদের বিশুদ্ধতা, সস আর মসলার সংযম, রসের ঠিকঠাক অনুপাত, রং আর টেক্সচার—কী যেন হতে হতে হয় না।
আশ্চর্য! শেষমেশ তার উদ্ধার হলো কিনা এই বাংলাদেশেই, পিট গ্রিল রেস্তোরাঁয়। ৯–এ (নতুন) ধানমন্ডির ১০৫ নম্বর বাড়িটায় প্রথম যেবার গেলাম, অলিগলির চেহারা দেখে ঢোকার আগে মনেই হয়নি, এর ভেতরেই স্টেকের স্বর্গ।
কিন্তু আপনি ভেতরে গিয়ে বসুন। মেন্যুতেই দেখতে পাবেন, বহু রকমের কাট। রাম্প স্টেক, রিব আই, সারলোইন। রাম্প স্টেক হাড়–চর্বিহীন মাংসের চওড়া পুরু খণ্ড। অন্যগুলো সরল একখণ্ড হাড়ে লাগানো মাংসপিণ্ড। এ রকম মাংসে হালকা গ্রন্থি থাকে। বিশুদ্ধ মাংসের থেকে স্বাদে ও টেক্সচারে আলাদা।
স্টেক তৈরিও হবে নানা তাপে ও রন্ধনকালীন মেয়াদে, আপনার চাহিদা অনুযায়ী—রেয়ার, মিড রেয়ার, মিড, মিড ওয়েল, ওয়েলডান। তাতে স্বাদে, রসে, টেক্সচারে আসে নানা বৈচিত্র্য। যার যা অভিরুচি। বাঙালিদের ওয়েলডান পছন্দ। তবে আমার পরামর্শ, অন্তত পিট গ্রিলে মিড রেয়ার খান। গোমাংস এতে স্বাদের পরমতায় পৌঁছায়। মাংসের স্বাদের ওজস যেমন থাকে, তেমনই রসও। তাদের ব্যবহার করা প্রায় সব মসলাই দেশি। পদে বিদেশি, িকন্তু সৌরভে ঘরোয়া অন্তরঙ্গতা। অপার্থিব!
পিট গ্রিল বলে, স্টেকের এত কাট, ডান ও মান বাংলাদেশে আর কোথাও আছে কি না, সন্দেহ। তবে আমি বুঝতে চেয়েছিলাম, মাংসের এই খোলতাই স্বাদের রহস্যটা কোথায়। জানতে পারলাম, ওদের আছে নিজস্ব চিলার। মাংস কেটে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওদের জন্য সঙ্গে সঙ্গে তা ঢুকিয়ে ফেলে বায়ুশূন্য প্যাকেটে। এরপর কেনা থেকে রান্নার আগ পর্যন্ত সে মাংস চিলারে থাকে নিয়ন্ত্রিত তাপে ও আর্দ্রতায়।

.
.

চিলারে রেখে মাংসকে নেওয়া হয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। অনেক সময় রেখেও দেওয়া হয় দিনকয়েক। কত দিন? মাংসটিকে তারা কোন স্বাদগন্ধে নিয়ে যেতে চায়, সেটা নির্ভর করে তার ওপর। একে তারা বলে এজেড করা। সাধারণভাবে ওয়েট এজেডই করা হয়। তবে প্রিমিয়াম এজেড এবং ড্রাই এজেডও করে তারা। এর সব কথা মেন্যুতে লেখা নেই। আপনি চাইলে মেন্যুর বাইরেও কথা বলুন। নিজের পছন্দ সবার আগে।
পিট গ্রিলের কর্তা বাপি রহমান পড়তে গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। রেস্তোরাঁয় খণ্ডকালীন কাজ করতে করতে রান্নায় আগ্রহ। পরে দুই বছরের ডিপ্লোমাই করে ফেললেন রন্ধনশাস্ত্রে। দেশে ফিরে ২০১৪ সালের নভেম্বরে দিয়ে ফেললেন স্টেকের বিশেষায়িত এই রেস্তোরাঁ, বাঙালিকে স্টেকের মহিমা বোঝানোর বাসনায়।
স্টেকের ওপর জোর দিতে গিয়ে কি অন্যান্য পার্শ্ব খাবার থেকে চোখটা সরে গেল তাদের? আপ্যায়নের শুরু হলো যে আলুর চিপসে, সেটায় জুত হলো না তেমন। খাওয়া শেষে মিষ্টান্নের পরিধিটাও রইল বেশ ছোট।
তবে স্টেকই এখানে আসল। স্টেকের সঙ্গে গ্রিল্ড ভেজিটেবল নেবেন অবশ্যই। শর্করা হিসেবে বেছে নিতে পারেন বেকড পটেটো, পটেটো ম্যাশ বা চিপস—নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী। তবে স্টেক আসার আগে টাটকা ফলের চিনিছাড়া একটি জুস নিন। জুসটা বেশ।
এবার হিম জুসে চুমুক দিতে দিতে গরম স্টেকের আগে ঠান্ডা করতে থাকুন পাকস্থলী।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক