মাঝবয়সের টানাপোড়েন
নিয়মিত প্রাতর্ভ্রমণে যান আলী আনোয়ার (ছদ্মনাম)। পার্কে নানা বয়সী স্বাস্থ্যপিপাসু নারী-পুরুষের ভিড়। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন এক নারীকে দেখে চমকে উঠলেন আনোয়ার (৪৯)। প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে যাওয়ার বয়স পেরিয়ে এসেছেন অনেক আগে। কিন্তু তাঁর চেয়ে দু-চার বছর কম বয়সের দীর্ঘাঙ্গী নারীর সুন্দর মুখশ্রী আর হেঁটে যাওয়ার ঋজু সাবলীল ভঙ্গি কেন জানি হাহাকার জাগিয়ে তুলল বুকের ভেতর।
তাঁর নিজের স্ত্রীও সুন্দরী। তুলনা টানার ইচ্ছা ছিল না। তবু ভোরে বিছানা ছেড়ে আসার সময় আলুথালু বিস্রস্ত অবস্থায় পড়ে থাকা স্ত্রীর সংসারক্লান্ত উদ্যমহীন যে চেহারাটি দেখে এসেছিলেন, তা মনে পড়ে। বড় একঘেয়ে সেই দৃশ্য। পার্কে ঘুরতে আসা নারীকে দেখে তাই যেন নিভে আসা সলতেটি আগুনের উসকানি পায়।
অন্যদিকে, পুরুষের চোখে মুগ্ধতার ভাষা পড়তে পারেন না এমন নারী তো ইহজগতে নেই। আনোয়ারের দৃষ্টি চিনতে অসুবিধা হয়নি অপরাজিতারও (ছদ্মনাম)। নিজের স্বামীর চোখেও এই আগুন তো দেখেছিলেন কোনো এককালে, এখন তা নির্বাপিত। এখন ভদ্রলোকটি যেন একবার চোখ তুলে তাকানোর আগ্রহও হারিয়েছেন। আনোয়ারের দৃষ্টি তাই শিহরিত করে তাঁকে। এখনো ফুরিয়ে যাননি তিনি, এই বোধ নতুন আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে।
এই দুটি অভিজ্ঞ নারী-পুরুষের পরিচয় পর্ব পেরিয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে সময় লাগে না।
মধ্যবয়সের এই সম্পর্ককে সম্পর্ক না বলে সংকট বলাই সংগত। মনোবিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন মধ্যবয়সের সংকট বা মিডএজ ক্রাইসিস।
পরিণতি হয়তো একেকজনের জীবনে একেক রকম। গল্প–উপন্যাসে এ ধরনের সম্পর্কের কথা লেখা হয়েছে অজস্র। সাহিত্য তো আকাশচারী কল্পনা নয়, জীবনেরই প্রতিচ্ছবি।
সমাজের কিছু নিয়ম-শৃঙ্খলা আছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে হৃদয় নামের যে অদৃশ্য বস্তুটি আছে, তা সব সময় এই নিয়ম মেনে চলতে পারে না। কখন দীর্ঘ বিবাহিত জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মায়, ‘হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোনোখানে’ ধরনের এক ভাব এসে উন্মনা করে তোলে হৃদয়, তার ব্যাখ্যা দেবে কে?
আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সূত্রে এই সম্পর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে। যোগাযোগ সহজ। রুটিন বাঁধা জীবনে হতাশ দুজন নারী-পুরুষ ভার্চ্যুয়াল জগতে খুঁজে পায় একে অপরকে। কৌতূহল থেকে অনুসন্ধান, ইনবক্সের আলাপচারিতা থেকে যোগাযোগের পর্ব দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে ঘনিষ্ঠতায়। এই ‘অবৈধ’ সম্পর্কে জড়িয়ে এতদিনের ‘নিরাপদ’ জীবনটা যেন তুচ্ছ হয়ে যায়। ঘটনা প্রকাশ পেলে চড়া মূল্যও দিতে হয়। সমাজের কাছে হেয়, স্বামী-স্ত্রী বা সন্তানের চোখে নিচু হতে হয়। পরিণতি হতে পারে ক্ষেত্রবিশেষে নানা রকম। কখনো বিবাহ-বিচ্ছেদের মতো চূড়ান্ত, কখনো আপাত মীমাংসার পথ ধরে মুখরক্ষা। কিন্তু ক্ষত শুকায় না। ছাইচাপা আগুন বাকিটা জীবনভর জ্বলতে থাকে।
মধ্যবয়স বলতে ঠিক কোন বয়সটাকে বোঝায়? এতকাল ৪০ থেকে ৫০–এর মধ্যেই এটা ঘুরপাক খেয়েছে। কিন্তু এখন গড় আয়ু বেড়ে যেখানে ৭২-এ দাঁড়াল, মধ্যবয়সটা ৫৫ এমনকি ৬০ পর্যন্ত প্রলম্বিত হয়েছে বলে মনে করা হয়।
এই বয়সের সংকট, ঠাট্টা করে যাকে অনেকে বলেন ‘ভীমরতি’। এর কারণ সম্পর্কে নানা ব্যাখ্যা দেন মনোবিজ্ঞানীরা। কম বয়সে মানুষের জৈবিক সত্তা থাকে প্রখর, ধীরে ধীরে তা কমতে থাকে—এটা হতাশার একটা কারণ। মেয়েদের ক্ষেত্রে মেনোপজ বা ঋতুচক্র বন্ধ হওয়ার ফলে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। দেহে পড়ে ভাটার টান পরস্পরের কাছে যেন বৈচিত্র্যহীন হয়ে পড়ে সঙ্গীটি। দৈহিক অতৃপ্তি থেকে মানসিক বৈকল্য।
তখন থেকেই নতুনত্বের স্বাদ পেতে উন্মুখ হয়ে ওঠে দেহমন। তা ছাড়া ততদিনে সন্তানরা বড় হয়, তাদের আলাদা জগৎ গড়ে ওঠে। এতেও এক ধরনের একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতার বোধ তৈরি হয়। পাশ্চাত্যে এখন বিবাহবহিভূর্ত ‘লিভ টুগেদার’ বা ‘ফ্রেন্ড অব বেনিফিট’ ইত্যাদি নানা নামকরণের সম্পর্ক গড়ে উঠছে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক জটিলতার কারণ বের করতে হবে দম্পতিকেই। সঙ্গীকে অবহেলা করা চলবে না। অভিযোগপ্রবণ হওয়া যাবে না। দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে নতুনত্ব খুঁজে নিতে হবে। ‘বুড়িয়ে গেলাম’ বলে হতাশ না হয়ে ইতিবাচক থাকতে হবে। সমাজহিতকর নানা কাজে ব্যস্ত হওয়া যায়। সব বয়সেরই আলাদা সৌন্দর্য আছে। নিজেকে সুন্দর রাখতে হবে। এমনকি পোশাক-আশাকের মতো বাহ্যিক বিষয়েও সচেতন থাকা দরকার। সর্বোপরি, তীব্র জৈবিক সত্তা যখন হ্রাস পায়, তখন মায়া-মমতার বন্ধন দিয়ে ঘাটতি পূরণ করতে হবে। মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া যায়। আজকাল কাপল কাউন্সেলিং বা ম্যারিটাল কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমেও চিকিৎসকেরা সহজ-সুন্দর পথ বাতলাতে পারেন।
এসব ঘটনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গোপন থাকে না। আনোয়ার–অপরাজিতার কথাও গোপন থাকেনি। দুজনের সংসারেই ঝড় এসেছে।
শেষ পর্যন্ত জোড়াতালি দিয়ে টিকে আছে দুটি সংসারই। কিন্তু সেখানে বিশ্বাসের ভিত্তিটা আর নেই।
সেই কোনকালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই ধরনের সম্পর্ককে বিষবৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তাঁর বিষবৃক্ষ উপন্যাসের শেষ পঙ্ক্তিটি ছিল—‘আমরা বিষবৃক্ষ সমাপ্ত করিলাম। ভরসা করি, ইহাতে গৃহে গৃহে অমৃত ফলিবে।’
কিন্তু তাঁর সেই আশা কি পূর্ণ হয়েছে? বরং আমরা তো দেখছি বিষবৃক্ষটি পুষ্প-পত্র-পল্লবে আরও বিকশিত হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
লেখক: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক